বাংলাদেশ সম্মিলিত সনাতনী জাগরণ জোটের নেতা চিন্ময় কৃষ্ণ দাস ব্রহ্মচারীকে কারাগারে পাঠানোকে কেন্দ্র করে সৃষ্ট সংঘাতময় পরিস্থিতির মধ্যেই বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক কৃষ্ণভাবনামৃত সংঘ (ইসকন) সম্পর্কে সরকারের অবস্থান চানতে চেয়েছে হাই কোর্ট।
সম্প্রতি গণমাধ্যমে ইসকনের নানা কর্মকাণ্ড নিয়ে প্রকাশিত কয়েকটি প্রতিবেদন বুধবার বিচারপতি ফারাহ মাহবুব ও বিচারপতি দেবাশীষ রায় চৌধুরীর হাই কোর্ট বেঞ্চের নজরে আনেন সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী মো. মনির উদ্দিন। তিনি বাংলাদেশে সংগঠনটির কার্যক্রম নিষিদ্ধের জন্য আদালতের কাছে সুয়োমুটো আদেশ চান, রুল জারিরও আর্জি জানান।
এর পরিপ্রেক্ষিতে অ্যাটর্নি জেনারেল মো. আসাদুজ্জামানকে ডেকে পাঠান আদালত। পরে অ্যাটর্নি জেনারেলের বক্তব্য শুনে ইসকনের বিষয়ে সরকারের সিদ্ধান্ত বৃহস্পতিবার জানাতে নির্দেশ দেয়।
গত কয়েক মাস ধরেই আলোচনায় বাংলাদেশের ইসকন। এরমধ্যে চট্টগ্রাম পুণ্ডরীক ধামের অধ্যক্ষ চিন্ময় কৃষ্ণ ব্রহ্মচারীকে কারাগারে পাঠানোর আদেশ ঘিরে মঙ্গলবার উত্তপ্ত হয়ে ওঠে চট্টগ্রাম। আদালত প্রাঙ্গণে চিন্ময় কৃষ্ণকে বহনকারী প্রিজন ভ্যান তিন ঘণ্টা আটকে রাখেন তার সমর্থকরা। পরে তাদের ছত্রভঙ্গ করতে লাঠিপেটা করে পুলিশ, ছোড়ে কাঁদানে গ্যাসও।
এসময় পুলিশকে লক্ষ্য করে ইট-পাটকেল ছোড়ে চিন্ময় কৃষ্ণের অনুসারীরা। সংঘর্ষ ছড়িয়ে পড়ে আশপাশের এলাকাতেও। এক পর্যায়ে সবাই ছত্রভঙ্গ হয়ে গেলে উদ্ধার করা হয় আদালতের এপিপি সাইফুল ইসলাম আলিফের লাশ। এ ঘটনায় নতুন করে আলোচনায় আসে ইসকন।
ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে গত ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর হিন্দু সম্প্রদায়ের ওপর হামলার প্রতিবাদে চট্টগ্রামসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায় বিক্ষোভ কর্মসূচি পালন করা হয়েছে। যার নেতৃত্ব দিয়েছেন চিন্ময় কৃষ্ণ।
অ্যাটর্নি জেনারেল মো. আসাদুজ্জামান সাংবাদিকদের জানান, আইনজীবী মনির উদ্দিনের প্রার্থনার মূল প্রতিপাদ্য ছিল, ইসকনকে যাতে নিষিদ্ধ করা হয়। আইন-শৃঙ্খলাবাহিনীকে যাতে নির্দেশ দেওয়া হয়। সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে দোষীদের আইনের আওতায় আনা এবং আগামী দুই সপ্তাহ জরুরি অবস্থা ঘোষণার আর্জিও জানিয়েছেন তিনি।
