Beta
বৃহস্পতিবার, ২৮ নভেম্বর, ২০২৪
Beta
বৃহস্পতিবার, ২৮ নভেম্বর, ২০২৪

রিয়ালের সুপারস্টার ভিনিসিয়ুস কেন ব্যর্থ ব্রাজিলে?

vini-12
Picture of খালিদ রাজ

খালিদ রাজ

[publishpress_authors_box]

“ভিনিসিয়ুস, ব্যালন ডি’অর”- রিয়াল মাদ্রিদ সমর্থকরা গলা মিলিয়ে গাইতে থাকে। দিনকয়েক আগে ফ্রান্স ফুটবলের পুরস্কারটি জিততে না পারা খেলোয়াড় যখন হ্যাটট্রিক উদযাপন করেন, তখন ভক্তদের প্রতিবাদের ভাষা কিংবা দাবি যাই হোক, সেটা মানানসই। তবে ভিনিসিয়ুস তার ভক্তদের শান্ত করার চেষ্টা করেছেন ওই হ্যাটট্রিকে।

এটা ওসাসুনার বিপক্ষে রিয়াল মাদ্রিদের ৪-০ গোলের জয়ের দিনের ঘটনা। আড়াই সপ্তাহের মধ্যে সান্তিয়াগো বার্নাব্যুতে যেদিন ভিনিসিয়ুস করেন দ্বিতীয় হ্যাটট্রিক। গত ২২ অক্টোবর বরুসিয়া ডর্টমুন্ডের বিপক্ষে ঘুরে দাঁড়িয়ে ৫-২ গোলের জয়ের পথে হ্যাটট্রিক করেছিলেন এই ফরোয়ার্ড। ওইদিন বার্নাব্যুর প্রেস বক্সে সাংবাদিকরা তর্কে মেতেছিলেন, এটাই ভিনির ক্যারিয়ারের সেরা ৪৫ মিনিট কিনা।

শুধু ভক্ত ও সাংবাদিকরা নয়, ভিনিসিয়ুসের প্রশংসা ঝরেছিল সতীর্থ জুড বেলিংহামের কণ্ঠে। ওসাসুনা ম্যাচের পর ইংলিশ মিডফিল্ডার তাকে ‘অপ্রতিরোধ্য’ উল্লেখ করে বলেছিলেন, “সে আমাদের নেতা।” মাদ্রিদের ক্লাবটির কোচ কার্লো আনচেলত্তির তো আগে থেকেই ভিনিসিয়ুসের প্রশংসায় পঞ্চমুখ। গত ফেব্রুয়ারিতেই ইতালিয়ান কোচ বলেছিলেন, “সে বিশ্বের সেরা।”

ক্লাব ফুটবলে ভিনিসিয়ুসের পারফরম্যান্স-পরিসংখ্যান আকর্ষণীয়। চলতি মৌসুমে ১৭ ম্যাচে তার ১২ গোল। গত মৌসুমে করেছিলেন ২৪ গোল, যার একটি ছিল চ্যাম্পিয়নস লিগ ফাইনালে। এরপরও ব্যালন ডি’অরের জুরি বোর্ডের মন গলাতে পারেননি। তাকে পেছনে ফেলে ফ্রান্স ফুটবলের পুরস্কারটি জিতেছেন ম্যানচেস্টার সিটির মিডফিল্ডার রোদ্রি। পুরস্কার ঘোষণার আগেই খবরটি জেনে যাওয়ায় প্যারিসের অনুষ্ঠান বয়কট করে রিয়াল মাদ্রিদ।

ফিফা র‌্যাঙ্কিংয়ের শীর্ষ ১০০ দেশের সাংবাদিকের ভোটে বিজয়ী নির্ধারণ হয়েছে। তাদের মধ্যে ৩৫ জনের রায়ে ভিনি এক নম্বর। অন্যদিকে ৪৯ জন সেরা মেনেছেন রোদ্রিকে। ক্লাব ফুটবলে ভিনিসিয়ুসের চোখধাাঁধানো পারফরম্যান্সের পরও কেন ব্যালন ডি’অরের ভোটারদের ভোট তার বাক্সে পড়েনি? তাদের মন জিততে এই ফরোয়ার্ড আর কী করতে পারেন?

