ভারতের হায়দরাবাদ শহরের তরুণী অনন্যা গুপ্তা। অস্ট্রেলিয়ায় পড়ালেখা শেষ করার স্বপ্ন তার দীর্ঘদিনের। কারণ তার মনে হয়েছে, দেশটির শিক্ষাব্যবস্থা অন্য অনেক দেশের তুলনায় ভালো।
এ বছরের জুলাইয়ে মেলবোর্নের মোনাশ ইউনিভার্সিটি থেকে স্নাতক ডিগ্রি শেষ করেন অনন্যা। এরপর তিনি সমাজকর্মী হতে প্রয়োজনীয় স্নাতকোত্তর কোর্সের জন্য আবেদন করেন। অস্ট্রেলিয়া বর্তমানে দক্ষ জনবলের সংকট মোকাবেলায় এই ধরনের কাজের জন্য বিশেষভাবে আগ্রহী।
কিন্তু অনন্যা সম্ভাব্য আন্তর্জাতিক শিক্ষার্থীদের একজন, যারা অস্ট্রেলিয়া সরকারের বিদেশি শিক্ষার্থী সংখ্যা কমানোর পরিকল্পনা নিয়ে উদ্বিগ্ন।
অস্ট্রেলিয়ার সরকার জানিয়েছে, নতুন সীমা আরোপের ফলে নতুন ভর্তি উল্লেখযোগ্যভাবে কমবে। প্রায় ৩২ বিলিয়ন ডলারের শিক্ষা খাতকে আরও টেকসই করতে এ পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে।
এটি দেশটির সাম্প্রতিক নীতিমালাগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বিতর্কিত পদক্ষেপ। এতে শিক্ষার্থী ভিসার জন্য ইংরেজি ভাষার দক্ষতার ওপর কঠোর শর্ত আরোপ করা হয়েছে। উচ্চতর ডিগ্রি অর্জনের জন্য আবেদনকারীদের ওপরও কঠোর শর্ত আরোপ করা হয়েছে। আর অফেরতযোগ্য ভিসার ফি করা হয়েছে দ্বিগুণ।
সংশ্লিষ্টরা অভিযোগ তুলেছেন, নতুন নীতিমালা পরিকল্পনা নিয়ে তাদের সঙ্গে কোনও পরামর্শ করেনি সরকার।
তারা বলছেন, এসব পরিবর্তন অর্থনীতিতে বিপর্যয়ের পাশাপাশি চাকরিক্ষেত্রে সংকট সৃষ্টি করতে পারে। এতে নষ্ট হতে পারে অস্ট্রেলিয়ার সুনাম। আর দেশীয় ও আন্তর্জাতিক শিক্ষার্থীরাও ক্ষতির মুখে পড়বেন।
অস্ট্রেলিয়ার শীর্ষস্থানীয় বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর প্রতিনিধিত্বকারী সংস্থা ‘গ্রুপ অব এইট’। এর উপপ্রধান নির্বাহী ম্যাথিউ ব্রাউনের মতে, “এটি (নীতিমালা) এমন এক বার্তা দেয় যে অস্ট্রেলিয়া আর অতিথিপরায়ণ দেশ নয়।”
শিক্ষা হলো অস্ট্রেলিয়ার চতুর্থ বৃহত্তম রপ্তানি খাত। খনিজ পণ্যগুলোর পরেই এর অবস্থান। আন্তর্জাতিক শিক্ষার্থীরা গড়ে অস্ট্রেলিয়ান শিক্ষার্থীদের চেয়ে প্রায় দ্বিগুণ ফি পরিশোধ করে। এই অর্থ দিয়ে দেশটির কিছু প্রতিষ্ঠানের আর্থিক স্থিতিশীলতা বজায় থাকে।
পাশাপাশি ওই অর্থ থেকেই দেশীয় শিক্ষার্থীদের ফি আংশিকভাবে বহন করা হয়। উদাহরণ হিসাবে বলা যায় ইউনিভার্সিটি অব সিডনির কথা, সেখানে আন্তর্জাতিক শিক্ষার্থীরা দেশটির মোট রাজস্বের ৪০ শতাংশেরও বেশি জোগান দেয়।
