বঙ্গভবন থেকে শেখ মুজিবুর রহমানের ছবি সরানো উচিত হয়নি বলে যে মন্তব্য বিএনপি নেতা রুহুল কবির রিজভী করেছেন তা তিনি ‘ভুল বুঝে করেছেন’ বলে দাবি করেছেন। ওই বক্তব্যকে ‘অনাকাঙ্ক্ষিত বক্তব্য’ হিসেবে অভিহিত করে সেজন্য দুঃখও প্রকাশ করেছেন বিএনপির এই মুখপাত্র।
গতকাল সোমবার বঙ্গভবনের দরবার হল থেকে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ছবি নামানোর কথা জানান একদিন আগে উপদেষ্টা হিসেবে শপথ নেওয়া মাহফুজ আলম, যাকে শেখ হাসিনা সরকার পতন আন্দোলনের মাস্টারমাইন্ড হিসাবে তুলে ধরেছেন অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান ড. মুহাম্মদ ইউনূস।
বঙ্গভবন থেকে বঙ্গবন্ধুর ছবি নামানো নিয়ে আলাচনা-সমালোচনার মধ্যে মঙ্গলবার সকাল সাড়ে ১০টার দিকে নয়াপল্টনে বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে এক অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্য রাখছিলেন রিজভী।
তিনি বলেন, “আমি মনে করি, তার (শেখ মুজিবুর রহমান) ছবি নামিয়ে ফেলা উচিত হয়নি। খন্দকার মোশতাক নামিয়েছিলেন, জিয়াউর রহমান তুলেছিলেন।”
এর কয়েক ঘণ্টা পর দুপুর সোয়া ২টার দিকে ফেইসবুকে দলের ভেরিফায়েড পেইজে এ বিষয়ে একটি প্রেস বিজ্ঞপ্তি দিয়েছে বিএনপি। এর শিরোনাম করা হয়েছে- ‘বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব অ্যাডভোকেট রুহুল কবির রিজভীর বিবৃতি’ ‘বক্তব্যের সংশোধনী’।
প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, “আজ ১২ নভেম্বর ২০২৪, মঙ্গলবার সকাল ১০-৩০ মিনিটে বিএনপি কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের নীচতলায় বিএনপি আয়োজিত ফ্রি মেডিকেল ক্যাম্প ও রক্তদান কর্মসূচির অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্যে ‘বঙ্গভবন থেকে শেখ মুজিবের ছবি সরানো উচিৎ হয়নি’ মর্মে একটি সংবাদ অনলাইনে প্রকাশিত হচ্ছে।
“আজ গণমাধ্যমে প্রকাশিত ‘বঙ্গভবন থেকে শেখ মুজিবের ছবি নামানো হয়েছে’ মর্মে একটি সংবাদের প্রতি আমার দৃষ্টি আকর্ষণ হয়। আমি মনে করেছিলাম, বঙ্গভবনের দরবার কক্ষে যেখানে সব রাষ্ট্রপতির ছবি থাকে সেখান থেকে শেখ মুজিবের ছবি নামানো হয়েছে। মূলত: ছবিটি সরানো হয়েছিল বঙ্গভবনের অন্য একটি অফিস কক্ষ থেকে।
“শেখ হাসিনার ফ্যাসিবাদী শাসনে শেখ মুজিবের ছবি রাখার বাধ্যতামূলক আইন করা হয়েছে। ফ্যাসিবাদী আইনের কোনও কার্যকারিতা থাকতে পারে না। অফিস-আদালত সর্বত্রই দুঃশাসনের চিহ্ন রাখা উচিৎ নয়। অনাকাঙ্ক্ষিত বক্তব্যের জন্য আমি দুঃখিত।”
সংবিধানের প্রথম ভাগেই বঙ্গবন্ধুর ছবি রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়সহ সব সরকারি ও বেসরকারি অফিসে রাখার বাধ্যবাধকতার কথা রয়েছে।
ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর অন্তর্বর্তীকালীন সরকার দায়িত্ব নিয়ে সংবিধান সংস্কারের উদ্যোগ নিলেও তার আগেই বঙ্গবন্ধুর প্রতিকৃতি নামানো হয়েছে।
যে আন্দোলনে শেখ হাসিনার সরকারের পতন হয়েছে, সেই বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেপথ্যের কারিগরদের একজন মাহফুজ মনে করেন, গত ৩ আগস্ট এক দফার দাবি দেওয়ার পরই সংবিধান বাতিল হয়ে গেছে।
যদিও এখন পর্যন্ত সংবিধান স্থগিত কিংবা বাতিল হয়নি এবং আওয়ামী লীগ থেকে নির্বাচিত রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিন সাংবিধান অনুযায়ী নতুন সরকার এবং মাহফুজসহ উপদেষ্টাদের শপথ পড়িয়েছেন।