উত্তরটা সম্ভবত জাতীয় দলের পারফরম্যান্সই হওয়ার কথা! ব্রাজিলে ভিনিসিয়ুসের দুর্বল পারফরম্যান্স- এই সমালোচনা তাকে ঘিরে প্রায়ই হয়। অনেক ব্রাজিলিয়ান স্পষ্টই বলেন, ব্রাজিলের জার্সি গায়ে উঠলে ব্যর্থতার ভূত চেপে বসে তার ঘাড়ে। রিয়াল মাদ্রিদের জার্সিতে ম্যাচের ফল নির্ধারকের ভূমিকায় যাকে দেখতে অভ্যস্ত সবাই, সেই তাকে ব্রাজিলের হয়ে এই ভূমিকায় দেখা গেছে সামান্য। বরং ব্রাজিল সমর্থকদের চোখের কাঁটা হয়ে দাঁড়িয়েছেন এই ফরোয়ার্ড।

সবশেষ ভেনেজুয়েলার ম্যাচটি যেমন। ১-১ গোলে ড্র হওয়া ম্যাচে সেরকম সুযোগ তৈরি করতে পারেননি, উল্টো মিস করেছেন পেনাল্টি। স্পট কিক থেকে গোল করতে পারলে পূর্ণ ৩ পয়েন্ট নিয়ে মাঠ ছাড়ার সুযোগ থাকতো সেলেসাওদের।

রিয়াল মাদ্রিদে তিনি সুপারস্টার

ব্রাজিল থেকে ইউরোপে আসা খেলোয়াড়ের সংখ্যা অনেক। কৈশোর পেরোনোর পর ইউরোপগামী বিমান ধরেন অনেকে। তবে ২০১৭ সালে ভিনিসিয়ুসের পেছনে রিয়াল মাদ্রিদের ৪৫ মিলিয়ন ইউরো খরচ করাটা অনেকের কাছে বাড়াবাড়ি ছিল। রিয়ালের জার্সি গায়ে জড়ানোর পর তার নিষ্প্রভ পারফরম্যান্স সেই সন্দেহ আরও স্পষ্ট হয়ে ধরা দেয়। ছয় বছরের ব্যবধানে ওই ভিনি এখন রিয়ালের সুপারস্টার, ব্যালন ডি’অরের প্রতিদ্বন্দ্বী, বর্ণবাদ বিরোধী আন্দোলনের নেতা ও ইউনেস্কোর দূত।

রিয়াল মাদ্রিদের শুরুর বছরগুলোতে ভীষণ সংগ্রাম করতে হয়েছে তাকে। তার গতি ও ড্রিবল নিয়ে কারও সন্দেহ ছিল না। কিন্তু গোলমুখে গেলেই খেই হারানো ভিনিকে কাঠগড়ায় তুলেছেন ফু্টবল বিশ্লেষকরা। রিয়ালের প্রথম তিন মৌসুমের লা লিগায় তার গোলসংখ্যা যথাক্রমে- ২, ৩ ও ৩।

ওই হতাশা পেছনে ফেলে প্রথমবার ফুটবলবিশ্বের নজরে পড়েন ২০২০-২১ মৌসুমের চ্যাম্পিয়নস লিগে। লিভারপুলের বিপক্ষে লস ব্লাঙ্কোদের ৩-১ গোলে জেতার পথে জোড়া গোল করেছিলেন তিনি। যার প্রথমটিতে টনি ক্রুসের পাস ধরে নিজের গতির ব্যবহার করে চোখজুড়ানো গোল করেন ভিনি।

ঝলক দেখানো ভিনির সাফল্যমোড়ানো মৌসুমের শুরুটা ২০২১-২২ মৌসুমে। কার্লো আনচেলত্তি কোচ হয়ে ফিরে এই ফরোয়ার্ডের সেরাটা বের করে আনেন। ভিনির সমস্যা ছিল গোলমুখে। দুর্দান্ত গতি ও ড্রিবলিংয়ে ‍প্রতিপক্ষের খেলোয়াড়দের ছিটকে দিলেও শট নিতে দেরি করতেন। যেকারণে ফাইনাল পাস কিংবা গোলমুখে শট নিতে নিতেই আটকা পড়তেন।

যেকারণে আনচেলত্তির পরামর্শ ছিল, “সে ওয়ান টু ওয়ানে দুর্দান্ত। আমি ওকে বলেছি এক কিংবা দুই টাচে গোল করতে হবে। বল নিয়ে বেশি সময় ব্যয় করলে গোল করা কঠিন। তাকে অবশ্যই বক্সের ভেতরে যেতে হবে।” ইতালিয়ান কোচের বার্তাটা পরিষ্কার- গোলের কাছাকাছি যেতে হবে, যতটা সম্ভব কম সময় নিতে হবে এবং সিদ্ধান্ত নিতে হবে দ্রুত।

আনচেলত্তির এই পরামর্শ কতটা কার্যকরী, ভিনির বর্তমান পারফরম্যান্স দেখে থাকলে বলার প্রয়োজন পড়ছে না। ২০২০-২১ ও ২০২১-২২- এই দুই মৌসুমে লা লিগায় ৩৫টি করে ম্যাচ খেলেছেন। ২০২১-২২ মৌসুমে তিনি শট নিয়েছেন ৮০টি, আগের মৌসুমের তুলনায় প্রায় দ্বিগুণ। তার গোলমুখে শটের সংখ্যাও প্রায় দ্বিগুণ। ফল, ২০২২ সালে রিয়াল মাদ্রিদের লা লিগা ও চ্যাম্পিয়নস লিগ জয়।

