Beta
বুধবার, ৫ ফেব্রুয়ারি, ২০২৫
Beta
বুধবার, ৫ ফেব্রুয়ারি, ২০২৫

ট্রাম্প কি পারবেন ইউক্রেন যুদ্ধ দ্রুত শেষ করতে

Ukrain_War_Trump_1
[publishpress_authors_box]

যুক্তরাষ্ট্রের নবনির্বাচিত প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প সামরিক সংঘাতের বিরোধী হিসেবে নিজের ইমেজ তৈরি করেছেন। তিনি রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ শেষ করতে আগ্রহী। যদিও বাস্তবতা অনেক জটিল।

মস্কো ও পশ্চিমা দেশগুলোর মধ্যে ভূরাজনৈতিক টানাপড়েন অনেক গভীর। বৈশ্বিক চাপ এ সমস্যাকে আরও জটিল করেছে। শুধু ইচ্ছার জোরে এ সংঘাত মীমাংসা সম্ভব নয় বলে মনে করছেন অনেকে।

পরমাণু সংকটের নাটকীয় রূপ

রাশিয়া ও যুক্তরাষ্ট্র দুটি পরমাণু শক্তিধর রাষ্ট্র পরোক্ষ যুদ্ধে লিপ্ত। সরাসরি পরমাণু যুদ্ধ এড়াতেও চায় দেশ দুটি। এমন পরিস্থিতিতে উভয় পক্ষ নির্দিষ্ট কিছু নিয়ম মেনে চলছে। যদিও সেগুলো আনুষ্ঠানিকভাবে স্বীকৃত নয়। মস্কো ও ওয়াশিংটন কৌশল নির্ধারণে একে অপরের প্রতিক্রিয়া বিবেচনায় রাখে।

রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন গত দুই বছরে কিছু বাস্তবমুখী কৌশল নিয়েছেন। এর মাধ্যমে মস্কো ধীরে ধীরে অগ্রগতি অর্জন করছে। পাশাপাশি তিনি পূর্ণমাত্রার যুদ্ধ বাধিয়ে অর্থনীতি ও জনগণকেও ঝুঁকিতে ফেলছেন না। তৃতীয় বছরে প্রবেশ করা সংঘাতে পুতিনের এই কৌশল ইতিবাচক ফল দিতে শুরু করেছে।

তবে ট্রাম্পের এই সূক্ষ্ম ভারসাম্য নষ্ট করার ঝুঁকি রয়েছে। তার নীতি বর্তমান প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের তুলনায় বেশি আক্রমণাত্মক না হলেও মৌলিকভাবে ভিন্ন। ট্রাম্প ও তার দল বিশ্বের পরিস্থিতি ভিন্নভাবে দেখে। ফলে পুতিনের পদক্ষেপের প্রতি তাদের প্রতিক্রিয়াও স্বাভাবিকভাবেই আলাদা হবে।

উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, সেপ্টেম্বরে রাশিয়ার ‘পুরোনো’ ভূখণ্ডে দূরপাল্লার ক্ষেপণাস্ত্র হামলার সম্ভাবনায় মস্কোর প্রতিক্রিয়া ওয়াশিংটনের কাছে উত্তেজনা কমানোর একটি স্পষ্ট বার্তা দেয়। তবে এই পরিবর্তন ট্রাম্পের নির্বাচনী জয়ের পরই ঘটে, যা বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।

পুতিনের সঙ্গে সুসম্পর্ক গড়ার প্রতিশ্রুতি দিলেও ট্রাম্পের প্রথম মেয়াদের সময়কার উত্তেজনার কথা মনে রাখা গুরুত্বপূর্ণ। সেসময় বিদায়ী প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা ৩৫ জন রুশ কূটনীতিককে বহিষ্কার ও তাদের সম্পত্তি জব্দ করেন। এ পদক্ষেপ ছিল নজিরবিহীন এবং দুই দেশের সম্পর্কে নতুন উত্তেজনা সৃষ্টি করে।

ভ্লাদিমির পুতিনের সঙ্গে ডোনাল্ড ট্রাম্প।

পুতিন সেসময় তৎক্ষণাৎ পাল্টা ব্যবস্থা না নিয়ে ট্রাম্পের শপথ গ্রহণের অপেক্ষায় ছিলেন। পুতিনের আশা ছিল ট্রাম্প আগের প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার সিদ্ধান্তগুলো বাতিল করবেন। কিন্তু ট্রাম্পের মেয়াদ অভ্যন্তরীণ কেলেঙ্কারিতে জর্জরিত ছিল এবং অবস্থার কোনো পরিবর্তন ঘটেনি। ২০১৭ সালের মাঝামাঝি রাশিয়া পাল্টা পদক্ষেপ হিসেবে যুক্তরাষ্ট্রের ৭৫৫ জন কূটনীতিককে বহিষ্কার করে। এর মাধ্যমে কূটনৈতিক ভারসাম্য অর্জিত হয়।

