ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানে ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ঘনিষ্ঠদের যুক্তরাজ্যে বিপুল পরিমাণ সম্পদের হদিস পেয়েছে আন্তর্জাতিক দুটি প্রতিষ্ঠান- যুক্তরাজ্যের সংবাদমাধ্যম অবজারভার ও জার্মানির দুর্নীতিবিরোধী প্রতিষ্ঠান ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল।
যৌথ অনুসন্ধানে প্রতিষ্ঠান দুটি জানতে পেরেছে, সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সহযোগীরা যুক্তরাজ্যে ৪০ কোটি পাউন্ড বা ৬ হাজার কোটি টাকা মূল্যের সম্পদের মালিক। এসব সম্পদের বড় অংশই কেনা হয় যুক্তরাজ্য ও এর বাইরের কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের (অফশোর কোম্পানি) মাধ্যমে।
অবজারভার ও ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনালের অনুসন্ধান নিয়ে গতকাল শনিবার একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে যুক্তরাজ্যের আরেকটি সংবাদমাধ্যম দ্য গার্ডিয়ান।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, দীর্ঘ ১৬ বছর ক্ষমতা ধরে রাখা শেখ হাসিনাকে ৫ আগস্ট উৎখাতের পর গঠিত অন্তর্বর্তী সরকার আন্তর্জাতিক বিভিন্ন নথির সূত্র ধরে তার আমলে পাচার হওয়া প্রায় ১৩ বিলিয়ন পাউন্ড মূল্যের সম্পদ খুঁজে পেতে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সহযোগিতা চায়।
বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকার মনে করে, এই বিপুল পরিমাণ সম্পদ শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন দল আওয়ামী লীগের সঙ্গে যুক্ত প্রভাবশালী পরিবার ও ব্যবসায়ীরা রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলো থেকে ঋণ নিয়ে, অবৈধ অন্যান্য উপায়ে আত্মসাৎ করে বিদেশে পাচার করেছে।
এই ১৩ বিলিয়ন পাউন্ড মূল্যের সম্পদের মধ্যে প্রায় ৪০০ মিলিয়ন পাউন্ড মূল্যের সম্পদের খোঁজ পেয়েছে অবজারভার ও ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল।
তারা বলছে, শেখ হাসিনার আমলের দুজন উপদেষ্টা ও মন্ত্রীসহ ক্ষমতাকাঠামোর সঙ্গে জড়িত ব্যবসায়ীরা এই ৪০০ মিলিয়ন অর্থাৎ ৪০ কোটি পাউন্ড বিনিয়োগ করেছে যুক্তরাজ্যের আবাসন খাতে।
হুন্ডির মাধ্যমে বাংলাদেশ থেকে পাচার করা এই অর্থ দিয়ে তারা যুক্তরাজ্যের অভিজাত এলাকায় কিনেছে ৩৫০টি ফ্ল্যাট ও ম্যানশন।
অবজারভার ও ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনালের অনুসন্ধানে যে মন্ত্রী, উপদেষ্টা ও ব্যবসায়ীদের নাম উঠে এসেছে, তাদের মধ্যে আছেন সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বেসরকারি শিল্প ও বিনিয়োগবিষয়ক উপদেষ্টা এবং বেক্সিমকো গ্রুপের ভাইস চেয়ারম্যান সালমান এফ রহমান, সাবেক ভূমিমন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরী, বসুন্ধরা গ্রুপের চেয়ারম্যান আহমেদ আকবর সোবহান ও নাসা গ্রুপের চেয়ারম্যান নজরুল ইসলাম মজুমদার।
কার কত সম্পদ
বেক্সিমকো গ্রুপের ভাইস চেয়ারম্যান সালমান এফ রহমানের বিরুদ্ধে দেশে প্রায় এক বিলিয়ন পাউন্ড ব্যাংক ঋণ নিয়ে তা পরিশোধ না করার অভিযোগ আছে, যা তদন্ত করছে এনবিআর।
