সোমবার দুপুর পৌনে ১২টা; মহাখালী রেলক্রসিংয়ের কাছাকাছি ছিল উপকূল এক্সপ্রেস। আর কয়েক মিনিট পরেই কমলাপুর স্টেশনে পৌঁছানোর কথা নোয়াখালী ছেড়ে আসা আন্তঃনগর ট্রেনটির। ফোরকান উদ্দিন এই ট্রেনে ছিলেন তার ১৯ মাস বয়সী মেয়ে জাইফা আর স্ত্রী জান্নাতুল ফেরদৌসকে নিয়ে।
ফোরকানের বাড়ি নোয়াখালীতে। একটি বেসরকারি কোম্পানিতে চাকরির জন্য সাক্ষাৎকার দিতে তার ঢাকায় আসা। রাজধানীতে সচরাচর আসা হয় না, তাই এই সুযোগে স্ত্রী-সন্তানকে নিয়ে এসেছিলেন। ভেবেছিলেন চিকিৎসক দেখাবেন তার স্ত্রীকে। কিন্তু তিনি নিজেও জানতেন না, কী অপেক্ষা করছে তার জন্য।
ট্রেনটি যখন মহাখালীতে, তার কিছুক্ষণ আগেই সরকারি তিতুমীর কলেজকে বিশ্ববিদ্যালয়ে রূপান্তরের দাবিতে রেলক্রসিং অবরোধ করে শিক্ষার্থীরা।
প্রত্যক্ষদর্শীরা জানায়, অবরোধের মধ্যেই ট্রেনটি মহাখালী রেলক্রসিংয়ের কাছাকাছি এলে বিক্ষোভরত শিক্ষার্থীরা প্রথমে ট্রেনটি থামিয়ে দিতে চেয়েছিল। কিন্তু ট্রেনটি না থেমে গতি কমিয়ে চলতে থাকলে সেটি লক্ষ্য করে ইট ছুড়তে থাকে শিক্ষার্থীরা।
সেই ঢিলে ট্রেনের জানালার কাচ ভেঙে যায়। আহত হন ফোরকান উদ্দিনের স্ত্রী এবং শিশু সন্তানটি। জান্নাতুলের মাথায় ১৪টি সেলাই লেগেছে বলে জানান ফোরকান।
তিনি সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “কী যে বলব ভাই, আসছিলাম ঢাকায় ইন্টারভিউ দিতে। এর মধ্যে কী যে হলো। আমার বউয়ের মাথায় ১৪টি সেলাই লেগেছে। আমার বাচ্চারও মাথায় ইট লেগেছে। আমি খুবই ভয় পেয়ে গেছি। আজকে এত বড় একটি বিপদ আমার উপর দিয়ে গেছে।”
ফোরকান কমলাপুর স্টেশনে নেমেই স্ত্রীকে নিয়ে যান কমলাপুর ইসলামী ব্যাংক হাসপাতালে। সেখানে স্ত্রী-সন্তানের চিকিৎসা করিয়ে চাকরির চিন্তা বাদ দিয়ে পুনরায় রওনা হন নোয়াখালীতে।
বিকালে তার সঙ্গে যখন কথা হয় তখন তিনি নোয়াখালীর পথে রয়েছেন জানিয়ে বলেন, “আমার তো ঢাকায় কেউ নাই, তাই চলে যাচ্ছি।”
শিক্ষার্থীদের ইটে ট্রেনটির কয়েকটি জানালার কাচ ভেঙে যায়। এ সময় ট্রেনের ছাদে কয়েকজনকে উঠে পড়েছিল বলে প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান।
ঘটনার সময় ট্রেনে থাকা আরেক যাত্রী নিয়ামুল হক মো. নাফিস ফেইসবুকে তার অভিজ্ঞতার কথা লিখেছেন।
“আমিও আজ এ ট্রেনে ছিলাম। আতঙ্কে সবাই চিৎকার করছিল, তাড়াহুড়োয় জানালা বন্ধ করতে গিয়ে আমার আঙুলটা কেটে গেল।”
ফোরকানও ফেইসবুকে লিখেন, “আল্লাহ তোমার কাছে বিচার রইলো। রাষ্ট্রের কাছে বিচার পাবো কি না জানি না।”
ফেইসবুকে উপকূল এক্সপ্রেসের পাতায়ও দেখা যায় বিভিন্নজনকে এই ঘটনায় ক্ষোভ জানাতে। এমনই একজন মোহাম্মদ আবিদুর রহমান ফেইসবুকে লেখেন, “তিতুমীর কলেজের স্টুডেন্টদের আক্রমণে নোয়াখালীর উপকূল এক্সপ্রেস – Upakul Express ট্রেইনের চিত্র! কী নির্মমতা! বাচ্চা পর্যন্ত রেহাই পায়নি। এতদিন লেখাপড়া করে এই শিক্ষা পেলেন? দাবি আদায়ে এরকম কাজ করতে হয়? আগে মানুষ হন, তারপর লেখাপড়া করেন। আপনাদের এই কর্মের জন্য বাকি স্টুডেন্টরাও লজ্জিত!”
