কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাসম্পন্ন প্রোগ্রাম বা এআই- এর সঙ্গে প্রেম ও মানুষের জীবনযাপন নিয়ে সম্ভবত হলিউডের সিনেমা ‘হার’ (Her) বহু আগেই একটি সার্থক নমুনা উপস্থাপন করেছে। গুগলের সাবেক প্রধান নির্বাহী অফিসার (সিইও) এরিখ শ্মিটও প্রায় এক যুগ পরে নতুন করে একই সুরেই কথা বললেন।
‘হার’ সিনেমাটি ২০১৩ সালে মুক্তি পাওয়ার পরপরই আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়। স্পাইক জোনজ পরিচালিত এ সিনেমাটির কেন্দ্রিয় চরিত্র থিওডোর টুম্বলি নামের একজন নিঃসঙ্গ লেখক। একাকিত্ব কাটাতে থিওডোর একটি এআই এর সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে তোলেন। এআই- এর নারী কণ্ঠটি নিজেকে সামান্থা নামে পরিচয় দেয়। সামান্থার কণ্ঠ দিয়েছেন স্কারলেট জোহানসন এবং থিওডোরের চরিত্রে অভিনয় করেছেন জোয়াকিন ফিনিক্স।
সিনেমাটি মূলত ভালোবাসা, একাকিত্ব, এবং আধুনিক প্রযুক্তির প্রভাব সংক্রান্ত গভীর দিকগুলো তুলে নিয়ে আসে। থিওডোর এবং সামান্থার সম্পর্ক যতই গভীর হয়, ততই বোঝা যায় মানবিক আবেগের জটিলতা এবং প্রযুক্তির সঙ্গে প্রেমের সম্পর্কে জড়ানোর সীমাবদ্ধতা। এটি শুধু রোমান্স নয়; বরং মানসিক গভীরতা অনুসন্ধানের গল্পও বটে।
সিনেমাটি বিশ্বব্যাপী প্রায় ৪৮ মিলিয়ন ডলার আয় করে, যা একটি মধ্যম বাজেটের সিনেমার জন্য বেশ সফল। এছাড়া এটি অ্যাকাডেমি অ্যাওয়ার্ডে ‘বেস্ট অরিজিনাল স্ক্রিনপ্লে’ পুরস্কার জিতে নেয়।
মুভি রেটিং সাইট আইএমডিবি-তে এর রেটিং ৮.০, এবং এটি রটেন টমেটোসে ৯৫% সমালোচক স্কোর পেয়েছে।
কী বলেছেন গুগলের সাবেক সিইও
সম্প্রতি গুগলের সাবেক সিইিও এরিখ শ্মিট নিখুঁত কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার গার্লফেন্ড বা বয়ফ্রেন্ডের চলতি ট্রেন্ড নিয়ে এক পডকাস্টে নিজের শঙ্কার কথা জানান।
এআই গার্লফ্রেন্ডের প্রতি অতিরিক্ত প্রেমের অনুভূতি থেকে হতাশা তৈরি হওয়ায় ১৪ বছর বয়সী যুক্তরাষ্ট্রের এক কিশোর এবছরের শুরুতেই আত্মহননের পথ বেছে নেয়।
গুগলের সাবেক সিইও শ্মিট ওই ঘটনার প্রেক্ষিতে বলেন, “একবার ভাবুন তো এআই গার্লফ্রেন্ড বা বয়ফ্রেন্ড হচ্ছে নিখুঁত… দেখতেও নিখুঁত, আবেগ প্রকাশের দিক থেকেও নিখুঁত। একজন মানুষের মনকে এআই প্রেমিক-প্রেমিকা এমনভাবে আকর্ষণ করতে পারে যে, এটি তার চিন্তাধারায় প্রভাব বিস্তার করে। তার প্রতি মোহিত হওয়ার প্রবল মাত্রায় কোন ব্যক্তি মানসিকভাবে আটকে যেতে পারে। বিশেষ করে, যারা এখনও মানসিকভাবে পুরোপুরি পরিপক্ক নয়, তারা।”
এনওয়াইইউ স্টার্ন স্কুল অব বিজনেসের অধ্যাপক এবং উদ্যোক্তা স্কট গ্যালোওয়ে ওই পডকাস্টটি সঞ্চালনা করছিলেন।
৬৮ বছর বয়সী শ্মিটকে অধ্যাপক গ্যালোওয়ে প্রশ্ন করেন, “আপনি কি মনে করেন যে এআই প্রেমিক-প্রেমিকারা একাকিত্ব আরও বাড়াতে পারে এবং এটি বড় সামাজিক সমস্যা- যেমন চরমপন্থা এবং নারীবিদ্বেষের দিকে নিয়ে যেতে পারে?”