এবারও ট্রাম্প ক্ষমতায় এসে পূর্বশর্ত ছাড়া দূরপাল্লার ক্ষেপণাস্ত্র হামলার সিদ্ধান্ত বাতিল করবেন— এটি আশা করা অস্বাভাবিক হবে। অন্যদিকে, বাইডেন ক্ষমতা ছাড়ার আগে আরও আক্রমণাত্মক পদক্ষেপ নিতে পারেন। ট্রাম্পও সেসবের দায় নেবে না।

শেষ পর্যন্ত, পুতিনকেই রাশিয়ার প্রতিক্রিয়া নির্ধারণ করতে হবে। কারণ উত্তেজনা আরও বাড়ানো তার স্বার্থের জন্য ক্ষতিকর। এখন পর্যন্ত রাশিয়া এই সংঘাতকে নিয়ন্ত্রণের মধ্যে রেখেছে এবং তার লক্ষ্যের দিকে ধীরে ধীরে এগুচ্ছেন।

এদিকে, যুদ্ধক্ষেত্রে ইউক্রেনের সশস্ত্র বাহিনীর (এএফইউ) পরিস্থিতি ক্রমেই খারাপ হচ্ছে। সামরিক সাহায্যের পরিমাণ যতই বাড়ুক না কেন, কিয়েভের পতনমুখী অবস্থান বদলানো সম্ভব নয়। পশ্চিমা ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবস্থা যুদ্ধের মোড় ঘুরিয়ে দেবে বলে যে ধারণা ছিল তা বাস্তব সম্মত নয়।

ওরেশনিক পরবর্তী পরিস্থিতি

পরমাণু প্রতিরোধকে প্রায়শই একটি অদম্য দুর্গের মতো ভাবা হয়, যা ভেদ হলে ভয়াবহ ধ্বংস ডেকে আনবে। তবে ইউক্রেন সংঘাত দেখিয়েছে, এটি বরং একটি ইমিউন সিস্টেম বা রোগপ্রতিরোধ ব্যবস্থার মতো কাজ করে। হুমকি প্রবেশ করলেও একটি শক্তিশালী ব্যবস্থা তা সামাল দিতে সক্ষম, সিস্টেমও ভেঙে পড়বে না।

রাশিয়ার পরমাণু প্রতিরোধব্যবস্থা পশ্চিমা দেশগুলোকে দূরে রাখায় কার্যকর প্রমাণিত হয়েছে। এর ফলে ইউক্রেনের জন্য পশ্চিমাদের সহায়তা এমন মাত্রায় সীমাবদ্ধ থাকে, যা মস্কোর সরাসরি পাল্টা প্রতিক্রিয়া উসকে দেয় না। রাশিয়ার এই ‘পরমাণু প্রতিরোধ ক্ষমতা’ বজায় থাকায় পশ্চিমা দেশগুলো ক্রেমলিনের ব্যবস্থায় দুর্বলতা খুঁজতে চেষ্টা চালাচ্ছে। তবে ক্রেমলিন তার দৃঢ় সংকল্প অটুট রেখেছে।

পশ্চিমারা রাশিয়ার ‘ইমিউন সিস্টেমে’ দুর্বলতা খুঁজে চলেছে। এটাও সত্য যে, ‘সংক্রমণ’ ছড়িয়ে পড়ছে। কুরস্ক অঞ্চলে লড়াই চলছে, ড্রোন রাশিয়ার ভূখণ্ডের হাজার কিলোমিটার ভেতরে ঢুকে যাচ্ছে এবং এখন যুক্ত হয়েছে দূরপাল্লার ক্ষেপণাস্ত্র। তবে এর কোনোটাই অস্তিত্বের সংকট তৈরি করেনি। মস্কো সফলভাবে এসবের বিরুদ্ধে লড়াই করছে।

দুই বছর আগে রাশিয়ার ওপর ক্ষেপণাস্ত্র বা ড্রোন হামলা হয়নি। কিন্তু তখন দেশটি সামরিক পরাজয়ের অনেক কাছাকাছি ছিল। এখন পরিস্থিতি আরও নিয়ন্ত্রণে রয়েছে।

পুতিনের ওরেশনিক হাইপারসনিক ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবস্থার প্রদর্শনী চূড়ান্ত হুঁশিয়ারি হিসেবে দেখা উচিৎ নয়। এটি বরং এই বার্তা দেয় যে, রাশিয়া তার স্বার্থ রক্ষায় প্রস্তুত।

