রিংকি (ছদ্মনাম) কাজ করেন ফটোগ্রাফি নিয়ে। ২৪ বছর বয়সী রিংকি এমন এক পেশার সঙ্গে জড়িয়ে আছেন যেখানে প্রতিদিন খবরের পেছনে ছুটতে হয়, ব্রেকিং নিউজের চাপ সামলাতে হয়। এই কাজে নাম, স্থান এবং আরো ছোটখাটো তথ্যও ভুলে যাওয়ার সুযোগ নেই। যদিও রিংকির মনে হচ্ছে, দিন দিন এই পেশা কঠিন হয়ে উঠছে তার কাছে।
“আমি যত বেশি মনোযোগ দিতে চেষ্টা করি, মনে রাখা আমার জন্য তত বেশি অসম্ভব হয়ে পড়ছে”, অকপটে এই স্বীকারোক্তি দিলেন রিংকি।
স্মরণশক্তি নিয়ে আগে কখনও এতো ভুগতে হয়নি তাকে। কিন্তু আজকাল কোনও কিছু পরিষ্কারভাবে ভাবতে ব্যর্থ হচ্ছেন তিনি।
রিংকি দাসের এই সমস্যার অপর নাম ব্রেইন ফগ; অর্থাৎ কুয়াশাচ্ছন্ন মস্তিষ্ক।
২৩ বছর বয়সী শালিনী ঝা (ছদ্মনাম) একজন ফ্যাশন ডিজাইনার। কাজে ক্ষেত্রে রিংকির মতো অসুবিধার মুখে পড়ছেন তিনিও।
শালিনী গভীর রাত জেগে পছন্দের সিরিজ দেখেন। মাঝে মাঝে না ঘুমানোর অভ্যাসও আছে তার। ইনস্ট্রাগ্রামে স্ক্রল করতে করতে সময় কাটিয়ে দেন নিয়মিত। উপরন্তু আছে কর্মস্থলের কাজের চাপ।
বলা চলে, শালিনীর জীবনযাপনই তার ‘ব্রেইন ফগ’ সমস্যা ডেকে এনেছে।
জেন-জিরা কেন ব্রেইন ফগে ভুগছে?
অনেকের ব্যক্তিজীবনের তথ্য থেকে অর্থাৎ এসব অ্যানেকডোটাল বিশ্লেষণ করে দেখা যাচ্ছে তরুণ প্রজন্মের মধ্যে ‘ব্রেইন ফগ’ সমস্যা অহরহ দেখা যাচ্ছে; এদের মধ্যে জেন-জিরাই বেশি ভুক্তভোগী হচ্ছে।
রেড্ডিট ব্লগে তরুণরা এসব নিয়ে কথা বলেছে। আর সেসব স্বীকারোক্তি বিশ্লেষণ করে দেখেছে ইন্ডিয়া টুডে।
এ বছর সেরা শব্দ মানে ‘ওয়ার্ড অফ দ্য ইয়ার‘ হিসাবে ‘ব্রেইন রট’ নির্বাচিত করেছে অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি প্রেস (ওইউপি)।
একজন ব্যক্তির মানসিক বা বুদ্ধিবৃত্তিক অবস্থার অবনতিকে ‘ব্রেইন রট’ বলে। ইনস্টাগ্রাম আর টিকটকে দীর্ঘক্ষণ সময় কাটানোর ফলাফল হিসেবে দেখা দিচ্ছে ব্রেইন রট। আর ডিজিটাল যুগে এ ধরনের প্রবণতায় আক্রান্ত দেখা যায় জেন-জিদেরই।
আশেপাশে থাকা ইলেকট্রনিক ডিভাইসে মনোযোগ না দিয়ে শেষবার কখন একটি বই একটানে পড়ে শেষ করতে পেরেছেন? খাবার খেতে খেতে রিলস স্ক্রল করার মতো ছোট ছোট আসক্তি আমাদের অজান্তেই ‘ব্রেইন ফগ’ বাড়িয়ে তুলছে।
ইন্ডিয়া টুডের সঙ্গে আলাপে কয়েকজন বিশেষজ্ঞ এক বাক্যে বলেছেন, বিশেষ করে তরুণ প্রজন্মের মধ্যেই ব্রেইন ফগ বেড়ে চলেছে।
মুম্বাই শহরের মনস্তত্ত্ববিদ অ্যাবসি স্যাম বললেন, তরুণদের মধ্যে ব্রেইন ফগের এই বৃদ্ধি বিশেষ উদ্বেগের বিষয়।
কারণ সিদ্ধান্ত গ্রহণ এবং উত্তেজনা নিয়ন্ত্রণে কাজ করা প্রিফ্রন্টাল কর্টেক্স এই বয়সেও বিকশিত হতে থাকে। চাপ এবং অতিরিক্ত উদ্দীপনায় এই প্রিফ্রন্টাল কর্টেক্স সংবেদনশীল হয়ে ওঠে।
তরুণদের জীবনযাপনের ধরনের কারণেই এই জটিলতা দেখা দিচ্ছে বলে মনে করছেন অ্যাবসি স্যাম।
