জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্ট দুর্নীতির মামলায় হাই কোর্টের রায়ে খালাস পেলেন বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া; যে মামলায় বিচারিক আদালতে তার সাত বছরের কারাদণ্ড হয়েছিল।
দুর্নীতির অভিযোগের এই মামলাটি দায়ের এবং রায় দুটোই হয়েছিল আওয়ামী লীগের শাসনামলে। রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের পর এখন আপিলে উল্টে গেল সাজার রায়।
বিএনপি অভিযোগ করে আসছিল, রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়াকে এই মামলায় সাজা দেওয়া হয়েছিল।
আওয়ামী লীগের শাসন অবসানের পর এখন আদালত থেকে ন্যায়বিচার পেয়েছেন, বুধবার রায়ের পর এই প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন বিএনপি চেয়ারপারসনের আইনজীবী কায়সার কামাল।
ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে গত ৫ আগস্ট শেখ হাসিনার সরকারের পতনের পরপরই খালেদা জিয়ার দণ্ড মওকুফ করেন রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিন। অবশ্য আওয়ামী লীগ সরকারই তাকে নির্বাহী আদেশে সাময়িক মুক্তি দিয়েছিল।
২০২০ সাল থেকে তিনি কয়েকটি শর্তে মুক্তি পেয়ে ঢাকার গুলশানে তার বাড়িতে ছিলেন; এখনও সেখানেই রয়েছেন, তবে পুরোপুরি মুক্ত অবস্থায়।
জিয়া চ্যারিটেবল (দাতব্য) ট্রাস্ট দুর্নীতির মামলায় আইনি ঝামেলা থেকে মুক্ত হলেও তার বিরুদ্ধে আরও কয়েকটি মামলা রয়েছে। এরমধ্যে জিয়া এতিমখানা মামলায় তার ১০ বছরের সাজার রায় হাই কোর্ট থেকেই রয়েছে।
এর মধ্যে বড়পুকুরিয়া কয়লাখনি দুর্নীতি মামলায় বুধবারই বিচারিক আদালত খালেদা জিয়াকে অব্যাহতি দিয়েছে।
দিনাজপুরের বড়পুকুরিয়া কয়লাখনির ঠিকাদার নিয়োগে অনিয়ম ও ১৫৮ কোটি ৭১ লাখ টাকা আত্মসাতের অভিযোগে এই মামলাটি হয়েছিল ২০০৮ সালে, তখন ক্ষমতায় ছিল সেনা নিয়ন্ত্রিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার।
চ্যারিটেবল ট্রাস্ট দুর্নীতির মামলায় অভিযোগ ছিল কী
দুস্থ ও অসহায়দের সহায়তার লক্ষ্যে নিজের স্বামী ও প্রয়াত রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের নামে দুটি ট্রাস্ট গঠন করেছিলেন খালেদা জিয়া। একটি চ্যারিটেবল ট্রাস্ট, আরেকটি অরফ্যানেজ ট্রাস্ট।
এই চ্যারিটেবল ট্রাস্টের নামে আসা প্রায় সোয়া ৩ কোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগে ২০১১ সালে দুর্নীতি দমন কমিশন খালেদা জিয়াসহ চারজনের বিরুদ্ধে মামলাটি করেছিল।
অন্য আসামিরা হলেন- খালেদা জিয়ার সাবেক রাজনৈতিক সচিব হারিছ চৌধুরী, ঢাকা সিটি কর্পোরেশনের সাবেক মেয়র সাদেক হোসেন খোকার একান্ত সচিব মনিরুল ইসলাম খান এবং হারিছ চৌধুরীর একান্ত সচিব জিয়াউল ইসলাম মুন্না।
দুর্নীতি দমন কমিশন অনুসন্ধানের ভিত্তিতে দাবি করেছিল, প্রধানমন্ত্রী থাকার সময় খালেদা জিয়া তার রাজনৈতিক প্রভাব খাটিয়ে জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্টের জন্য অর্থ সংগ্রহ করেন। বিভিন্ন উৎস থেকে টাকা সংগ্রহ করা হলেও সেটি দাতব্য কাজে খরচ করা হয়নি।