ওরেশনিক ক্ষেপণাস্ত্র রাশিয়ার সামরিক শক্তির প্রকাশ করে। তবে এর মূল উদ্দেশ্য হলো প্রতিরোধ ক্ষমতা বজায় রাখা এবং পশ্চিমা নেতাদের তাদের সম্পৃক্ততার সীমা মনে করিয়ে দেওয়া।

ভলোদমির জেলেনস্কিরি সঙ্গে ডোনাল্ড ট্রাম্প।

জয় দেখতে কেমন

এক্ষেত্রে সর্বোচ্চ যা হতে পারে তা হল, পশ্চিমা দেশগুলোর সঙ্গে রাশিয়ার একটি বড় পরিসরের চুক্তি স্বাক্ষর। যেখানে প্রভাবের ক্ষেত্র ভাগ এবং ২০২১ সালের ডিসেম্বরে দেওয়া পুতিনের আল্টিমেটামের পয়েন্টগুলো আলোচনা করা হবে।

এর মানে হবে ইউরোপে একটি নতুন নিরাপত্তা কাঠামো তৈরি করা, যা রাশিয়ার স্বার্থকে স্বীকৃতি দেবে এবং স্নায়ুযুদ্ধের পরিণতি পুনর্বিবেচনা করবে। তবে, বর্তমান পরিস্থিতিতে এই লক্ষ্য অর্জন সম্ভব বলে মনে হচ্ছে না।

আরও বাস্তবসম্মত দৃশ্য হচ্ছে, ইউক্রেন নিয়ে পশ্চিমের সঙ্গে রাশিয়ার সীমিত একটি চুক্তি। ছয় মাস আগে এটি অসম্ভব মনে হলেও, এখন এটি গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করা হচ্ছে। আলোচনা শুরু হয়েছিল এমনকি যুক্তরাষ্ট্রের নির্বাচন হওয়ার আগেই।

ফাঁস হওয়া তথ্য ইঙ্গিত দেয় যে, পশ্চিমারা যুদ্ধবিরতির প্রস্তাব এবং ইউক্রেনের ন্যাটো সদস্যপদে ২০ বছরের স্থগিতাদেশ দিতে পারে। তবে, রাশিয়া ইউক্রেনকে নিরস্ত্র ও রাজনৈতিকভাবে নিরপেক্ষ করতে চায়। এই বৈপরীত্যগুলো মীমাংসা না হওয়া পর্যন্ত যুদ্ধ চলতে থাকবে।

চূড়ান্ত সম্ভাবনা হলো একটি গুরুত্বপূর্ণ চুক্তি ছাড়া পরিস্থিতি, যা ২০০৮ সালের পরবর্তী জর্জিয়ার পরিস্থিতির মতো হতে পারে। ইউক্রেনের সামরিক পরাজয় একটি রাজনৈতিক বিজয়ে পরিণত হতে পারে। যদি কিয়েভের পশ্চিমা সহযোগিতার ওপর নির্ভরশীলতা কমে, তবে ইউক্রেন, তিবলিসির মতো মস্কোর প্রতি শত্রুতামূলক মনোভাব ত্যাগ করবে। এতে তারা আরও সামরিক ক্ষয়-ক্ষতির হাত থেকে বাঁচবে এবং অর্থনীতি পুনরুদ্ধার করতে পারবে।

এই তৃতীয় দৃশ্যের সম্ভাবনা এখন আরও বাড়ছে। কারণ ইউক্রেন যুদ্ধক্ষেত্রে বাড়তি চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হচ্ছে এবং পশ্চিমা সমর্থন কমছে। বাস্তবতা হলো রাশিয়া ও পশ্চিমের মধ্যে একটি তুলনামূলকভাবে স্থিতিশীল চুক্তি কেবল তখনই সম্ভব, যদি কিয়েভ মস্কোর প্রতি শত্রুতামূলক নীতি পরিত্যাগ করে।

এই সমাধান বাস্তবায়িত হতে হলে, পশ্চিমা দেশগুলোকে সরাসরি হস্তক্ষেপ থেকে বিরত থাকতে হবে এবং ইউক্রেনকে সামরিক সহায়তা বন্ধের সিদ্ধান্ত নিতে হবে। এটি পুতিনের কৌশল। তিনি ট্রাম্প বা কোনও কূটনৈতিক সমাধানের সম্ভাবনা নিয়ে মিছে আশায় নেই।

কেন?

কারণ একটি চুক্তি শুধু তখনই সম্ভব যখন বৈপরীত্যগুলো সমাধান হয়। কিন্তু রাশিয়া এবং পশ্চিমের মধ্যে মূল সমস্যা এখনও অমীমাংসিত। তারা কেউই ইউক্রেনকে তাদের প্রতিপক্ষের প্রভাব বলয়ের অংশ হিসাবে গ্রহণ করতে প্রস্তুত নয়।

আরও পড়ুন

সর্বশেষ

সর্বাধিক পঠিত