বাঙালির মুক্তির জন্য লড়াই চালিয়ে যাওয়া শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৬৬ সালে ছয় দফা দাবি তোলার পর আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা দিয়ে তাকে গ্রেপ্তার করেছিল পাকিস্তান সরকার।
১৯৬৯ সালে গণঅভ্যুত্থানে কারামুক্ত হওয়ার পর ঢাকার তৎকালীন রেসকোর্স ময়দানে ছাত্র-জনতার সংবর্ধনা সভা থেকে তাকে বঙ্গবন্ধু উপাধিতে ভূষিত করা হয়। তখন তিনি আওয়ামী লীগের সভাপতি।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের নায়ক, প্রথম রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবকে জাতির পিতা বলা হলেও তা সংবিধানে যুক্ত হয়েছিল ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় যাওয়ার পর। তার দেড় দশক পর অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের পতন ঘটলে আন্দোলনকারী নেতাদের কাছে এখন ‘ফ্যাসিস্ট’ হিসাবে চিহ্নিত আওয়ামী লীগ এবং এই দলের নেতারা।
অন্তর্বর্তী সরকার সংবিধান সংস্কারেও একটি কমিশন গঠন করেছে। প্রবাসী রাষ্ট্রবিজ্ঞানী আলী রীয়াজ নেতৃত্বাধীন সেই কমিশনে মাহফুজও একজন সদস্য। কমিশন এখনও তাদের কাজ শেষ করেনি। তার মধ্যেই রবিবার বঙ্গভবনে রাষ্ট্রপতির কাছ থেকে উপদেষ্টা হিসাবে শপথ নেওয়ার পরদিনই বঙ্গবন্ধুর প্রতিকৃতি নামিয়ে ফেলার কথা জানান মাহফুজ।
বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে সকালের ওই অনুষ্ঠান রিজভী আরও বলেন, “পঁচাত্তরের ১৫ আগস্টের পর খন্দকার মোশতাক শেখ মুজিবের ছবি নামিয়ে নিল। জিয়াউর রহমান ৭ নভেম্বর সিপাহী জনতার বিপ্লবের মাধ্যমে রাষ্ট্র ক্ষমতায় এলেন। জিয়াউর রহমান কিন্তু বঙ্গভবনে শেখ মুজিবের ছবি ফিরিয়ে আনেন।”
বিএনপির এই মুখপাত্র বলেন, “শেখ মুজিবুর রহমান বাকশাল কায়েম করেছিলেন, স্বাধীনতার পরে সব দল নিষিদ্ধ করেছিলেন। গণতন্ত্র হত্যার ধারা তার হাত দিয়ে এসেছে। এর আগে ৬০ এর দশকে স্বাধিকারের আন্দোলন করেছিলেন। মানুষ তাকে বিশ্বাস করেছিল। ৭০ এ তাকে ভোট দিয়েছিল। কিন্তু তার অঙ্গীকার তিনি রক্ষা করতে পারেননি।
“স্বাধীনতা যুদ্ধে তিনি কোনও ভূমিকা রাখেননি। স্বাধীনতা যুদ্ধের আগে স্বাধিকার আন্দোলনে তার কিছুটা ভূমিকার কথা জনগণ মনে রেখেছে। স্বাধীনতা যুদ্ধের ঘোষণা তো দিয়েছে অদম্য সাহসী মেজর শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান।”
এসময় বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা ডা. ফরহাদ হালিম ডোনার, স্বাস্থ্য বিষয়ক সম্পাদক ডা. রফিকুল ইসলাম, সহ-স্বাস্থ্যবিষয়ক সম্পাদক ডা. পারভেজ রেজা কাকন প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন।
প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারীর দায়িত্ব পালন করে আসা মাহফুজ আলম রবিবার সন্ধ্যায় উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য হিসেবে শপথ নিলেও তাকে এখন পর্যন্ত কোনও মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব দেওয়া হয়নি।
বঙ্গভবনের দরবার হলে রাষ্ট্রপতির কাছ থেকে শপথ নেওয়ার পর সেখানে দাঁড়িয়ে নিজের তোলা একটি ছবিও ফেইসবুক পোস্টে শেয়ার করেন মাহফুজ। ছবিতে মাহফুজ যেখানে দাঁড়ানো অবস্থায় ছিলেন, তার ঠিক পেছনের দেয়ালেই আগে বঙ্গবন্ধুর একটি ছবি ঝোলানো থাকত। তবে মাহফুজের পোস্ট করা ছবিতে তা দেখা যায়নি।
বঙ্গবন্ধুকে ‘একাত্তর-পরবর্তী ফ্যাসিস্ট’ আখ্যায়িত করে ফেইসবুক পোস্টে মাহফুজ লিখেছেন, “একাত্তর-পরবর্তী ফ্যাসিস্ট শেখ মুজিবুর রহমানের ছবি দরবার হল থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়েছে।”