অনেকেই দাবি আদায়ে রেলপথ অবরোধের যৌক্তিকতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। এদের মধ্যে ইমরান হাসান তন্ময় লেখেন, “আন্দোলন করলে সচিবালয় আছে, সেখানে না গিয়ে রেললাইনে কেন? রেলপথ মন্ত্রণালয় কি তাদের কলেজকে বিশ্ববিদ্যালয় বানাতে পারবে?”
একদিন আগেই জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে জনদুর্ভোগ হয়, এমন কোনও কর্মসূচি না দিতে সবার প্রতি আহ্বান রেখেছিলেন অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস। ‘
তিনি বলেছিলেন, “আমরা আপনাদের প্রতিটি দাবির প্রতি সহানুভূতিশীল। আমরা ধৈর্য সহকারে আপনাদের কথা শুনতে চাই।
“কিন্তু সেজন্য আপনারা সড়ক অবরোধ করে জনদুর্ভোগ সৃষ্টি করলে আমাদের সকলেরই অসুবিধা হয়। আমাদের একান্ত অনুরোধ আপনারা নির্দিষ্ট চ্যানেল মেইনটেইন করে আপনাদের দাবি দাওয়া পেশ করবেন।”
সেই আহ্বান উপেক্ষা করে অবরোধের পাশাপাশি উপকূল এক্সপ্রেসে যারা হামলা করেছে, তাদের বিচারের দাবিও উঠেছে ফেইসবুকে।
মো. সাইফ আলম নামে একজন লিখেছেন, “যারা ট্রেনের উপর আক্রমণ করে, তাদেরকে খুব শীঘ্রই আইনের আওতায় আনা হোক।”
তিতুমীরের শিক্ষার্থীদের দাবি, তারা রেলপথ অবরোধ করেছিলেন আগে থেকেই, ট্রেনটি বিক্ষোভরতদের ওপর দিয়ে যেতে চাইছিল। সেই কারণে বিক্ষুব্ধ হয়ে কেউ কেউ ইট ছুড়েছিল।
ঢাকার সরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান তিতুমীর কলেজের শিক্ষার্থীদের দাবি, তাদের প্রতিষ্ঠানকে পূর্ণাঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয়ে রূপান্তর করতে হবে।
সেই দাবিতে সোমবার বেলা ১১টার দিকে কলেজ থেকে মিছিল নিয়ে সড়ক অবরোধের পাশাপাশি রেলক্রসিং অবরোধ করে শিক্ষার্থীরা। তারা এই কর্মসূচির নাম দেয় ‘বারাসাত ব্যারিকেড টু মহাখালী’।
পাঁচ ঘণ্টা পর তারা অবরোধ তুলে নিলে ঢাকার ব্যস্ত এই এলাকায় গাড়ি চলাচল শুরু হয়। সেই সঙ্গে সারাদেশের সঙ্গে ঢাকার ট্রেন চলাচলের বাধাও কাটে।