সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল করে গণতন্ত্রের বুকে কুঠারাঘাত করেছিল আওয়ামী লীগ, আদালতে একথা বলেছেন অ্যাটর্নি জেনারেল মো. আসাদুজ্জামান।
তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল করে আনা সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনী কেন অবৈধ ঘোষণা করা হবে না, সে প্রশ্নে রুলের শুনানিতে বুধবার রাষ্ট্রপক্ষে এই বক্তব্য দেন তিনি।
ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের প্রেক্ষাপটে বিচারপতি ফারাহ মাহবুব ও বিচারপতি দেবাশীষ রায় চৌধুরীর হাই কোর্ট বেঞ্চে এই শুনানি শুনানি চলছে।
অন্তর্বর্তীকালীন সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর রাষ্ট্রের প্রধান আইন কর্মকর্তার পদে আসা আসাদুজ্জামান শুনানি শেষে সাংবাদিকদের বলেন, তিনি বলেন, “সরকারের পক্ষে এ রুলকে আমরা সাপোর্ট করি, তবে আমরা পুরো সংশোধনী বাতিল চাই না। কয়েকটি জায়গা ইন্টা ভাইরেস (বিধিবদ্ধ বিষয়ে সঙ্গে সম্পর্কিত) থাকবে, কারণ হলো- আগের যে সংবিধানের স্ট্রাকচারের থিওরি, তার সঙ্গে সেগুলো সাংঘর্ষিক নয়।”
১৯৯৬ সালে সংবিধানে যুক্ত হওয়া নির্বাচনকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিধান ২০১১ সালের ৩০ জুন বাতিল করে সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনী আনে আওয়ামী লীগ সরকার। তার আগে তত্ত্বাবধায়ক সরকার অবৈধ বলে রায় এসেছিল আদালত থেকে।
পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে ‘ফ্যাসিজম’কে দীর্ঘায়িত করার একটা ‘ফন্দি’ আওয়ামী লীগ করেছিল বলেও বলেও মন্তব্য করেন অ্যাটর্নি জেনারেল।
তিনি বলেন, “পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে এমন জায়গায় নিয়ে যাওয়া হয়েছে, যেটার মাধ্যমে বাংলাদেশের রুল অব ল, বিচার বিভাগের স্বাধীনতা, গণতন্ত্রকে মূল্যহীন করার উপক্রম করা হয়েছে।
“আমরা বলেছি সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীর যে আইন সংসদের পাস করা হয়েছে, তা সংবিধানের ওপর প্রতারণার শামিল।”
এই সংশোধনীর মাধ্যমে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল করার বিষয় তুলে ধরে আসাদুজ্জামান বলেন, “সেই বাতিলটা গণতন্ত্রের বুকে কুঠারাঘাত করা হয়েছে। এই বাতিলটা স্বাধীনভাবে করা হয়েছে, সংবিধানের রায়ের জন্য অপেক্ষাও করা হয়নি, রায়ের রেফারেন্সের জন্যও অপেক্ষা করা হয়নি।”
পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে সংবিধানের ১২৩ অনুচ্ছেদে সংসদ সদস্যদের বহাল রেখে সাধারণ নির্বাচন করে আবার সংসদ সদস্য হিসেবে কার্যভার গ্রহণের বিধান যুক্ত করা হয়।
এই সংশোধনীর বিষয়ে অ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, “সেটা অবৈধ, তা সংবিধানের মূল কাঠামোর ওপর আঘাত করে। কারণ গণতন্ত্রের স্বচ্ছ অনুশীলনে এটা নেই। প্রতিটি বক্তব্যের পেছনে আমি রেফারেন্স দিয়েছি।”
সংবিধানের এ সংশোধনীর মাধ্যমে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে জাতির পিতা হিসাবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়।
সেই বিষয়ে অ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, “জাতির জনকের বিষয়ে আমরা বলেছি, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে উনার অবদান অনস্বীকার্য। রাজনৈতিক নেতৃত্ব হিসাবে উনি অনেক ওপরের মানুষ। কিন্তু একজন ব্যক্তি সবকিছু করেছেন, একজন ব্যক্তিই সবকিছু, ‘দিস ইজ নট দ্যা কনসেপ্ট অব আওয়ার প্রিঅ্যামবেল অফ দ্য কন্সটিটিউশন’। সংবিধানের প্রস্তাবনায় বলা আছে, আমরা সবাই স্বাধীন করেছি।”
১৪২ অনুচ্ছেদে গণভোটের বিধান ছিল, যা পঞ্চদশ সংশোধনীতে বিলুপ্ত হয়। এ বিষয়ে আদালতে অ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, “গণভোটের বিধান বিলুপ্ত করে সংবিধান সংশোধনের ক্ষেত্রে কথা বলার যে অধিকার, তা ক্ষুন্ন করা হয়েছে, কণ্ঠরোধ করা হয়েছে।”
তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল করে আনা সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনী বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে গত ১৮ আগস্ট সুশাসনের জন্য নাগরিক- সুজনের সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদারসহ পাঁচ নাগরিক এই রিট আবেদনটি করেন। পরদিন ১৯ আগস্ট রুল হয়ে এ শুনানি চলছে।
এর আগে গত ১০ নভেম্বর এ মামলা শুনানির জন্য এলেও আইনি প্রশ্ন ওঠায় মুলতবি করে বুধবার দিন রেখেছিল হাই কোর্ট।
এদিকে তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থা বিলুপ্তি করে সংবিধানের ত্রয়োদশ সংশোধনী বাতিলের রায়ের বিরুদ্ধে দায়ের করা পৃথক তিনটি রিভিউ আবেদনের শুনানির জন্য সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ ১৭ নভেম্বর দিন ঠিক রয়েছে।
যেহেতু দুটি মামলার মূল বিষয়বস্তু তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা, সে কারণে কোন আদালতে আগে শুনানি হবে, এ বিষয়ে আইনি প্রশ্ন দেখা যায়।
এ বিষয়ে বুধবার হাই কোর্টের শুনানির শুরুতেই অ্যাটর্নি জেনারেল, রিট আবেদনকারী আইনজীবী ড. শরীফ ভূইয়া, ইন্টারভেনার (আদালতকে সহায়তা করতে) অন্যান্যপক্ষের মধ্যে আইনজীবী শিশির মনির শুনানি করেন। শুনানি শেষে আদালতের সিদ্ধান্ত দেয় যে, যেহেতু আপিল বিভাগের শুনানি শেষ দিকে রয়েছে। হাই কোর্ট বিভাগও এ বিষয়ে শুনানি করে এগিয়ে রাখতে চায়। তবে আপিল বিভাগের রায়ের আগে হাই কোর্ট বিভাগ রায় দেবে না।