রাষ্ট্রের প্রধান এই আইন কর্মকর্তা বলেন, “আমি আদালতে বলেছি, ইসকনের ইস্যুটি দুর্ভাগ্যজনক। যে আইনজীবী আদালতের নজরে এনেছেন তার হৃদয়ে রক্তক্ষরণ থেকে এনেছেন, এই রক্তক্ষরণ দেশের ১৮ কোটি মানুষেরও। এটা অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা, এটা একটি ক্রিমিনাল অফেন্স। সরকার গুরুত্বসহকারে এ ঘটানাটি দেখেছে। এটার যথাযথ আইনি পদক্ষেপ সরকার নেবে।”
বাংলাদেশে ইসকনের নিবন্ধন আছে কিনা, এই সংগঠন নিষিদ্ধ হবে কিনা, এ সংগঠনের বিরুদ্ধে কী ব্যবস্থা নেওয়া হবে, এ সংগঠনের অস্তিত্ব কী, এসব সংগঠনের বিষয়ে সরকারের পলিসি কী, সরকার সবকিছু খোঁজখবর নিয়ে যথাযথ আইনিভাবে দেখবে বলেও আদালতকে জানিয়েছেন অ্যাটর্নি জেনারেল।
এ মুহূর্তে রুল বা নির্দেশনা প্রয়োজন নেই উল্লেখ করে অ্যাটর্নি জেনারেল আদালতকে আরও বলেন, “আপনারা দেখেন, সরকার কী করছে, বিষয়টি কীভাবে হ্যান্ডেল হচ্ছে। পর্যালোচনা করে তারপর যদি প্রয়োজন হয় যথাযথ উপায়ে এলে এটা দেখা যেতে পারে।”
রাষ্ট্রপক্ষের বক্তব্যে শুনে ইসকন নিয়ে কতটুকু অগ্রগতি হয়েছে তা বৃহস্পতিবার আদালতকে জানানোর নির্দেশ দেন বিচারক।
গত ২৫ অক্টোবর চট্টগ্রামের লালদিঘী মাঠে সমাবেশ করেছিল সনাতন জাগরণ মঞ্চ। ওই সমাবেশের অন্যতম উদ্যোক্তা ছিলেন চিন্ময় ব্রহ্মচারী।
সমাবেশের দিন চট্টগ্রামের নিউ মার্কেট মোড়ে দেশের জাতীয় পতাকার ওপরে ইসকনের গেরুয়া রঙের পতাকা ওড়ানোর অভিযোগে রাজেশ চৌধুরী ও হৃদয় দাশ নামে দুই সনাতন ধর্মাবলম্বীকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। এর প্রতিবাদ জানিয়ে আসছিল সনাতন জাগরণ মঞ্চ।
এরপর গত ৩০ অক্টোবর চট্টগ্রাম নগরীর কোতোয়ালি থানায় চিন্ময় কৃষ্ণের নামে রাষ্ট্রদ্রোহ মামলা করেন চট্টগ্রাম শহরের মোহরা ওয়ার্ড বিএনপির সাধারণ সম্পাদক ফিরোজ খান। অবশ্য পরে তাকে পদচ্যুত করে বিএনপি।
ওই মামলায় সোমবার ঢাকা থেকে চিন্ময়কে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। এ খবর ছড়িয়ে পড়লে ওই দিনই চট্টগ্রামের চেরাগি পাহাড় মোড়ে বিক্ষোভ সমাবেশ করে সনাতন ধর্মাবলম্বীরা। ঢাকার শাহবাগ মোড়েও অবস্থান নেয় হিন্দু সম্প্রদায়ের লোকজন। সেখানে তাদের ওপর হামলার অভিযোগও ওঠে।
মঙ্গলবারের এই ঘটনার আগে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ইসকনবিরোধী এক পোস্টকে কেন্দ্র করে চট্টগ্রামে উত্তেজনা বাড়ে। গত ৫ নভেম্বর চট্টগ্রাম শহরের আন্দরকিল্লার হাজারী গলিতে যৌথ বাহিনীর সঙ্গে ইসকন সমর্থনদের সংঘর্ষ হয়।
যদিও এ ঘটনার সঙ্গে সম্পৃক্ততা অস্বীকার করেছিল ইসকন। এরপর সাংগঠনিক শৃঙ্খলা ভঙ্গের দায়ে চট্টগ্রামের পুণ্ডরীক ধামের অধ্যক্ষ চিন্ময় কৃষ্ণ দাস ব্রহ্মচারীকে যাবতীয় কার্যক্রম থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়।