প্রধানমন্ত্রী অ্যান্থনি আলবানিজের সরকার রেকর্ড পরিমাণ অভিবাসন কমানোর চাপে রয়েছে। লক্ষ্য হলো আবাসনের চাপ কমানো ও জীবনযাত্রার ব্যয় সংকট লাঘব করা।
আগামী বছরের ফেডারেল নির্বাচনের আগে তাই এমন পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে। এ অবস্থায় গত সেমিস্টারের ৭ লাখ ৯৩ হাজার ৩৩৫ জন আন্তর্জাতিক শিক্ষার্থী প্রস্তাবিত আইনের লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হয়েছে।
অস্ট্রেলিয়ার সরকার ২০২৫ সালে নতুন বিদেশি শিক্ষার্থী ভর্তি সীমা ২ লাখ ৭০ হাজারে রাখার প্রস্তাব দিয়েছে। তারা বলছে, এটি কোভিড মহামারির আগে যেমন ছিল তেমনি হবে। তবে আগের বছরের তথ্য প্রকাশযোগ্য নয় বলে সঠিক তুলনা করা যাচ্ছে না বলে জানিয়েছেন একজন শিক্ষাবিদ।
শিক্ষামন্ত্রী জেসন ক্লেয়ার বলেছেন, প্রতিটি উচ্চ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে বিদেশি শিক্ষার্থী ভর্তির একটি নির্দিষ্ট সীমা দেওয়া হবে। সবচেয়ে বড় কাটছাঁট হবে ভকেশনাল শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ প্রতিষ্ঠানগুলোতে। রাজধানীর বিশ্ববিদ্যালয়গুলো সবচেয়ে বেশি িশক্ষার্থী হ্রাসের সম্মুখীন হবে।
আন্তর্জাতিক শিক্ষার্থীরা যাতে অস্ট্রেলিয়ার বড় শহরের বদলে আঞ্চলিক শহরের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে পড়তে যায়, তাই এমন নীতিমালা প্রনয়নের পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে বলে জানিয়েছে দেশটির সরকার।
সরকার আরও জানিয়েছে, এই পরিবর্তনগুলো শিক্ষার্থীদের ‘অনৈতিক’ প্রতিষ্ঠান থেকে রক্ষার উদ্দেশ্যে করা হয়েছে। তাদের অভিযোগ, কিছু প্রতিষ্ঠান এমন শিক্ষার্থীদের ভর্তি করে, যাদের ভাষা দক্ষতা বা একাডেমিক মান পর্যাপ্ত নয় এবং যারা পড়াশোনা না করে কাজ করতে চায়।
শিক্ষামন্ত্রী ক্লেয়ার বলেন, “আন্তর্জাতিক শিক্ষা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এই সংস্কারগুলো তা আরও ভালো ও ন্যায্য করতে এবং ভবিষ্যতে এটি আরও টেকসই করার উদ্দেশ্য নিয়ে করা হচ্ছে।”
অস্ট্রেলিয়ার দক্ষ অভিবাসন নীতির রূপকার সাবেক সরকারি কর্মকর্তা আবুল রিজভি বলেছেন, “অপর্যাপ্ত তহবিলের কারণে এই খাত দীর্ঘদিন ধরে বিদেশি শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে টিউশন ফি সংগ্রহের চেষ্টা করছে। ফলে শিক্ষার মানের ক্ষতি হচ্ছে।”
প্রতিষ্ঠানগুলো ভাবছে, তারা কি আন্তর্জাতিক শিক্ষার্থী আয় থেকে খুব বেশি নির্ভরশীল হয়ে পড়েছে এবং এর সমাধান কীভাবে সম্ভব?
