দেশের প্রতিটি পরিবারের আর্থিক সঙ্গতি বাড়াতে, দারিদ্র্যের হার কমাতে এবং অভ্যন্তরীণ চাহিদা ও উৎপাদন গতিশীল করতে সর্বজনীন ন্যূনতম আয় প্রস্তাব করেছে বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি)।
রবিবার রাজধানী ঢাকার লেকশোর হোটেলে ‘সর্বজনীন ন্যূনতম আয়ের (ইউবিআই) কার্যকারিতা মূল্যায়ন’ শীর্ষক সংলাপে এ প্রস্তাব করে প্রতিষ্ঠানটি।
সিপিডির প্রস্তাবে বলা হয়েছে, দারিদ্র্যপীড়িত, স্বল্প আয় ও আয়বিহীন পরিবারকে মাসিক চার হাজার ৫৪০ টাকা নগদ অর্থ বিতরণ কার্যক্রম হাতে নিতে পারে সরকার। এতে দারিদ্র্য ৬ শতাংশের বেশি কমে আসবে।
সংলাপে ইউবিআইয়ের কার্যকারিতা নিয়ে গবেষণা প্রতিবেদন উপস্থাপন করেন সিপিডির জ্যেষ্ঠ গবেষক ড. তৌফিকুল ইসলাম খান।
তিনি জানান, জাতীয় পর্যায়ে এই প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে এক কোটি ৪৭ লাখ ২৫ হাজার পরিবারের জন্য ৮০ হাজার ২১৯ কোটি ৬০ লাখ টাকা দরকার হবে। এই অর্থ চলতি মূল্যে মোট জাতীয় উৎপাদন বা জিডিপির ১ দশমিক ৩৫ শতাংশ অর্থের সমান। এর ফলে দারিদ্র্য কমবে জাতীয় পর্যায়ে ৬ দশমিক ১৩ শতাংশ, দারিদ্র্যপীড়িত ৩৬ জেলায় ৩ দশমিক ৭২ শতাংশ, জলবায়ুর প্রভাবজনিত ৩৪ জেলায় ৩ দশমিক ০৭ শতাংশ এবং অতিদারিদ্র্যপীড়িত ১১ জেলায় ১ দশমিক ৪৬ শতাংশ।
অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন সিপিডির সম্মাননীয় ফেলো নতুন সরকারের অর্থনৈতিক পরিস্থিতির শ্বেতপত্র প্রণয়ন কমিটির প্রধান ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য। অনুষ্ঠানে বক্তব্য রাখেন সিপিডির ট্রাস্টি বোর্ড চেয়ারম্যান অধ্যাপক রেহমান সোবহান, বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সাবেক মন্ত্রী আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী ও সিপিডির বিশেষ ফেলো অধ্যাপক মোস্তাফিজুর রহমান।
বক্তারা বলেন, গত ৫ আগস্ট পরিবর্তনের মূল চেতনা ছিল দেশে বৈষম্যমুক্ত একটি কল্যাণমূলক সমাজব্যবস্থা গড়ে তোলা। এখন আয়বৈষম্য কমানোর সময় এসেছে। তাই সর্বজনীন ন্যূনতম আয় একটি সময়োপযোগী প্রস্তাবনা। অন্তর্বর্তী সরকারের নীতি নির্ধারকরা এটি আগামী অর্থবছর থেকে বাস্তবায়ন করতে চাইলে আসছে জানুয়ারি থেকেই কাজ শুরু করতে পারেন।
বিগত সরকারের সামাজিক নিরাপত্তা বাবদ বিপুল অর্থব্যয় ‘ত্রুটিপূর্ণ ছিল’ বলে সমালোচনা করেন বক্তারা।