স্যার এইচএন রিলায়েন্স ফাউন্ডেশন হাসপাতালের একজন ক্লিনিক্যাল সাইকোলজিস্ট মেহেজাবিন দোর্দি বলেন, ব্রেইন ফগ এখন সব বয়সী মানুষের মধ্যেই দেখা দিচ্ছে; তবে তরুণদের মধ্যে এই সংখ্যা বেশি।
আধুনিক জীবনযাপনের দীর্ঘস্থায়ী চাপ, ডিজিটাল নির্ভরতা, শারীরিক কার্যকলাপের অভাব এসব সমস্যার পেছনের কারণ।
মেহেজাবিন দোর্দি বলেন, কোভিড-১৯ মহামারীর সময়ও ব্রেইন ফগ বাড়িয়ে তোলায় ভূমিকা রেখেছে।
ওই সময় অনেকেরই জীবনের রুটিন পাল্টে যায়, সামাজিকভাবে অনেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। কোভিড পরবর্তী সময়েও এই শারীরিক-মানসিক ক্লান্তি বয়ে বেড়াতে হচ্ছে অনেককেই।
দিল্লির একজন সিনিয়র সাইকোলজিস্ট এবং মানসিক স্বাস্থ্য কর্মী ড. অরবিন্দ ওটা।
তিনি বলেন, “আজকের যুবকরা আধুনিক জীবনযাপন, পরিবেশগত কারণ এবং সামাজিক চাপের কারণেই ব্রেইন ফগে ভুগছেন।”
তরুণদের মধ্যে বিশেষত জেন-জি এবং মিলেনিয়ালরা প্রযুক্তি, স্ক্রিন, নোটিফিকেশন এবং সোশাল মিডিয়া আসক্তিতে ভুগছেন।
“তথ্যের এই স্রোত মস্তিষ্ককে ভীষণভাবে ভারাক্রান্ত করে। এসবের মধ্যে কাজের চাপ যুক্ত হলে শেষ পর্যন্ত সক্ষমতা হ্রাস পায়। একটি অ্যাপ থেকে আরেকটি অ্যাপে যাওয়া, মাঝখানে মেসেজ দেখা এবং কাজ করা- এতকিছু এক সঙ্গে চালিয়ে যাওয়ার কারণে মনোযোগের পরিসর কমে আসে। এমনকি ব্যক্তি কাজের মান ও সক্ষমতাও তেমন থাকে না। শেষ পর্যন্ত ব্যক্তির মধ্যে দেখা দেয় মানসিক ক্লান্তি”, বললেন ড. ওটা।
ব্রেইন ফগ উপসর্গের আরো একটি কারণ তুলে ধরলেন মেহেজাবিন।
আগের প্রজন্মের তুলনায় জেন-জি সবখানেই তীব্র প্রতিযোগিতার মধ্যে পড়ছে। সামাজিক প্রত্যাশা, একটি ডিজিটাল ব্যক্তিত্ব তৈরি করা এবং সবমিলিয়ে সপ্তাহে ৭০ ঘণ্টা কাজের চাপ নিতে হচ্ছে এই প্রজন্মকে।
মেহেজাবিন বলেন, দীর্ঘ সময় ধরে বসে কাজ করা এবং বাইরে গিয়ে কাজের জায়গা সীমিত হয়ে আসার নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে জীবনে। তরুণদের এখন এক কোনায় বসে ইলেকট্রনিক ডিভাইস নিয়েই মেতে থাকতে দেখা যায়।
নির্ঘুম প্রজন্ম
সুস্থ ও সতেজ থাকতে ঘুমের কোনও বিকল্প নেই।
কিন্তু অনেক তথ্য থেকে দেখা যাচ্ছে, বাকি প্রজন্মের চেয়ে জেন-জিরা ঘুমের অনিয়মে ভুগছে।
এমনকি তরুণদের ঘুমের মানও খারাপ বলে মন্তব্য করলেন ড. ওটা।
কারণ তারা রাতে একটানা ইলেকট্রনিক ডিভাইস ব্যবহার করে। এতে করে ঘুমের হরমোন মেলাটোনিন নিঃসরণ বাধাগ্রস্ত হয়।
“সময়ের অনিয়ম, রাতের বেলা পড়াশোনা বা কাজ এবং স্ক্রিনে একের পর এক সিরিজ দেখার কারণে ঘুমের অভাব বেড়ে যায়। এসব থেকে মস্তিষ্ক বিভ্রান্ত হয়। যদি কারো যথেষ্ট পরিমাণে ঘুম না হয়, তবে তার নতুন স্মৃতি সৃষ্টি হয় না। মস্তিষ্কের সক্ষমতায় অস্পষ্ট দেখা দেয়“, বলেন ড. ওটা।
বর্তমানের অনেক গবেষণায় উঠে এসেছে, অন্য প্রজন্মের তুলনায় জেন-জিরা সবচেয়ে বেশি মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যায় ভুগছে। মিলেনিয়াল, জেন এক্স এবং বেবি বুমারদের তুলনায় উদ্বেগ এবং বিষণ্নতার হারও জেন-জিদের মধ্যে বেশি।
