Beta
মঙ্গলবার, ২৬ নভেম্বর, ২০২৪
Beta
মঙ্গলবার, ২৬ নভেম্বর, ২০২৪

ন্যাশনাল মেডিকেলে তাণ্ডব, ভাস্কর্য ভাংচুর

ন্যাশনাল মেডিকেলের মূল ফটকের সামনে অবস্থিত ভাস্কর্যটি ভেঙে ফেলা হচ্ছে। ছবি : জীবন আমীর
ন্যাশনাল মেডিকেলের মূল ফটকের সামনে অবস্থিত ভাস্কর্যটি ভেঙে ফেলা হচ্ছে। ছবি : জীবন আমীর
[publishpress_authors_box]

পুরান ঢাকার ন্যাশন্যাল মেডিকেল ইনস্টিটিউট হাসপাতালের সামনে ছিল একটি ভাস্কর্য। যেখানে তুলে ধরা হয়েছিল চিকিৎসক ও রোগীর চিরায়ত সম্পর্ক; অসুস্থ এক রোগীকে পরম মমতায় কোলে নেওয়া চিকিৎসকের প্রতিচ্ছবি।

হাসপাতালে চিকিৎসাধীন এক রোগীর ভুল চিকিৎসায় মৃত্যুর অভিযোগ ওঠার পর বিক্ষুব্ধ শিক্ষার্থীরা রবিবার সেই ভাস্কর্যটি ভাঙচুর করেছেন। ভাস্কর্যটির ভাঙা মাথায় কালি লাগিয়ে সেটি হাতে নিয়ে উল্লাসও করতে দেখা যায় কিছু শিক্ষার্থীকে। শিক্ষার্থীদের বিক্ষোভ আর হামলায় ন্যাশনাল মেডিকেল এলাকায় রীতিমতো তাণ্ডব সৃষ্টি হয়।

ঘটনার শুরু ১৮ নভেম্বর। অভিজিত হাওলাদার নামে ডেঙ্গু আক্রান্ত চিকিৎসাধীন এক রোগী সেদিন মারা যান। মৃত অভিজিত ছিলেন ড. মাহবুবুর রহমান মোল্লা কলেজের (ডিএমআরসি) উচ্চ মাধ্যমিক শ্রেণির শিক্ষার্থী।

অভিজিতের মৃত্যু ভুল চিকিৎসায় হয়েছে বলে অভিযোগ করেন তার সহপাঠীরা। তাদের অভিযোগ, অভিজিতের রক্তের প্লাটিলেট কমে গেলে ১৭ নভেম্বর ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিতে চেয়েছিল তার পরিবার। কিন্তু ন্যাশনাল মেডিকেল কর্তৃপক্ষ তাকে নিতে দেয়নি। এমনকি মৃত্যুর পর টাকার জন্য তার লাশ আটকে রাখারও অভিযোগ করেন সহপাঠীরা।

তাদের দাবি, ঘটনার তিনদিন পর বৃহস্পতিবার তারা প্রতিবাদ জানাতে গেলে কবি নজরুল কলেজ, সোহরাওয়ার্দী কলেজের শিক্ষার্থীসহ স্থানীয়রা তাদের ওপর হামলা চালায়। হামলা ও পুলিশের কাঁদানে গ্যাসে ছত্রভঙ্গ হয়ে তারা সেদিন চলে যান। সেদিন অনেকে আহতও হন।

এর জের ধরে, রবিবার সরকারি শহীদ সোহরাওয়ার্দী কলেজ ও ঢাকা ন্যাশনাল মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ঢুকে ব্যাপক ভাঙচুর চালায় ডিএমআরসিসহ বেশ কয়েকটি কলেজের শিক্ষার্থীরা। এসময় তারা বিক্ষোভও করে।

বেলা ১টা থেকে বিকাল ৫টা পর্যন্ত বিক্ষুব্ধ শিক্ষার্থীরা হাসপাতালের সামনে অবস্থান করে। এসময় পুরান ঢাকার জনসন রোডে যান চলাচল বন্ধ হয়ে যায়।

