বিভাগের নাম নিয়ে উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদের ফেইসবুক পোস্ট উসকে দিল পুরনো আলোচনা। এক দল কুমিল্লা বিভাগের পক্ষে, আরেকদল নোয়াখালী বিভাগের পক্ষে মন্তব্য করে যাচ্ছে তার পোস্টে।
আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকাকালে কুমিল্লাকে বিভাগ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। তবে কুমিল্লা আর নোয়াখালীর পাল্টাপাল্টিতে নাম ঠিক হয়েছিল মেঘনা। অবশ্য সেই সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করে যেতে পারেনি তারা।
গত আগস্টে ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে শেখ হাসিনার সরকারের পতনের পর গঠিত অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের উপদেষ্টার পদে আসেন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতা আসিফ মাহমুদ।
বর্তমানে স্থানীয় সরকার উপদেষ্টার দায়িত্ব পালন করছেন কুমিল্লার সন্তান আসিফ। আওয়ামী লীগ আমলে এই মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী ছিলেন ওই জেলারই সংসদ সদস্য তাজুল ইসলাম।
শনিবার কুিমল্লার মুরাদনগরে উপজেলায় দুর্গা রাম (ডিআর) পাইলট সরকারি উচ্চ বিদ্যালয় মাঠে এক গণসংবর্ধনা অনুষ্ঠানে আসিফ মাহমুদ বলেন, “আমি স্পষ্ট ভাষায় বলতে চাই, বিভাগ হলে কুমিল্লা নামেই হবে। অতি দ্রুত সময়ের মধ্যে কুমিল্লা বিভাগ বাস্তবায়নের জন্য সরকারের সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারকদের সঙ্গে আমি কথা বলব।”
কুমিল্লা নামে বিভাগে শেখ হাসিনার আপত্তির কথা তুলে ধরেই এই কথা বলেন আসিফ।
‘কুমিল্লা vs নোয়াখালী’
মুরাদনগরের সমাবেশের পরপরই আসিফ মাহমুদের ফেইসবুক পেইজে একটি পোস্ট দেওয়া হয়; তাতে ফটোকার্ডের সঙ্গে ক্যাপশনে লেখা হয়- “বিভাগ হলে ‘কুমিল্লা’ নামেই হবে।”
তার দুই ঘণ্টা পর রিল আকারে একটি ভিডিও পোস্ট করা হয়। সেখানে আসিফ মাহমুদ কুমিল্লা নামে বিভাগের কথা বলছিলেন।
তার ভিডিওতে চার ঘণ্টায় লাইক পড়ে ১৭ হাজারটি, মন্তব্য আসে ৫ শতাধিক, শেয়ার হয় ৫২০ বার।
অন্যদিকে সেই ফটোকার্ডে ৬ ঘণ্টায় ২৬ হাজার রিঅ্যাকশন আসে। এটি শেয়ার হয় ৮৯৩ বার। এর নিচে মন্তব্য জমা পড়ে ১৮শটি।
সেই মন্তব্যের ঘরে কেউ আসিফকে ধন্যবাদ জানিয়েছিলেন কুমিল্লা নামে বিভাগের জন্য। আরেকদল নোয়াখালী নামে বিভাগের পক্ষে দাবি তোলে।
কুমিল্লার পক্ষে অবস্থান নিয়ে অনেকে আসিফকে ধন্যবাদ জানান। ফরহাদ খান নামে একজন লেখেন- “কুমিল্লাবাসীর দাবি একটাই কুমিল্লার নামে বিভাগ চাই … যেটা আপনার দ্বারা সম্ভব।” রোকেয়া মনি নামে একজন লিখেছেন- “আলহামদুলিল্লাহ, শুনে খুব ভালো লাগছে।” মোস্তফা আরাফাত নামে আরেকজন লিখেছেন- “কুমিল্লা নামেই বিভাগ হোক, ধন্যবাদ মাননীয় উপদেষ্টা আমাদের মুরাদনগরের কৃতি সন্তান আসিফ মাহমুদ সজিব ভূঁইয়া।”
তার সেই পোস্টেই আবির হাসান তালুকদার নামে একজন লেখেন- “এখন নোয়াখালীর লোকেরা চেতাই উঠবে.. আমরা চট্টগ্রাম মানুষেরা নিরব দর্শক। কুমিল্লা vs নোয়াখালী।”
তার ওই মন্তব্যের আগেই নোয়াখালী বিভাগের পক্ষে মন্তব্য আসতে থাকে।
নাসির সাদেক নাম একজন লেখেন- “ভাই, বিভাগ তো হওয়ার কথা ছিল নোয়াখালী।” আকলিমা খাতুন নামে আরেকজন লেখেন- “নোয়াখালী কি ভাইসা আসছে?” শরীফুল্লাহ নামে আরেকজন লেখেন- “কুমিল্লা বিভাগ হলে নোয়াখালীও বিভাগ হতে হবে।”
তার জবাবে কুমিল্লার পক্ষে একজন আবার লেখেন, বিভাগ হতে হলে সিটি করপোরেশন লাগে শিক্ষাবোর্ড লাগে, এসব কি নোয়াখালীতে আছে? আর রাজধানীতে যেতে কুমিল্লা হয়ে যেতে হয়। নোয়াখালী হয়ে যেতে হয় না।
এদিকে কুমিল্লার আসিফ মাহমুদের বক্তব্য শুনে বৃহত্তর নোয়াখালীর লক্ষ্মীপুরের সন্তান উপদেষ্টা মাহফুজ আলমকে ইঙ্গিত করে একজন লিখেছেন- “মাহফুজ আলম এখন কোথায়?”