গত মৌসুমেও রিয়াল জিতেছে এই দুই শিরোপা। এবারও সামনে থেকে নেতৃত্ব দিয়েছেন ভিনিসিয়ুস। গত মৌসুমে তার সঙ্গে যোগ দিয়েছেন জুড বেলিংহাম। ইংলিশ মিডফিল্ডার প্রথম মৌসুমেই আলো ছড়িয়েছেন। এবারের মৌসুমে যোগ দিয়েছেন গ্লোবাল সুপারস্টার কিলিয়ান এমবাপ্পে। বেলিংহামের পর এমবাপ্পে এলেও রিয়ালের মধ্যমণি এখনও এই ভিনিসিয়ুস।

কিন্তু ক্লাবের এই সুপারস্টার দেশের জার্সি জড়ালেই ব্যর্থতার তলানিতে নিমজ্জিত হচ্ছেন!

কেন ব্রাজিলে ব্যর্থ ভিনি

চোটের কারণে অক্টোবরের বিশ্বকাপ বাছাইয়ের দুই ম্যাচ খেলতে পারেননি ভিনিসিয়ুস জুনিয়র। এ মাসে বিশ্বকাপ বাছাইয়ের স্কোয়াডে তিনি আছেন। ভেনেজুয়েলার বিপক্ষে প্রথম ম্যাচ খেলেছেনও। কিন্তু অতীতের হতাশা কাটাতে পারেননি। বরং পেনাল্টি মিস করে আরেকবার সমালোচনার তীরে বিদ্ধ হচ্ছেন।

নভেম্বরের দল ঘোষণার সময় ব্রাজিল কোচ দোরিভাল জুনিয়র ব্যালন ডি’অর প্রসঙ্গে জানিয়েছিলেন, ভিনিসিয়ুসের ব্যালন ডি’অর না পাওয়াটা ‘অন্যায়’। ব্রাজিল কোচ দাবি করেন, এই ফরোয়ার্ড ফ্রান্স ফুটবলের পুরস্কারটি না পাওয়ায় হতাশ ও ক্ষুব্ধ ব্রাজিলের ফুটবল সমর্থকরা। যদিও সমর্থকদের ভাষ্য অন্যরকম। সেপ্টেম্বরে প্যারাগুয়ের কাছে হারে ভিনির দোষ দেখেছেন অনেকে। এরপর অক্টোবরের বিশ্বকাপ বাছাইয়ের দুই ম্যাচ যখন ভিনিকে ছাড়াই জিতে নেন ব্রাজিল, তখন বেশিরভাগ সমর্থকের ভাবনা ছিল এমন- ‘ভিনিকে ছাড়াই ভালো’।

২০১৯ সালে ব্রাজিল দলে অভিষেক ২৪ বছর বয়সী ফরোয়ার্ডের। রিয়ালে যেখানে তার তাণ্ডবময় পারফরম্যান্স, সেখানে জাতীয় দলে ৩৬ ম্যাচে ভিনির গোল মোটে ৫টি। পাঁচ বছরের ক্যারিয়ারে ব্রাজিল দলে জায়গা পাকাপোক্ত হয়েছে ২০২১ সালের কোপা আমেরিকায়। শুরুতে বদলি হয়ে নামলেও ২০২১ সালের বিশ্বকাপ বাছাইয়ে চিলির বিপক্ষে প্রথমবার একাদশে সুযোগ মেলে। যদিও বিরতির সময়েই ফিরতে হয় বেঞ্চে।

গত একদশকে ব্রাজিলের মধ্যমণি ছিল নেইমার। তাকে কেন্দ্র করেই ব্রাজিলের আক্রমণভাগ সাজানো হয়েছে। যেকারণে উইং ধরে ওপরে উঠলেও খুব বেশি ভেতরে ঢোকার সুযোগ ছিল না ভিনিসিয়ুসের। জাতীয় দলে তার ব্যর্থতার কারণ হিসেবে যদি এই কারণ ধরেও নেওয়া যায়, তারপরও কি এই ফরোয়ার্ডে নিজের সামর্থ্যের প্রমাণ দিতে পেরেছেন? ভেনেজুয়েলার ম্যাচটিই কথাই ধরা যাক। উইং ধরে ওপরে ওঠার সময় বারবার বাধাপ্রাপ্ত হয়েছেন। বাধ্য হয়ে একটা সময় কিছুটা ভেতরে খেলে বক্সের ঢোকার চেষ্টা করেছেন নেইমার।