জবাবে এরিক শ্মিট বলেন, “একটা সময় পরে, কিশোর-কিশোরীরা অনলাইনে কী দেখছে তার হদিস পুরোটা রাখতে পারেন না বাবা-মা, নিয়ন্ত্রণ করতে পারেন না।”
“আপনি যদি ১২ বা ১৩ বছরের একজন শিশুকে এ ধরনের প্রযুক্তির সামনে বসান, তারা পৃথিবীর সব ভালো জিনিসের পাশাপাশি সব খারাপেরও প্রবেশাধিকার পেয়ে যায়। কিন্তু এই বয়সে এগুলো বোঝার জন্য তারা প্রস্তুত নয়।”
শ্মিট শঙ্কা প্রকাশ করে বলেন, এআই সম্পর্কিত প্রযুক্তি তরুণ প্রজন্মের ওপর গভীর প্রভাব ফেলতে পারে এবং এটি সমাজের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ চ্যালেঞ্জ হয়ে উঠতে পারে।
এআই গার্লফ্রেন্ড-বয়ফ্রেন্ড: এক নতুন ডিজিটাল ট্রেন্ড
ভার্চুয়াল সঙ্গীর ধারণাকে বাস্তবে রূপ দিতেই এআই-ভিত্তিক সফটওয়্যার বা অ্যাপ, যা মানুষের সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে তুলতে ডিজাইন করা হয়েছে।
এই এআই সঙ্গীরা একটি চ্যাটবটের মতো কাজ করে, যা ব্যবহারকারীর সঙ্গে আলাপচারিতা, আবেগপ্রকাশ এবং মানসিক সঙ্গ দেওয়ার ক্ষমতা রাখে। যেমন- রেপ্লিকা এআই এবং এআই কম্প্যানিয়ন অ্যাপস। এগুলো ব্যবহারকারীকে অনুভূতিশীল কথোপকথনের মাধ্যমে স্বস্তি ও আনন্দ দেয়। এসব অ্যাপ স্মার্টফোন বা কম্পিউটারে ডাউনলোড করে সহজেই সাবস্ক্রাইব করা যায়।
ট্রেন্ডের শুরু
ধারণার জন্ম অনেক আগেই। নইলে তো আর হলিউডে সিনেমা হত না! তবে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাকে নিজের প্রেমিক/প্রেমিকা বানানোর বাস্তবের যাত্রাটা শুরু হয় সম্ভবত ২০১৬ সালে, যখন রেপ্লিকা এআই- এর মতো অ্যাপ বাজারে আসে। তবে এটি ট্রেন্ডে পরিণত হতে থাকে ২০২০ সালের পর, যখন কোভিড অতিমারীর কারণে সামাজিক দূরত্ব বেড়ে যায় এবং একাকিত্ব মোকাবিলার উপায় হিসেবে ভার্চুয়াল সঙ্গী জনপ্রিয়তা লাভ করে।
কারা এআই-এর কাছে প্রেম খোঁজেন
এআই গার্লফ্রেন্ড-বয়ফ্রেন্ডের প্রধান ভোক্তারা হলেন একাকিত্ব ভোগা ব্যক্তি, বিশেষ করে তরুণ প্রজন্ম। এছাড়া কর্মব্যস্ত মানুষ, যারা সম্পর্কের চাপে না পড়ে মানসিক সঙ্গ চান, তারাও এই প্রযুক্তি ব্যবহার করেন।
সাবস্ক্রিপশন
রেপ্লিকা’র মতো অনেক অ্যাপ ফ্রিমিয়াম মডেলে কাজ করে। অর্থাৎ, বিনামূল্যে বেসিক সেবা পাওয়া গেলেও, প্রিমিয়াম ফিচারের জন্য মাসিক বা বাৎসরিক সাবস্ক্রিপশন ফি দিতে হয়। ভালো মানের (নাকি মনের!) এআই গার্লফ্রেন্ড বা বয়ফ্রেন্ড জোটাতে হলে অ্যাপসের সাবস্ক্রিপশন ফি গুণতে হয়। মাসিক সাবস্ক্রিপশনের গড় মূল্য ৫ থেকে ৩০ মার্কিন ডলার হতে পারে। এছাড়া নির্দিষ্ট ফি এর বিনিময়ে নানা ফিচার পাওয়া যায়। এর মধ্যে রয়েছে সঙ্গীর চেহারা নিজের ইচ্ছামত কাস্টমাইজ করা, ডেটিং-স্টাইল ইন্টারঅ্যাকশন এবং আরও অনেক কিছু।