ট্রাস্টের তহবিলে প্রায় ৮ কোটি টাকা জমার তথ্য পেয়েছিল দুদক। এই অর্থের একটি অংশ বিএনপির পক্ষ থেকে দেওয়া হয়েছিল। বাকি ৩ কোটি ১৫ লাখ টাকার কোনও উৎস পাওয়া তদন্তকারীরা।
এক বছর অনুসন্ধানের পর ট্রাস্টের নামে অবৈধভাবে ৩ কোটি ১৫ লাখ টাকা লেনদেনের অভিযোগে মামলাটি করা হয়।
সেখানে অভিযোগ করা হয়, এই টাকা জোগাড়ে মূল ব্যক্তি ছিলেন হারিছ চৌধুরী। তিনি বর্তমানে মৃত বলে ধারণা করা হয়, যদিও তার মীমাংসা হয়নি।
হারিছ চৌধুরী অরথ জোগাড়ে তার একান্ত সচিব মুন্না ও সাদেক হোসেন খোকার এপিএস মনিরুলকে ব্যবহার করেন বলে অভিযোগ করা হয় মামলায়। ট্রাস্ট গঠনকারী হিসাবে মামলার প্রধান আসামি হন খালেদা জিয়া।
মামলা দায়েরের প্রায় দেড় বছর পর ২০১২ সালের জানুয়ারি মাসে দুদক অভিযোগপত্র দেয়। তার প্রায় ২৬ মাস পরে এ মামলার বিচার শুরু হয় ২০১৪ সালের মার্চ মাসে।
বিচারিক আদালতে রায় কী হয়েছিল?
এ মামলায় ২০১৮ সালের ২৯ অক্টোবর খালেদা জিয়াসহ চার আসামিকে সাত বছর করে সশ্রম কারাদণ্ড দিয়ে রায় ঘোষণা করে ঢাকার পঞ্চম বিশেষ জজ আদালত।
ঢাকার আলিয়া মাদ্রাসা প্রাঙ্গণে আদালতের অস্থায়ী এজলাসে হয়েছিল সেই রায়। বিএনপির আইনজীবীরা সেদিন আদালতে ছিলেন না।
রায়ে সাত বছরের কারাদণ্ডের পাশাপাশি ১০ লাখ টাকা জরিমানাও করা হয়েছিল।
ক্ষমতার অপব্যবহারসহ ১৫টি বিষয় বিবেচনায় নিয়ে এই মামলার রায় দেওয়ার কথা বলেছিলেন বিচারক। তিনি আরও বলেন, ক্ষমতার সর্বোচ্চ পদে থেকে এ ধরনের অপরাধ যেন কেউ আর না করে, সে জন্য কঠিন শাস্তি দেওয়া হলো।
আপিলের রায়ে কেন খালাস
২০১৮ সালের ১৪ নভেম্বর পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশের পর ১৯ নভেম্বর দণ্ডের বিরুদ্ধে হাই কোর্টে আপিল করেন খালেদা জিয়া।
তিন মাস আগে রাষ্ট্রপতি সাজা মওকুফের পরও খালেদা জিয়া আইনিভাবে মুক্ত হওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। গত ৩ নভেম্বর আপিল দ্রুত শুনানির জন্য খালেদা জিয়ার আইনজীবীরা আবেদন জানান।
এর পরিপ্রেক্ষিতে মামলাটি দ্রুত কার্যতালিকায় এনে শুনানির জন্য নিজ খরচে এ মামলার পেপারবুক প্রস্তুতের অনুমতি নেন তারা।
সেই আপিল মঞ্জুর করে বুধবার বিচারপতি এ কে এম আসাদুজ্জামান ও বিচারপতি সৈয়দ এনায়েত হোসেনের হাই কোর্ট বেঞ্চ আসামি খালেদা জিয়াকে খালাস দেন।
রায়ের পর খালেদা জিয়ার আইনজীবী জয়নুল আবেদীন বলেন, “আদালত আমাদের বক্তব্য শুনেছেন। দুদকের আইনজীবীকেও আদালত যথেষ্ট সুযোগ দিয়েছেন।
“আদালত বলেছেন, এ আপিলটি লাইন বাই লাইন পড়েছেন, দেখেছেন। আপিলের পক্ষে যে সাবমিশন তার আইনগত ভিত্তি রয়েছে, আদালত উল্লেখ করেছেন। আপলটি মঞ্জুর করেছেন আদালত। আপিল মঞ্জুর করে আসামিকে খালাস দিয়েছেন।”
এরমধ্য দিয়ে ন্যায়বিচার পেয়েছেন মন্তব্য করে তার আরেক আইনজীবী কায়সার কামাল বলেন, “আমরা সব সময় বলে এসেছি, দেশে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠিত হলে বেগম খালেদা জিয়া খালাস পাবেন।