দেবপ্রিয় ভট্টচার্য বলেন, “আমাদের দারিদ্র্য কমেছে। কিন্তু বৈষম্য বেড়েছে। দারিদ্র্য এমন অবস্থায় আছে যদি হঠাৎ করে একটা অভিঘাত আসে, তাহলে দেখা যাবে অনেক মানুষ আবার দরিদ্র হয়ে যাবে। সামাজিক নিরাপত্তায় অনেক দুর্বলতা আছে। ভাতা অনেকেই পায় না। আবার দীর্ঘদিন ধরে ভাতার পরিমাণ না বাড়ায় এর কার্যকারিতা হারায়। আমাদের আর্থিক সক্ষমতা খুব একটা ভালো না। ট্যাক্স জিডিপি রেশিও অনেক কম।”
আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী বলেন, অর্থ পাচার ও দুর্নীতি মোকাবিলা এখন প্রধান সমস্যা। এ সমস্যা আদৌ নিয়ন্ত্রণ বা কমানো সম্ভব কি না- এ নিয়ে অনেক সংশয় রয়েছে। তবে রাজনৈতিক বন্দোবস্ত থাকলে এ ধরনের কার্যক্রম চালানো সম্ভব।
তিনি বলেন, দুর্নীতির কারণে অর্থের অপচয় বন্ধ করতে পারলে রিসোর্সের কোনও সমস্যা হবে না। মানুষকে সেবা দিলে কর আদায় অনেক সহজ হয়ে যায়।
বিএনপির এই নেতা আরও বলেন, “স্বৈরাচার সরকার পতনের পর বাংলাদেশের মানুষের মনোজগতে বড় পরিবর্তন এসেছে। যেসব রাজনৈতিক দল বা নেতা এ পরিবর্তন বুঝতে পারবেন না, তাদের কোনও ভবিষ্যৎ নেই। ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ড বিবেচনায় বিএনপি সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেবে শিক্ষা এবং স্বাস্থ্য খাতের ওপর।
“আমরা ইউনিভার্সাল হেলথ কেয়ারের কথা বলেছি। এটা ইউকের মডেলে করা। বাংলাদেশের চিকিৎসার খরচ আফগানিস্তানের চেয়েও বেশি। এ মডেল বাস্তবায়ন হলে মানুষের খরচ অনেক কমে আসবে। আয় বৈষম্য কমে আসবে।”
চাকরিপ্রত্যাশীদের জন্য পড়াশোনা শেষে এক বছর পর্যন্ত রাষ্ট্র থেকে ভাতা দেওয়ার ব্যবস্থার বিষয়টি বিএনপির সংস্কার প্রস্তাবে রয়েছে আছে বলে জানান আমীর খসরু।
অনুষ্ঠানে ঢাকা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির (ডিসিসিআই) সাবেক সভাপতি রিজওয়ান রহমান বলেন, “ইউবিআই যেসব দেশে আছে সেখানে ট্যাক্স টু জিডিপি রেশিও অন্তত ১০ শতাংশের বেশি। বাংলাদেশে উন্নতি হওয়ার পর মাত্র ১ দশমিক ২ শতাংশ ট্যাক্স জিডিপি রেশিও বেড়েছে। এই রেশিও দিয়ে অর্থায়ন সম্ভব কিনা- সেটার পাশাপাশি অবকাঠামোগত চ্যালেঞ্জ তো আছেই।”
তিনি বলেন, “এটা যেহেতু প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর কাছে পৌঁছাবে, এখানে রাজনৈতিক দলগুলোর মতামত নেওয়া জরুরি। অন্তর্বর্তীকালীন সরকার এটার একটা রোডম্যাপ তৈরি করতে পারে।”
গণসংহতি আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়ক জোনায়েদ সাকি বলেন, ২৪ লাখ মানুষ কর দেন। অথচ এক কোটিরও বেশি মানুষের ক্রেডিট কার্ড আছে। বিরাট একটা অংশের মানুষ কর দিচ্ছেন না, এটা বিবেচনায় আনতে হবে।
তিনি বলেন, “পাচার ও দুর্নীতি মোকাবিলা করতে পারব কিনা- এটাই প্রধান সমস্যা। এটা মোকাবিলা করা গেলে ন্যূনতম মজুরিও বাস্তবায়ন করা সম্ভব।”