বাজার এবং ব্যবহারকারীর তথ্য
২০২৩ সালে এআই গার্লফ্রেন্ড ও বয়ফ্রেন্ড অ্যাপসের বাজারের মূল্য ছিল ২৮০ কোটি ডলার। বাজার বিশ্লেষকরা বলছেন ২০২৮ সালের শেষ নাগাদ এই বাজার সাড়ে ৯০০ কোটি ডলারে গিয়ে ঠেকবে। ‘এআই গার্লফ্রেন্ড’ অনুসন্ধান গুগলে ২০২৩ সাল থেকে ২০২৪ সালে- এক বছরে ২৪০০ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে।
ক্যারেক্টার এআই ভার্চুয়াল কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাসম্পন্ন গার্লফ্রেন্ড এর প্ল্যাটফর্ম হিসেবে বেশ জনপ্রিয় হয়ে উঠছে। ২০২৪ সালের মার্চ মাসে এর সর্বাধিক মাসিক ভিজিট ৯ কোটি ৭০ লাখ ছিল। এআই গার্লফ্রেন্ড অ্যাপ নিয়ে বাজারে প্রচুর ডেটা থাকলেও বয়ফ্রেন্ড অ্যাপ নিয়ে অপ্রতুল।
মিডিয়াম অনলাইন পত্রিকার একটি প্রতিবেদন বলছে, এআই গার্লফ্রেন্ড অ্যাপ বয়ফ্রেন্ড অ্যাপের চেয়ে ডাউনলোডের পরিমাণ ৭ গুণ বেশি।
যুক্তরাষ্ট্র, জাপান এবং দক্ষিণ কোরিয়া। এশিয়া-প্যাসিফিক অঞ্চল এই ধরনের অ্যাপের ব্যবহার বৃদ্ধির ক্ষেত্রে সবচেয়ে এগিয়ে, যেখানে প্রযুক্তিগত উন্নয়ন এবং সাংস্কৃতিক বৈশিষ্ট্য একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে।
বিশ্বব্যাপী শীর্ষ দশটি দেশ যেখানে এই অ্যাপগুলোর ব্যবহার সবচেয়ে বেশি সেগুলো হলো- যুক্তরাষ্ট্র, জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া, ভারত, চীন, জার্মানি, যুক্তরাজ্য, কানাডা, অস্ট্রেলিয়া এবং ফ্রান্স।
এই তালিকা প্রমাণ করে, এশিয়া ও পশ্চিমা দেশগুলোতে ভার্চুয়াল সম্পর্ক নিয়ে আগ্রহ বেড়ে চলেছে, বিশেষ করে ব্যক্তিগতকরণের সুযোগ এবং মানসিক সহায়তার জন্য। অ্যাপগুলোর ব্যবহারকারীদের মধ্যে বেশিরভাগই তরুণ পুরুষ, যারা এই প্রযুক্তি ব্যবহার করে ভার্চুয়াল সঙ্গীর সঙ্গে সংযোগ স্থাপন করছেন।
কারা ব্যবহার করেন
১৩ থেকে ৩৯ বছর বয়সীদের মধ্যে এআই গার্লফ্রেন্ড ব্যবহারের প্রবণতা বাড়ছে। পরিসংখ্যান বলছে, এআই গার্লফ্রেন্ডের সঙ্গে প্রেম করছেন এমন ব্যবহারকারীদের গড় বয়স ২৭ বছর। জেন-জি মূলত এর ভোক্তা।
ইন্টারনেট ব্যবহারকারী ২৮ শতাংশ ১৮ থেকে ২৪ বয়সী পুরুষ স্বীকার করেছেন যে তাদের অন্তত একবার এআই গার্লফ্রেন্ড অ্যাপ বা চ্যাটবটের সঙ্গে যোগাযোগ হয়েছে। মজার ব্যাপার হলো, মোট গার্লফ্রেন্ড এআই ব্যবহারকারীর ১৮ শতাংশ নারী (কিংবা নারী হিসেবে) নিজেদের পরিচয় দেন।
প্রায় ৫৫ শতাংশ ব্যবহারকারী প্রতিদিন তাদের এআই গার্লফ্রেন্ডদের সঙ্গে যোগাযোগ করেন। প্রতি মাসে গড়ে এই গার্লফ্রেন্ডের পেছনে ব্যবহারকারীদের খরচ প্রায় ৪৭ ডলার!