এনিয়ে গ্রুপ অব এইটের কর্মকর্তা ব্রাউন বলেন, “এটি এমন একটি আলোচনা, যা প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয় করছে।”
তবে বিদেশি শিক্ষার্থীদের সংখ্যা কমানোর পরিকল্পনা নিয়ে এই খাত সংশ্লিষ্টরা তীব্র প্রতিবাদ জানিয়েছে।
গ্রুপ অব এইট প্রস্তাবিত আইনকে ‘অতিরিক্ত কঠোর’ বলে অভিহিত করেছে। আর অন্যরা অর্থনীতিকে ‘ইচ্ছাকৃতভাবে’ দুর্বল করার এবং আন্তর্জাতিক শিক্ষার্থীদের ‘ভোটাভুটির মাধ্যমে অভিবাসন সংক্রান্ত যুদ্ধের শিকার’ করার অভিযোগ তুলেছে সরকারের বিরুদ্ধে।
বিদেশি শিক্ষার্থীদের ভর্তির সীমা কতদিন পর্যন্ত কার্যকর থাকবে, তা এখনও জানায়নি অস্ট্রেলিয়ার সরকার।
তবে ব্রাউনের মতে, গ্রুপ অব এইটের হিসাব অনুযায়ী, প্রথম বছরে তাদের সদস্যদের ওপর ১ বিলিয়ন অস্ট্রেলিয়ান ডলারের প্রভাব পড়বে। তাদের গবেষণায় জানা গেছে, বৃহত্তর অর্থনীতিতে এই ক্ষতির পরিমাণ ৫ দশমিক ৩ বিলিয়ন ডলার। এতে ২০ হাজারের বেশি মানুষ চাকরি হারাতে পারে।
অস্ট্রেলিয়ার ট্রেজারি বিভাগ বলেছে, তাদের গ্রুপ অব এইটের পূর্বাভাসের প্রতি সন্দেহ রয়েছে। তবে পরিবর্তনের অর্থনৈতিক প্রভাব নিয়ে তারা নিজে কোনও হিসাব বা মডেল প্রকাশ করেনি।
ব্রাউন সতর্ক করেছেন যে, ভর্তির সীমা কিছু বিশ্ববিদ্যালয়কে ইতোমধ্যে বিদেশি শিক্ষার্থীদের দেওয়া প্রস্তাব বাতিল করতে বাধ্য করতে পারে। এতে গুরুত্বপূর্ণ গবেষণা প্রোগ্রাম বন্ধ হয়ে যেতে পারে এবং কিছু অস্ট্রেলিয়ান শিক্ষার্থীর জন্য ফি বাড়তে পারে।
ভর্তির সীমা কিছু বিশ্ববিদ্যালয়কে এরইমধ্যে বিদেশি শিক্ষার্থীদের দেওয়া প্রস্তাব বাতিল করতে বাধ্য করতে পারে। এতে গুরুত্বপূর্ণ গবেষণা প্রোগ্রাম বন্ধ হওয়ার এবং কিছু অস্ট্রেলিয়ান শিক্ষার্থীর শিক্ষা ফি বাড়তে পারে।
তবে কিছু ছোট বিশ্ববিদ্যালয় যারা ভর্তির সীমার সুবিধা পাবে, তারা এই খবরকে স্বাগত জানিয়েছে।
লা ট্রোব ইউনিভার্সিটির ভাইস-চ্যান্সেলর থিও ফারেল জানান, তারা অস্ট্রেলিয়ায় আন্তর্জাতিক শিক্ষার্থী বৃদ্ধির বিষয়টি পরিচালনার জন্য ‘স্বচ্ছ ও সুষম ব্যবস্থা’ সমর্থন করেন।
তবে ব্রাউনের দাবি, এতে অস্ট্রেলিয়ার সুনামের ক্ষতি হচ্ছে। তিনি এক্ষেত্রে কানাডার বিষয়টি তুলে ধরেন। কানাডা এই বছর বিদেশি শিক্ষার্থী ভর্তি সীমা আরোপ করেছে। কিন্তু সেখানকার শিল্প সংগঠনগুলো বলছে, ভর্তি সংখ্যা সীমার নিচে নেমে গেছে। কারণ উদ্বিগ্ন শিক্ষার্থীরা এমন জায়গায় পড়াশোনা করতে চাইছে যেখানে অধিক নিশ্চয়তা রয়েছে।