বিক্ষোভে অংশ নেওয়া কলেজগুলোর মধ্যে ডিএমআরসি কলেজ ছাড়াও রয়েছে ধানমণ্ডি আইডিয়াল কলেজ, ঢাকা কলেজ, সরকারি বিজ্ঞান কলেজ, গিয়াস উদ্দিন ইসলামিক মডেল কলেজ, সরকারি তোলারাম কলেজ, তেজগাঁও সরকারি কলেজ, দনিয়া কলেজ, বীরশ্রেষ্ঠ মুন্সি আব্দুর রউফ পবলিক কলেজ, সেন্ট গ্রেগরী স্কুল অ্যান্ড কলেজ, শামসুল হক খান স্কুল অ্যান্ড কলেজ, বীরশ্রষ্ঠ নূর মোহাম্মদ পাবলিক কলেজ, শেখ বোরহান উদ্দিন পোস্ট গ্রাজুয়েট ডিগ্রি কলেজ ও ক্যামব্রিয়ান স্কুল অ্যান্ড কলেজ। 

এসময় হাসপাতালের সামনে থাকা ভাস্কর্যটি ভাংচুর করে তারা। ভাস্কর্যের মুখে কালো কালি দিয়ে ক্রস চিহ্নও দিয়ে দেয়।

ভাস্কর্যের মাথা হাতে নিয়ে ছবি তোলার সময় সকাল সন্ধ্যার কথা হয় নারায়ণগঞ্জের তোলারাম কলেজের এক শিক্ষার্থীর সঙ্গে। তিনি বলেন, “ভাস্কর্যের মাথা হাতে নিয়ে ছবি তুলব। স্টুডেন্টদের মেরেছে। এটার প্রতিশোধ নিয়েছি।”

কবির হোসেন নামে এক নিরাপত্তা কর্মকর্তা বলেন, “গত ১৬ বছর ধরে আমি চাকরি করি। এমন ঘটনা আগে দেখিনি। ভাস্কর্যটাও ভেঙে ফেলেছে। কি তাণ্ডবটাই না চালিয়েছে! হাসপাতাল ও কলেজে ভেতরে ঢুকে হামলা চালিয়েছে।”

কোতোয়ালি থানার এসআই নাসির উদ্দিন সাংবাদিকদের জানান, এই ঘটনায় কয়েকজন আহতের খবর পাওয়া গেছে। তবে তাদের বিস্তারিত এখনও জানা যায়নি।

ন্যাশনাল মেডিকেল কলেজের চিকিৎসক রশিদুল হাসান বলেন, “অভিজিতের মৃত্যুর ঘটনাকে কেন্দ্র করে হাসপাতালে ব্যাপক ভাঙচুর চালিয়েছেন একদল শিক্ষার্থী। এতে হাসপাতালের স্বাভাবিক চিকিৎসা কার্যক্রমে ব্যহত হয়েছে। রোগীদের মধ্যেও আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছিল।”

সংঘর্ষে আহত এক শিক্ষার্থীকে সরিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন সহপাঠীরা। ছবি : জীবন আমীর
সংঘর্ষে আহত এক শিক্ষার্থীকে সরিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন সহপাঠীরা। ছবি : জীবন আমীর

তবে রোগীদের সুরক্ষা দিতে বিশেষ নিরাপত্তা ব্যবস্থা নিয়েছিল হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ।  

হাসপাতালটির এক চিকিৎসক বলেন, “মূলত শুক্রবার থেকে হাসপাতালে বিভিন্ন ধরনের লোকজন আসতে থাকেন। তারা চিকিৎসকদের সঙ্গে তর্ক-বিতর্ক জুড়ে দেন, হাসপাতালে এক ধরনের উত্তেজনা তৈরি করেন। সেদিন থেকেই দলবেঁধে বিভিন্ন মানুষকে আসতে দেখা যায়। এরপর আজ যা হলো, তা কীভাবে হলো সেটাই এখনও বুঝতে পারছি না।

“আমরা অনেক চেষ্টা করেছি বোঝানোর, কিন্তু কেউ কোনও কথা শোনেনি। দলে দলে শিক্ষার্থীরা এসেছে, ভাঙচুর করেছে। হাসপাতালেও যদি মব জাস্টিস এড়ানো না যায় তাহলে মানুষ কোথায় নিরাপদ?”