কিছু সেরা গার্লফ্রেন্ড/বয়ফ্রেন্ড এআই প্ল্যাটফর্ম
ক্যারেক্টার এআই, জেনিটর এআই এবং ক্রাশঅন এআই হালের শীর্ষস্থানীয় এআই গার্লফ্রেন্ড প্ল্যাটফর্ম। এছাড়াও ব্যবহারকারীদের এআই গার্লফ্রেন্ড পছন্দের জায়গা হচ্ছে রেপ্লিকা, এআই সুইটহার্ট, রোমান্টিক এআই এবং লাভ এআই প্ল্যাটফর্ম ব্যবহারকারীর সংখ্যাও বাড়ছে দিনকেদিন।
সেরা বয়ফ্রেন্ড অ্যাপস এর মধ্যে রয়েছে চায় এআই, হর্নি কম্প্যানিয়ন, মাই এআই বয়ফ্রেন্ড, মাই লাভস ইত্যাদি।
ব্যবহারকারী যা বিবেচনা করেন
ব্যবহারকারীরা বিভিন্ন বৈশিষ্ট্য এবং প্রয়োজনীয়তার জন্য এআই গার্লফ্রেন্ড প্ল্যাটফর্ম অ্যাক্সেস করছেন। গবেষণা অনুসারে, এআই গার্লফ্রেন্ড অ্যাপগুলো অ্যাক্সেস করার জন্য ব্যবহারকারীদের মধ্যে সবচেয়ে মূল্যবান বৈশিষ্ট্যগুলির মধ্যে একটি হলো কলিং এর সুবিধা। এর গড়ে রেটিং ৫.৫৭। তারপরেই ব্যবহারকারীরা গোপনীয়তা ও সুরক্ষার কথা ভাবেন, যার রেটিং ৪.৯। তৃতীয়ত প্ল্যাটফর্মটি কতটা বাস্তব সেটির বিবেচনা করেন ব্যবহারকারীরা যার রেটিং ৩.২।
সবশেষ
ভারতে এআই ভিত্তিক ডেটিং এবং কম্প্যানিয়ন অ্যাপগুলোর ব্যবহার বৃদ্ধি পাচ্ছে। গ্লোবাল মার্কেট রিসার্চ অনুসারে, ভারতের তরুণ প্রজন্ম, বিশেষত মিলেনিয়াল এবং জেন-জি, এ ধরনের অ্যাপগুলোর মূল ব্যবহারকারী।
ভারতে এমন অ্যাপগুলোর মাসিক অ্যাক্টিভ ইউজার সংখ্যা ২০২৪ সালে প্রায় ১ কোটির কাছাকাছি বলে অনুমান করা হয়।
‘রেপ্লিকা’, ‘চায়’ এবং ‘রোমান্টিক এআই’- এর মতো অ্যাপগুলো ভারতে বেশ জনপ্রিয় এবং তরুণ প্রজন্মের মধ্যে সম্পর্ক এবং মানসিক সাপোর্টের জন্য বেশি ব্যবহৃত হচ্ছে।
বাংলাদেশে এআই ভিত্তিক ডেটিং বা কম্প্যানিয়ন অ্যাপের বাজার তুলনামূলক নতুন। তবে তরুণ প্রজন্মের মধ্যে এই অ্যাপগুলোর ব্যবহার দ্রুত বৃদ্ধি পাচ্ছে।
‘রেপ্লিকা’ এবং ‘এভা এআই’ বাংলাদেশে মূলত মানসিক স্বাস্থ্য সাপোর্ট এবং ভার্চুয়াল বন্ধুত্বের জন্য ব্যবহৃত হয়।