সাবেক সরকারি কর্মকর্তা রিজভির মতে, অস্ট্রেলিয়ায় প্রস্তাবিত ভর্তির সীমা আরোপের বদলে সরকারের উচিৎ একটি সর্বনিম্ন বিশ্ববিদ্যালয় প্রবেশ পরীক্ষা স্কোর চালু করার কথা ভাবা।
তিনি সোশাল মিডিয়া এক্সে লেখেন, “আমরা নিজেদেরই ক্ষতি করছি। এটি নিম্নমানের শিক্ষার্থীদের নয়, উচ্চমানের শিক্ষার্থীদের বাধাগ্রস্ত করবে। কারণ তারা বিভিন্ন বিকল্পের সুবিধা পায়।”
এদিকে দেশটির পার্লামেন্টে গ্রিন পার্টি প্রস্তাবিত নীতিকে ‘বর্ণবাদী’ আখ্যায়িত করেছে। সরকারের একজন এমপি নিজেই এই নীতির সমালোচনা করেছেন।
অস্ট্রেলিয়ার লেবার পার্টির সদস্য ও এমপি জুলিয়ান হিল দ্য অস্ট্রেলিয়ান পত্রিকাকে বলেন, “একটি কঠোর সীমা অস্ট্রেলিয়ার মানবসম্পদ, প্রতিভা উন্নয়ন, একাডেমিক উৎকর্ষতা ও গবেষণার জন্য ক্ষতিকর হবে।”
তবে সমালোচনার পরেও এই সপ্তাহে পার্লামেন্টে বিরোধী দলের সমর্থনে আলোচিত সীমা আরোপের আইনটি পাস হতে পারে।
শিক্ষামন্ত্রী ক্লেয়ার স্বীকার করেছেন যে, কিছু সেবা প্রদানকারী প্রতিষ্ঠান বাজেট নিয়ে কঠিন সিদ্ধান্তের মুখোমুখি হতে পারে। তবে এই নীতি ‘আন্তর্জাতিক শিক্ষাকে ধ্বংস করছে’ তা সম্পূর্ণরূপে ভুল ও ভিত্তিহীন।
অস্ট্রেলিয়ায় সবচেয়ে বেশি চীন ও ভারতের শিক্ষার্থীরা পড়তে যায়। প্রস্তাবিত আইনের খবরে দেশ দুইটিতে এরই মধ্যে নেতিবাচক প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়েছে।
ভারতের অমৃতসরের অভিবাসন পরামর্শক রুপিন্দর সিং বলেন, “ভারতের শিক্ষার্থীদের জন্য এটি খুব কঠিন হবে। কারণ এদের অধিকাংশই মধ্যবিত্ত পরিবার থেকে আসে। তাদের বিদেশে শিক্ষার জন্য বছরের পর বছর পরিকল্পনা ও প্রস্তুতি থাকে। তাদের স্বপ্ন চূর্ণবিচূর্ণ হবে।”
মোনাশ ইউনিভার্সিটির শিক্ষার্থী বেদান্ত গাধাভি জানান, তার গুজরাটের কিছু বন্ধু, যারা মাস্টার্সের জন্য অস্ট্রেলিয়ায় আসার পরিকল্পনা করছিল, এখন আতঙ্কিত হয়ে পড়েছে।
চীনের আনহুই প্রদেশের শিক্ষার্থী জেনি অস্ট্রেলিয়ায় পড়ালেখার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। কারণ চীনের চেয়ে সেখানে শিক্ষাব্যবস্থা ভালো। তিনি অস্ট্রেলিয়ার আঞ্চলিক শহরগুলোর বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে যেতে চান না। কারণ প্রতিযোগিতামূলক বিশ্বে ওই বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর র্যাংকিং তুলনামূলক কম।
তথ্যসূত্র : বিবিসি