মৃত অভিজিত ডেঙ্গু শক সিনড্রোমে আক্রান্ত হয়েই হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিলেন বলে দাবি এই চিকিৎসকের। তিনি বলেন, তার অবস্থা আগে থেকেই খারাপ ছিল। তাকে আইসিইউতে চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছিল।

এ অবস্থায় তার মৃত্যুর পর সৃষ্ট ঘটনায় চিকিৎসকরা ভয় পাচ্ছেন বলে জানান তিনি।

সোহরাওয়ার্দী-নজরুল কলেজ জুড়েও হামলার চিহ্ন, পরীক্ষা স্থগিত

ন্যাশনাল মেডিকেলের পাশাপাশি পুরান ঢাকার কবি নজরুল সরকারি কলেজ ও শহীদ সোহরাওয়ার্দী কলেজও হামলার শিকার হয়েছে।

রবিবার হামলার পর কলেজ দুটি অনেকটা ধ্বংসস্তুপে পরিণত হয়।

হামলার কারণে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত সাত কলেজের স্নাতক পরীক্ষায় অংশ নেওয়া শিক্ষার্থীরা পুরো পরীক্ষা শেষ করতে পারেননি।

প্রত্যক্ষদর্শীরা জানিয়েছেন, দুপুরে টানা দেড় ঘণ্টা ধরে চলে হামলা ও লুটপাট। দুপুর দেড়টা থেকে ৩টা পর্যন্ত কলেজ দুটির দরজা-জানালার কাঁচ, আসবাবপত্র, ব্যক্তিগত গাড়ি ও অ্যাম্বুলেন্স ভাঙচুর করা হয়। নষ্ট করে দেওয়া হয় বই-খাতা-কাগজপত্র।

কলেজদুটির ভেতরে গিয়ে দেখা যায়, বিধ্বস্ত অবস্থায় পড়ে আছে সোহরাওয়ার্দী কলেজের শিক্ষকের ব্যক্তিগত গাড়ি, একটি অ্যাম্বুলেন্স, দুটি মোটরসাইকেল। প্রতিটি অফিসকক্ষেই ভাংচুরের চিহ্ন, লুট করা হয়েছে মালামালও।

তবে হামলা ও ভাংচুরের বিষয়ে কথা বলেননি কলেজদুটির দায়িত্বশীল কেউ।

ড. মাহবুবুর রহমান মোল্লা কলেজের শিক্ষার্থীদের অভিযোগ, প্রথম দিন তাদের ওপর হামলা চালিয়েছিল  সোহ্‌রাওয়ার্দী ও কাজী নজরুল কলেজসহ আশপাশের কয়েকটি কলেজের শিক্ষার্থীরা। যার জের ধরে রবিবার এ কলেজদুটিতেও হামলা চালানো হয়।

পাল্টাপাল্টি ধাওয়ায় বেশ কয়েকজন আহত হওয়ার খবর পাওয়া গেছে।

মামুন নামে এক শিক্ষার্থী অভিযোগ করে বলেন, সোহরাওয়ার্দী কলেজ ও কবি নজরুল কলেজে অনার্স প্রথম বর্ষের পরীক্ষা চলাকালীন ক্যাম্পাসে ডিএমআরসি, ঢাকা সিটি কলেজ, ধানমণ্ডি আইডিয়াল কলেজ, দনিয়া কলেজসহ কয়েকটি কলেজের শিক্ষার্থীরা হামলা-ভাঙচুর চালায়।

যদিও যে অভিযোগে এই পাল্টা হামলা তা অস্বীকার করেছেন সোহরাওয়ার্দী ও নজরুল কলেজের শিক্ষার্থীরা।

সোহরাওয়ার্দী কলেজের অধ্যক্ষ ড. কাকলী মুখোপাধ্যায় প্রশাসনের দিকে অসহযোগিতার অভিযোগ তোলেন। সেইসঙ্গে প্রতিষ্ঠান ও শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তা দিতে না পারায় দুঃখও প্রকাশ করেন।

সকাল সন্ধ্যাকে তিনি বলেন, “হঠাৎ করেই কয়েক’শ শিক্ষার্থী এসে হামলা করে। কলেজের প্রায় ১৭ টি বিভাগে হামলা করে তারা। বিভাগের অফিসরুমগুলো থেকে তারা কম্পিউটারসহ অন্যান্য জিনিস ভাংচুর ও লুটপাট করে। এসময় প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থীদের পরীক্ষা চলছিল, বাধ্য হয়ে পরীক্ষা স্থগিত করতে হয়েছে।

“তবে ঠিক কী কারণে এই হামলা চালানো হয়েছে তা আমি জানি না।”

কলেজের কোনও অফিস এবং বিভাগের কক্ষই অক্ষত নেই জানিয়ে তিনি বলেন, “পুরো কলেজ এখন ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে। দুজন শিক্ষকের ব্যক্তিগত গাড়ি এবং কলেজের একটি মাইক্রোবাসও ভেঙে তছনছ করে দেওয়া হয়েছে।”

আরও পড়ুন

সর্বশেষ

ad

সর্বাধিক পঠিত