এই চাপ এবং উদ্বেগ থেকে ব্রেইন ফগ দেখা দিচ্ছে। ব্রেইন ফগের কারণে আরও বেড়ে যাচ্ছে মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যা, উদ্বেগ এবং বিষণ্নতা। শেষ পর্যন্ত নতুন কিছু শেখার দক্ষতা, স্মৃতিশক্তি এবং মনোযোগে বাজে প্রভাব পড়ছে।
ড. ওটা ব্যাখ্যা করে বলেন, “দীর্ঘস্থায়ী চাপ মস্তিষ্কের টেম্পোরাল লোবের হিপোক্যাম্পাসের জন্য ক্ষতিকারক। ফলে স্মৃতিশক্তি এবং শেখার সক্ষমতা ব্যাহত হয়।
“এসব আরও জটিল হয়ে ওঠে অন্যান্য ভুল অভ্যাসের কারণে। যেমন বিষাক্ত উপাদান থাকা প্রক্রিয়াজাত খাবারে অভ্যস্ত হওয়া, সময় মতো না খাওয়া এবং সঠিক ভাবে শরীরচর্চার অভাব। এতে প্রয়োজনীয় পুষ্টি এবং দক্ষতা গড়ে ওঠার সুযোগ থেকে বঞ্চিত হয় মস্তিষ্ক।”
অ্যাবসি স্যাম মনে করেন, সামাজিক মিডিয়া আমাদের মস্তিষ্ককে এলোমেলো করে দেয়। যেমন, এক মিনিটের রিল; এতে দীর্ঘমেয়াদী স্মৃতি তৈরি করা কঠিন হয়ে পড়ে।
কানাডার উইলফ্রিড লরিয়ের ইউনিভার্সিটি প্রকাশিত ২০২২ সালের একটি গবেষণা বলছে, মস্তিষ্কের বিকাশের সময় অতিরিক্ত স্ক্রিন টাইমে অভ্যস্ত হওয়ায় প্রাপ্তবয়স্ক বয়সে আলঝেইমার বা ডিমেনশিয়া রোগের ঝুঁকি বাড়বে।
গবেষণার এই ফলাফলের সঙ্গে একমত হলেন মেহেজাবিনও।
“সামাজিক মিডিয়ায় আসা তথ্যের দ্রুত প্রবাহের কারণে মস্তিষ্ক বিভ্রান্তিতে ভোগে; কোনটিতে গুরুত্ব বেশি দেয়া উচিত তা বুঝতে অপারগ হয়ে ওঠে মস্তিষ্ক।”
ব্রেইন ফগ কি ভালো হয়?
ব্রেইন ফগ মোকাবিলার সহজ উপায় হলো মস্তিষ্কে কোনো চাপ দেয়া যাবে না। আর এজন্য ঘুমের মান বাড়াতে বলছেন বিশেষজ্ঞরা।
প্রতিদিন সাত থেকে আট ঘণ্টা ঘুমাতে হবে এবং রোজ একই সময়ে ঘুমাতে যেতে হবে। ভালো ঘুমের জন্য কম্পিউটার, টিভি এবং অন্যান্য ইলেকট্রনিক ডিভাইসের স্ক্রিনের আলো থেকে নিজেকে দূরে রাখাই স্বাস্থ্যকর। ঘুমের আগে ক্যাফেইন জাতীয় পানীয় এড়িয়ে চলা দরকার।
সুষম খাবার খাওয়ার অভ্যাস বজায় রাখতে হবে। সবুজ শাকসবজি, চর্বিযুক্ত মাছ, বাদাম, বীজ খেতে হবে নিয়ম করে। মানসিক চাপের সময় পানি পানের দিকে বেশি মনোযোগ দিতে হবে। পানির অভাবেও মনোযোগে ঘাটতি দেখা যায়। প্রক্রিয়াজাত খাবার, চিনি, অতিরিক্ত ক্যাফেইনের আসক্তি কাটিয়ে উঠতে পারলে মানসিক ক্লান্তিও কমে আসে।
স্ক্রিন টাইম কমানোর কোনো বিকল্প নেই তা সচেতনভাবে মনে রাখতে হবে। চোখের বিশ্রাম জরুরি। একাধিক কাজ একসঙ্গে না করে একটি রুটিন মেনে চলা ভালো। পড়ালেখা, ধাঁধার সমাধান, নতুন কিছু শেখা কগনিটিভ ফাংশনকে সবল করে; তাই এসবে জড়িয়ে রাখতে হবে নিজেকে।
পুষ্টির অভাব এবং হরমোনজনিত সমস্যার কারণে ব্রেইন ফগ স্থায়ী রোগে পরিণত হতে পারে। তাই মনোযোগ হারিয়ে গেলে, নিজেকে বিভ্রান্ত মনে হলে, ক্লান্তি বোধ করলে, চিন্তাশক্তি এলোমেলো মনে হলে অবশ্যই চিকিৎসকের শরণাপন্ন হতে হবে।