ধরে নেওয়া হলো, দলীয় সমন্বয় কিংবা খেলার কৌশলের কারণে ভিনিসিয়ুস স্বাধীনভাবে খেলতে পারেননি। কারণ বাঁদিকে নেইমারের প্রভাব বেশি। কিন্তু এখন তো নেইমার নেই। এক বছরের বেশি সময় তিনি ব্রাজিল দলের বাইরে। এই সময়ে ব্রাজিলের সবচেয়ে বড় তারকা ভিনি। তাকে কেন্দ্র করেই সাজানো হচ্ছে ছক। আক্রমণভাগের নেতৃত্বে তিনি। তারপরও কেন পারছেন না রিয়াল ফরোয়ার্ড?

কারণটা মাঝমাঠ। ব্রাজিলের বর্তমান দলের সবচেয়ে দুর্বল এই বিভাগ। ভিনিসিয়ুস প্রথাগত উইঙ্গার। ফুটবলের সাধারণ নিয়ম বলে, আপনি যদি প্রথমে মাঝমাঠের লড়াই না জেতেন তাহলে পার্শ্বরেখা বা উইং পজিশনের লড়াই জিততে পারবেন না। প্রতিপক্ষের খেলোয়াড়দের ফাঁকি দিয়ে মাঝমাঠ থেকে যদি ‍বুদ্ধিদীপ্ত পাস না আসে, তাহলে ভিনিসিয়ুসের জন্য কাজটা কঠিন হয়ে যায়। তিনি একটা নির্দিষ্টা করিডোরের মধ্যে থাকেন। প্রতিপক্ষের খেলোয়াড়রা সবসময় ওত পেতে থাকেন, যাতে খুব একটা জায়গা না পান। এবারের মৌসুমে রিয়াল মাদ্রিদেও এই সমস্যাটা টের পাচ্ছেন ভিনি, তার মূল বল সরবরাহদাতা টনি ক্রুস অবসরে যাওয়ায়।

লিলের বিপক্ষে চ্যাম্পিয়নস লিগ মৌসুমের প্রথম ম্যাচের পর রিয়ালের সাবেক তারকা প্রেদরাগ মিয়াতোভিচ তাই বলেছিলেন, “রিয়াল মাদ্রিদের বর্তমান মিডফিল্ড শারীরিকভবে অনেক শক্তিশালী, তবে তাদের সৃজনশীলতার অভাব। মদরিচকে এই ম্যাচে মিস করেছি, তাছাড়া টনি ক্রুসও আর নেই।” সঙ্গে যোগ করেছেন, “সবাই ভিনির ফর্ম হারানোর কথা বলছে, কিন্তু তার খেলার ধরন নির্ভর করে বল কীভাবে তার কাছে পৌঁছায় সেটির ওপর। লিলের বিপক্ষে রিয়ালের মিডফিল্ড তাকে ভালো পাস সরবরাহ করতে পারেনি।”

রিয়াল মাদ্রিদের চলতি মৌসুমের সমস্যা ব্রাজিল দলে অনেক দিন ধরে। নিউক্যাসলের ব্রুনো গুইমারারেস সাম্প্রতিক সময়ে সবচেয়ে হতাশার নাম। কাসেমেরো বাদ পড়ার পর ব্রাজিলের মাঝমাঠের ‘নেতা’ হয়ে ওঠেন তিনি। কিন্তু তার কার্যকারিতা নেই বললেই চলে।

বিশ্বের অন্য দেশগুলোর ফুটবল সমর্থকরা ব্রাজিলের গোলকিপার, সেন্টার-ব্যাক ও উইঙ্গারদের ভীষণ পছন্দ করেন। বাইরের এই ভালোবাসায় ব্রাজিলও হয়তো ভুলে গেছে তাদের মাঝমাঠ ফুটো হয়ে গেছে অনেক আগেই। দলে অলরাউন্ড মিডফিল্ডার নেই অনেক বছর।

অথচ ৯০’র দশকে এই দলটির ছিল রক্ষণ ও সৃজনশীলতার সমন্বয়ে কার্যকারী মাঝমাঠ। মিডফিল্ডারের কেউ শুধু রক্ষণে সহায়তা করতেন, কেউ আবার আক্রমণে জোর বাড়াতেন। এখন মাঝমাঠে কোনও নিয়ন্ত্রণ নেই ব্রাজিলের। না প্রতিপক্ষের আক্রমণ সামলাতে পারছে, না পারছে আক্রমণে বল জোগাতে।

এই অকার্যকর মাঝমাঠের ফাঁদে পড়ে ভিনিসিয়ুসের কার্যকারিতা হারাচ্ছেন হলুদ জার্সিতে! 

আরও পড়ুন

সর্বশেষ

সর্বাধিক পঠিত