“এ মামলাটি ছিল মূলত রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত একটি মামলা। এখানে কোনও আইনগত ভিত্তি ছিল না। শেখ হাসিনার নেতৃত্বে খালেদা জিয়াকে রাজনৈতিকভাবে হয়রানি করার জন্য এবং দলকে ক্ষতিগ্রস্ত করার জন্য অসৎ উদ্দেশ্য এ মামলাটি করা হয়েছিল।”
চ্যারিটেবল ট্রাস্ট মামলার রায়ের আগে ২০১৮ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি জিয়া অরফ্যানেজ ট্রাস্ট দুর্নীতির মামলায় পাঁচ বছরের সাজা দিয়ে কারাগারে পাঠানো হয়েছিল খালেদা জিয়াকে। ওই বছরের ৩০ অক্টোবর হাই কোর্টে এ মামলার আপিল শুনানি শেষে সাজা বেড়ে হয় ১০ বছর।
এরপর ২০১৯ সালের ২৮ জানুয়ারি হাই কোর্টের দেওয়া এ মামলার পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশ পেলে দণ্ডের বিরুদ্ধে আপিল বিভাগে আপিল করেন তিনি। এ মামলাটি এখন আপিল বিভাগে শুনানি চলছে।
২০১৯ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি থেকে পুরান ঢাকার নাজিমউদ্দিন সড়কের কারাগারে ছিলেন খালেদা জিয়া।
পরে দেশে করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাবের পর পরিবারের আবেদনে ২০২০ সালে আওয়ামী লীগ সরকার নির্বাহী আদেশে শর্ত সাপেক্ষে বিএনপি নেত্রী খালেদার দণ্ড ছয় মাসের জন্য স্থগিত করা হয়। ওই বছরের ২৫ মার্চ সাময়িক মুক্তি পেয়ে গুলশানের বাসা ফিরোজায় ফেরেন খালেদা।
এরপর থেকে প্রতি ছয় মাস পরপর মুক্তির মেয়াদ বাড়িয়ে আসছিল শেখ হাসিনার সরকার। প্রতিবারই দণ্ড স্থগিতের আদেশে তাকে বাসায় থেকে চিকিৎসা নিতে হবে এবং তিনি বিদেশ যেতে পারবেন না, এমন শর্ত দেওয়া হত।
৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার আন্দোলনে আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পর সেদিনের উদ্ভুত পরিস্থিতির মধ্যে বিএনপি, জামায়াতে ইসলামী, জাতীয় পার্টিসহ অন্যান্য রাজনৈতিক দলের ঊর্ধ্বতন নেতাদের নিয়ে সেনা প্রধান ওয়াকার-উজ-জামান বঙ্গভবনে রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিনের সঙ্গে এক সভা করেন। তখনই খবর আসে বিএনপির চেয়ারপারসর দুই মামলার দণ্ড থেকে মওকুফ পাচ্ছেন।
পরদিন ৬ আগস্ট রাষ্ট্রপতি সংবিধানের ৪৯ অনুচ্ছেদের ক্ষমতাবলে জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট দুর্নীতি ও জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্ট দুর্নীতির দুই মামলায় খালেদা জিয়ার দণ্ড মওকুফের বিষয়ে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সুরক্ষা সেবা বিভাগ প্রজ্ঞাপন হয়।
এ বিষয়ে দুদকের আইনজীবীদের কোনও প্রতিক্রিয়া পাওয়া যায়নি। এছাড়া হাইকোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রপক্ষ আপিলে যাবে কিনা তাও জানা যায়নি।
কয়লাখনি দুর্নীতি মামলায়ও অব্যাহতি
জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্ট দুর্নীতির মামলা থেকে খালাস পাওয়ার পাশাপাশি বড়পুকুরিয়া কয়লাখনি দুর্নীতি মামলা থেকেও অব্যাহতির পেয়েছেন খালেদা জিয়া।
তিনিসহ তিন জনকে অব্যাহতি দিয়ে বাকি চার আসামির বিরুদ্ধে চার্জগঠন করে বিচার শুরুর আদেশ দিয়েছেন ঢাকার বিশেষ জজ আদালত-৩ এর বিচারক মো. আবু তাহের।
খালেদা জিয়া ছাড়া অব্যাহতি পাওয়া বাকি দুজন হলেন সাবেক মন্ত্রী ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন ও আলতাফ হোসেন চৌধুরী।
যে চারজনের বিচার শুরু হয়েছে তারা হলেন, সাবেক জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ সচিব নজরুল ইসলাম, পেট্রোবাংলার সাবেক পরিচালক মঈনুল আহসান, হোসাফ গ্রুপের চেয়ারম্যান মোয়াজ্জেম হোসেন ও মো. সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী। তবে এদের মধ্যে সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী পলাতক, বাকি তিনজন শুনানিতে উপস্থিত ছিলেন।
আদালতে আসামিদের পক্ষে অব্যাহতি চেয়ে শুনানি করেন আইনজীবী মাসুদ আহমেদ তালুকদার, সৈয়দ জয়নুল আবেদীন মেজবাসহ অন্যরা। দুদকের পক্ষ থেকে চার্জগঠনের আবেদন করা হয়।
খালেদা জিয়ার আইনজীবী আব্দুল হান্নান ভূঁইয়া জানান, শুনানি শেষে বিচারক খালেদা জিয়াসহ তিন জনকে অব্যাহতি ও চার জনের বিরুদ্ধে চার্জগঠন করে বিচার শুরুর আদেশ দেন।
অসুস্থতার কারণে বুধবার শুনানিতে হাজির হতে পারেননি খালেদা জিয়া, তার পক্ষে হাজিরা দেন আইনজীবী।
এই মামলার আসামি তালিকায় নাম ছিল এমন নয় জন মারা যাওয়ায় তাদেরও অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে। এরা হলেন সাবেক মন্ত্রী এম সাইফুর রহমান, এম কে আনোয়ার, আব্দুল মান্নান ভূঁইয়া, মতিউর রহমান নিজামী, আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদ, এম শামসুল ইসলাম, এস আর ওসমানী, এ কে এম মোশাররফ হোসেন ও ব্যারিস্টার মো. আনিসুল হক।
আসামিদের মধ্যে জামায়াত নেতা মতিউর রহমান নিজামী ও আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদের মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় ফাঁসি কার্যকর হয়েছে। আরেক আসামি ব্যারিস্টার আমিনুল হক ২০১৯ সালের ২১ এপ্রিল মারা যান।
সাবেক কৃষিমন্ত্রী এম কে আনোয়ার ২০১৭ সালের ২৪ অক্টোবর, সাবেক তথ্যমন্ত্রী ও বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য এম শামসুল ইসলাম ২০১৮ সালের ২৬ এপ্রিল এবং সাবেক জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রী এ কে এম মোশারফ হোসেন ২০২০ সালের ১৭ অক্টোবর মারা যান।
২০০৮ সালের ২৬ ফেব্রুয়ারি খালেদা জিয়া ও তার মন্ত্রিসভার সদস্যসহ ১৬ জনের বিরুদ্ধে বড়পুকুরিয়া কয়লাখনি দুর্নীতি মামলা দায়ের করে দুদক। শাহবাগ থানায় মামলাটি করেন দুর্নীতি দমন কমিশনের তৎকালীন সহকারী পরিচালক মো. সামছুল আলম।
মামলায় দিনাজপুরের বড়পুকুরিয়া কয়লাখনির ঠিকাদার নিয়োগে অনিয়ম ও ১৫৮ কোটি ৭১ লাখ টাকা আত্মসাতের অভিযোগে আনা হয়েছিল।