এসব দেখে ইলিয়াস জাবেদ নামে একজন লেখেন- “বিভাগ যদি হয় তবে নোয়াখালী হবে, না হয় যেভাবেই আছে সেভাবেই থাক। লাড়ালাড়ি করার দরকার নাই।”
এই বিতর্কের শুরু কোথায়
বাংলাদেশের আঞ্চলিকতা প্রশ্নে কুমিল্লা, নোয়াখালী বরাবরই থাকে আলোচনায়। কুমিল্লা বিভাগের দাবি ওঠার পর নোয়াখালী বিভাগের দাবিও উঠতে থাকে। জনপ্রশাসনে এই দুই জেলার কর্মকর্তাদের প্রভাব রয়েছে দীর্ঘকাল ধরে।
কুমিল্লা ও নোয়াখালী দুটি জেলাই এখন চট্টগ্রাম বিভাগের অন্তর্গত। শিক্ষা বোর্ড এক সময় ছিল কুমিল্লায়, পরে চট্টগ্রাম শিক্ষা বোর্ড হয়। কুমিল্লা বোর্ডে এখন রয়েছে কুমিল্লা, নোয়াখালী, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, চাঁদপুর, লক্ষ্মীপুর ও ফেনী জেলা।
ভৌগলিক অবস্থানসহ বিভিন্ন কারণে গুরুত্বপূর্ণ জেলা কুমিল্লাকে বিভাগে উত্তরণের দাবি অনেক আগের। গত শতকের ৮০ এর দশকে এজন্য গঠন করা হয় কুমিল্লা বিভাগ বাস্তবায়ন পরিষদ। তার আহ্বায়ক ছিলেন আ ক ম বাহাউদ্দিন বাহার। আওয়ামী লীগের সাবেক এই সংসদ সদস্য গত আগস্টে সরকার পতনের পর বিদেশে পালিয়ে আছেন।
কয়েক বছর আগে আওয়ামী লীগের শাসনকালে কুমিল্লাকে বিভাগ করার সিদ্ধান্ত হলে নোয়াখালীও বিভাগের দাবি তোলে। নোয়াখালী বিভাগ বাস্তবায়ন পরিষদও সক্রিয় হয়ে ওঠে তখন।
প্রস্তাবিত কুমিল্লা বিভাগ বাস্তবায়ন হলে নোয়াখালী, ফেনী, লক্ষ্মীপুরকে কুমিল্লা বিভাগের অন্তর্ভুক্ত হতে হতো। তা নিয়ে আপত্তি তুলে এই তিন জেলার বাসিন্দারা আলাদা বিভাগের দাবি জোরেশোরে তোলে।
কুমিল্লা নামে বিভাগ নিয়ে ওই জেলার সন্তান, আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরও চাপে পড়েন। ফলে বিভাগের নামটি অনেকদিন ধরে ঝুলতে থাকে।
কুমিল্লার বদলে বিভাগের নাম ‘ময়নামতি’ দেওয়ার প্রস্তাবও আসে, তানিয়ে কুমিল্লাবাসী আবার আপত্তি তোলে।
এক পর্যায়ে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সিদ্ধান্ত দেন, জেলার নামে আর কোনও বিভাগ হবে না। ২০২২ সালে প্রশাসনিক পুনর্বিন্যাস-সংক্রান্ত জাতীয় বাস্তবায়ন কমিটির (নিকার) বৈঠকে মেঘনা ও পদ্মা নামে দুটি বিভাগ অনুমোদন পায়।
মেঘনা বিভাগ হবে- বৃহত্তর কুমিল্লা ও বৃহত্তর নোয়াখালীর জেলাগুলোকে নিয়ে; পদ্মা বিভাগ হবে বৃহত্তর ফরিদপুরের জেলাগুলোকে নিয়ে।
সিদ্ধান্ত হলেও তার বাস্তবায়ন ২০২২ সালে স্থগিত করেছিল সরকার। নিকারের তৎকালীন সদস্য ও স্থানীয় সরকারমন্ত্রী তাজুল ইসলাম তখন সাংবাদিকদের বলেছিলেন, পদ্মা ও মেঘনা নামে নতুন বিভাগ করার প্রস্তাব দুটি স্থগিত রাখা হয়েছে।
তার কারণ দেখিয়ে তিনি বলেন, “এটা এখন অগ্রাধিকারমূলক বিষয় নয়। কারণ, এখন সারা পৃথিবীতে সংকট চলছে। এখন একেকটি বিভাগ করতে গেলে এক হাজার কোটি টাকার বেশি খরচ হবে। তাই এখন এটি স্থগিত রাখা হয়েছে।”
তবে তখনও গুঞ্জন ছিল, নতুন এই বিভাগ করলে তার পক্ষে-বিপক্ষে জনমতে নানা জটিলতা তৈরি হবে, তা এড়াতে সেই সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন শেখ হাসিনা।
আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকাকালে কুমিল্লায় বিএনপির বিভাগীয় সমাবেশে ‘কুমিল্লা’ নামেই বিভাগের পক্ষে অবস্থান জানিয়েছিলেন বিএনপির নেতারা। দলটির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরও ওই সমাবেশে বলেছিলেন, তার দল ক্ষমতায় গেলে কুমিল্লা নামেই বিভাগ করা হবে।