অন্তর্বর্তী সরকার এসে নির্বাচন কমিশন গঠন করলেও ভোটের দিনক্ষণ এখনও ঠিক হয়নি; এর মধ্যেই আগামী বছর নির্বাচিত সরকারের দেখা মেলার আশা দিয়েছেন উপদেষ্টা ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ।
শনিবার বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠান (বিআইডিএস) আয়োজিত এক সম্মেলনে এক ব্যবসায়ী প্রশ্নে ওয়াহিদউদ্দিন নিজেদের সংক্ষিপ্ত মেয়াদের বিষয়টি তুলে ধরে এ আশা দেন।
ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআইর পরিচালক তানভির মোহাম্মদ দিপু উপদেষ্টার কাছে প্রশ্ন রেখেছিলেন, কানাডা, যুক্তরাষ্ট্র, অস্ট্রেলিয়া, জাপান ও সৌদি আরবের মতো দেশকে পেছনে ফেলে বাংলাদেশের কি ধনী দেশ হওয়া সম্ভব?
উত্তরে ওয়াহিদউদ্দিন বলেন, “সবাই মিলে আমরা করতে পারি। কিন্তু আমাদের এই সরকার তো খুব স্বল্পকালীন। আমি ব্যক্তিগতভাবে মনে করি, আগামী বছরই একটা রাজনৈতিকভাবে নির্বাচিত সরকার দেখব।”
তবে নির্বাচন কবে হবে, সেই বিষয়ে ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে প্রধান উপদেষ্টা বাদে অন্য কোনও উপদেষ্টার বক্তব্য ধর্তব্যের মধ্যে নয় বলে তার দপ্তর থেকে বক্তব্য আসার প্রেক্ষাপটে পরিকল্পনা ও শিক্ষা উপদেষ্টার দায়িত্বে থাকা ওয়াহিদউদ্দিনও বলেছেন, এটা তার ব্যক্তিগত মতামত।
এর আগে কয়েকজন উপদেষ্টা নির্বাচনের সময় নিয়ে বক্তব্য রেখেছিলেন। এরপর প্রধান উপদেষ্টা ড. ইউনূসের সহকারী প্রেস সচিব অপূর্ব জাহাঙ্গীর গত ২৪ নভেম্বর বলেন, “এখন পর্যন্ত প্রধান উপদেষ্টা বা তার দপ্তর থেকে নির্বাচনের কোনও তারিখ দেওয়া হয়নি। নির্বাচনের তারিখ তিনিই ঘোষণা দেবেন এবং তার পক্ষ থেকেই দেওয়া হবে। বাকি যারা বলেছেন, তা নিজেদের মতামত।”
২০০৭ সালে জরুরি অবস্থা জারি পর গঠিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রায় দুই বছর পর নির্বাচনের আয়োজন করেছিল। কিন্তু এবার কোনও স্পষ্ট ধারণা মিলছে না।
ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে গত আগস্টে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর ড. ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠিত হয়।
এই অভ্যুত্থানে নেতৃত্ব দেওয়া বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতারা নির্বাচনের চেয়ে ‘রাষ্ট্র সংস্কার’ই এখন বেশি গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করছে। তার ধারাবাহিকতায় বিভিন্ন ক্ষেত্রে সংস্কারে ছয়টি কমিশনও গঠন করেছে সরকার।
এদিকে নির্বাচন সংস্কারে গঠিত কমিশনের কাজ শেষের আগেই সাবেক সচিব এ এম এম নাসির উদ্দীনকে সিইসি করে নির্বাচন কমিশন গঠন করা হয়েছে।
গত ২৪ নভেম্বর তিনি দায়িত্ব নেওয়ার দিন তাকে সাংবাদিকরা প্রশ্ন করেছিল- নির্বাচন কবে দেবেন? উত্তরে তিনি বলেছিলেন, “দিনক্ষণ দিয়ে তো এখন বলা যাবে না। আগে দায়িত্বটা নিই, কাজকর্ম বুঝে নিই।”
সংস্কারে আপত্তি না থাকলেও রাজনৈতিক দলগুলো দ্রুত নির্বাচনের দাবি জানাচ্ছে। তারা চাইছে, সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য প্রয়োজনীয় সংস্কার করেই ভোট দিয়ে দেওয়া হোক।
উন্নতির সোপানে অবস্থায় কোথায়?