অবজারভার ও ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনালের অনুসন্ধানে বলা হয়েছে, লন্ডনের মেফেয়ার জেলার গ্রোসভেনর স্কয়ারে ৭টি বিলাসবহুল অ্যাপার্টমেন্টের মালিক বর্তমানে কয়েকটি মামলায় কারান্তরীণ সালমান এফ রহমান।
অফশোর কোম্পানি ব্রিটিশ ভার্জিন আইল্যান্ডসের মাধ্যমে ২০২২ সালের মার্চে ২৬ দশমিক ৭৫ মিলিয়ন পাউন্ড মূল্যের একটি বাড়ি কেনেন সালমান এফ রহমানের ছেলে আহমেদ শায়ান আহমেদ। গ্রোসভেনর স্কয়ারে আরেকটি ফ্ল্যাট আছে তার, যার মূল্য ৩৫ দশমিক ৫ মিলিয়ন পাউন্ড।
এই শায়ান আহমেদের লন্ডনের একটি বাড়িতেই কোনও ভাড়া না দিয়ে এক সময় ছিলেন শেখ হাসিনার বোন শেখ রেহানা।
শেখ হাসিনার পতনের পর মাসখানেক আগে তার সাবেক ভূমিমন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরীর যুক্তরাজ্যে বিপুল পরিমাণ সম্পদের মালিকানা নিয়ে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে কাতারের সংবাদমাধ্যম আল জাজিরা।
প্রতিবেদনে বলা হয়, যুক্তরাজ্যে ৩০০টির বেশি ফ্ল্যাট আছে সাইফুজ্জামানের, যার মূল্য কমপক্ষে ১৬০ মিলিয়ন পাউন্ড।
এই বিপুল পরিমাণ সম্পদের মালিকানা নিয়ে সাইফুজ্জামানের কাছে ই-মেইল করেছিল অবজারভার। জবাবে তিনি বলেছেন, বাংলাদেশের বাইরে বৈধ ব্যবসার মাধ্যমে এসব সম্পদ কিনেছেন তিনি।
সালমান এফ রহমান, সাইফুজ্জামান চৌধুরীর পাশাপাশি বসুন্ধরা গ্রুপের চেয়ারম্যান আহমেদ আকবর সোবহানের যুক্তরাজ্যে সম্পদের খোঁজ নেয় অবজারভার ও ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল।
অনুসন্ধানে তারা জানতে পারে, সোবহানের পরিবার যুক্তরাজ্যে দুটি বিশাল স্থাপনার মালিক, যার মূল্য ১৩ মিলিয়ন পাউন্ড।
এছাড়া দেশটিতে ফরাসি নকশার একটি অট্টালিকা কিনেছেন সোবহানের এক ছেলে। অবজারভার সেটি নির্মাণাধীন দেখতে পেয়েছে।
এর বাইরে বসুন্ধরা গ্রুপের ভাইস চেয়ারম্যান ও সোবহানের ছেলে সাফওয়ান সোবহানের লন্ডনের কেনসিংটনে ১০ মিলিয়ন পাউন্ড মূল্যের ম্যানশনের সন্ধান পেয়েছে অনুসন্ধানকারীরা। এর বাইরেও সোবহান পরিবারের দেশটিতে আরও বাড়ি আছে।
এসব সম্পদের বিষয়ে সাফওয়ান সোবহানকে প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন, “আমার পরিবার কোনও ধরনের অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগ দৃঢ়ভাবে প্রত্যাখ্যান করছে।
“আমরা মনে করি, এসব অভিযোগ রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ও আইনিভাবে দুর্বল।”
এর বাইরে অর্থপাচারের অভিযোগ আছে নাসা গ্রুপের প্রতিষ্ঠাতা ও চেয়ারম্যান নজরুল ইসলাম মজুমদারের বিরুদ্ধে। তিনি ও তার পরিবার লন্ডনের কেনসিংটনে পাঁচটি বিলাসবহুল বাড়ির মালিক কীভাবে হলেন, বাংলাদেশি কর্তৃপক্ষ সে বিষয়ে অনুসন্ধান করবে। বলা হচ্ছে, এসব সম্পদের মূল্য ৩৮ মিলিয়ন পাউন্ড।
অবজারভার জানতে পেরেছে, এসব বাড়ির বেশিরভাগই ভাড়া দিয়েছেন নজরুল ইসলাম মজুমদার।
বাংলাদেশ থেকে অর্থপাচার করে তা দিয়ে যুক্তরাজ্যে সম্পদ কেনার বিষয়ে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনালের নীতিবিষয়ক পরিচালক ডানকান হেমস বলেন, “সন্দেহজনক সম্পদ জব্দে বাংলাদেশি অংশীদারদের সঙ্গে যুক্তরাজ্য সরকারের ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করা উচিত।”