বাংলাদেশ এখন বিশ্বে ৩৫তম বৃহৎ অর্থনীতির দেশ; ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ ২০৪১ সালের মধ্যে বাংলাদেশকে ২৫ এর মধ্যে আনার লক্ষ্য ঠিক করেছিল।
বিআইডিএসের অনুষ্ঠানে এফবিসিসিআই পরিচালকের প্রশ্নের উত্তরে অর্থনীতিবিদ ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ বলেন, “তবে কোনও দেশে কখনও হঠাৎ করে ওইভাবে উন্নতি হয়নি। আমরা এখন নিম্ন মধ্যম আয়ে আছি। সেখান থেকে উচ্চ মধ্যম আয়ে যাওয়া নিয়ে আলোচনা হচ্ছে।
“আমরা মালয়েশিয়া তো দূরের কথা, ফিলিপিন্স বা থাইল্যান্ডের পর্যায় কীভাবে যাব? সেই বাধাও তো চিন্তা করিনি এখনও।”
বিআইডিএস মহাপরিচালক ড. বিনায়ক সেনের সঞ্চালনায় অনুষ্ঠানে বক্তব্যে ছিলেন ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ বৈষম্যহীন অর্থনীতি গড়তে কৃষক শ্রমিকসহ নিচের পর্যায়ের কর্মীদের শক্তিশালী সাংগঠনিক ব্যবস্থা গড়ে তোলার ওপর জোর দেন।
তিনি বলেন, “আমাদের দেশের চরের জমি দখল হয়ে যায়। হাওর অঞ্চলের জলাভূমি রাজনৈতিকভাবে প্রভাবশালীরা দখল করে নিয়ে যায়। এটাকে যদি তৃণমুল পর্যায়ে শক্তিশালী সংগঠন থাকত, তাহলে এটা সম্ভব হতো না।”
এসময় তিনি আওয়ামী লীগ সরকার আমলে অপ্রয়োজনীয় প্রকল্পে বৈদেশিক ঋণসহ বড় ধরনের বিনিয়োগের মাধ্যমে অর্থ অপচয়ের কথা বলেন।
“আমি মনে করি, আমাদের বাস্তবায়ন করা অনেকগুলো অবকাঠামো প্রকল্পের মধ্যে পদ্মা সেতুসহ দুই-তিনটি প্রকল্প খুব ভালো ছিল। কিন্তু অনেকগুলো প্রকল্প ছিল প্রেসটিজ প্রকল্প। বিপুল পরিমাণ অর্থ ব্যয় করে এই রকম ধংসাত্মক প্রকল্প বাস্তবায়ন করেছি। বৈদেশিক দাতা সংস্থাগুলোর সঙ্গে যে অর্থায়নে যেসব ঋণ চুক্তি করেছি, সেগুলো নিয়ে আমরা উদ্বিগ্ন।”
ওয়াহিদউদ্দিন বলেন, “এখন আমাদের সবচেয়ে বড় দুঃশ্চিন্তার বিষয় হচ্ছে অর্থনৈতিক বৈষম্য এবং আয় বণ্টন সমস্যা। এই দুটিই সার্বিকভাবে আমাদের অর্থনীতির সবচেয়ে বড় সমস্যা।”
বিগত সরকারের অর্থ পাচারের কারণে বৈষম্য আরও প্রকট হয়েছে বলে দাবি করেন পরিকল্পনা উপদেষ্টা।
তিনি বলেন, “ব্যাংকগুলোতে সাধারণ মানুষের টাকা জমা ছিল। সেই টাকা বিদেশে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে। এখন মানুষের হাতে টাকা নাই। এখন ব্যাংকগুলোতে কোনও সম্পদ নাই। এখন গ্রাহকের টাকা কোথা থেকে আসবে?”
এই বাস্তবতায় সমতামূলক সমাজ গঠন কঠিন মানলেও দেশের দরিদ্র এবং ধনীদের আয়ের একটি তুলনামুলক বিশ্লেষণ করে সমাজের সবার আয়ের উপযোগিতার ওপর ভিত্তি করে একটি সমতার বণ্টন ব্যবস্থা তৈরির ওপর জোর দেন তিনি।
শিক্ষা উপদেষ্টা ওয়াহিদউদ্দিন বলেন, “বৈষম্য কমাতে আমরা দেশের সবার জন্য মানসম্পন্ন শিক্ষা নিশ্চিত করার মেধাভিত্তিক উচ্চ শিক্ষা নিশ্চিত করার ওপর সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দিচ্ছি।”