সাধারণত প্রতি বছর অক্টোবরের শেষ দিকে কক্সবাজারের সেন্ট মার্টিন দ্বীপে শুরু হয় পর্যটন মৌসুম। তবে এ বছর চিত্রটা কিছুটা ভিন্ন। সরকারি নানা বিধিনিষেধের বেড়াজাল পেরিয়ে ১ ডিসেম্বর শুরু হয়েছে মৌসুম।
তবে আগের মতো পর্যটকের ঢল যে প্রবাল দ্বীপটিতে না নামে, সেজন্য সতর্ক প্রশাসন। ঠিক করে দেওয়া হয়েছে পর্যটক প্রবেশের সীমা, সে সীমা পূরণে কঠোর অবস্থানে সরকার।
সরকারি সিদ্ধান্ত অনুযায়ী প্রতিদিন দুই হাজারের বেশি পর্যটক সেন্ট মার্টিনে যেতে পারবেন না। আর যারা যাবেন, তাদেরও নিতে হবে নিবন্ধন। সঙ্গে নেওয়া যাবে না একবার ব্যবহার করা যায় এমন প্লাস্টিক সামগ্রী যেমন পানির বোতল বা পলিথন।
নিষেধাজ্ঞা উঠলেও সেন্ট মার্টিনে দেখা মিলছে না কাঙ্ক্ষিত সংখ্যার পর্যটকের। আগে যেখানে প্রতিদিন গড়ে ১০ হাজার পর্যটক দ্বীপ ভ্রমণে যেতেন, সেখানে এখন সরকারের বেধে দেওয়া দুই হাজার জনের কোটাও পূরণ হচ্ছে না। ফলে পর্যটননির্ভর এই দ্বীপের মানুষ পড়েছেন বিপাকে। তাদের দুশ্চিন্তা যেন শেষই হচ্ছে না।
রবিবার কক্সবাজার শহরের নুনিয়ারছড়া থেকে সকাল ৬ টায় প্রথম দফায় পর্যটক নিয়ে যায় জাহাজ কর্ণফুলী। এরপরও বারো আউলিয়া, কেয়ারি ও ব্রে ক্রুজ জাহাজও যায় পর্যটক নিয়ে। এই চারটি জাহাজে মোট এক হাজার ১৩২ জন যাত্রী দ্বীপে গেছেন।
সেন্ট মার্টিনে পর্যটকবাহী জাহাজ মালিকেদের সংগঠন সি ক্রুজ অপারেটর ওনার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের সাধারণ সম্পাদক হোসাইন ইসলাম বাহাদুর সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, নিষেধাজ্ঞা ওঠার পর গত আট দিনে মোট ৭ হাজার ১০৫ জন পর্যটক দ্বীপে গেছেন।
এর মধ্যে ১ ডিসেম্বর গেছেন ৬৫৩ জন, ২ ডিসেম্বর ৬৫৬ জন, ৩ ডিসেম্বর ৭৪০ জন, ৪ ডিসেম্বর ১ হাজার জন, ৫ ডিসেম্বর ৬৫৬ জন, ৬ ডিসেম্বর ১ হাজার ৫৫০ জন, ৭ ডিসেম্বর ৭০৭ জন দ্বীপে গেছেন।
সরকার নির্ধারিত সীমা পূরণ হলে গত আট দিনে যাওয়ার কথা ছিল ১৬ হাজার পর্যটকের। সেখানে গেছেন অর্ধেকেরও কম।
দ্বীপ ভ্রমণ নিয়ে কড়াকড়ি ও নিবন্ধনের কথা প্রচার হওয়ায় দিনে কাঙ্ক্ষিত দুই হাজার পর্যটকেরও দেখা মিলছে না বলে মনে করেন হোসাইন ইসলাম বাহাদুর।
তিনি বলেন, “অথচ পর্যটকদের নিবন্ধন করতে কোনও জটিলতা নেই। জাহাজের টিকেট কাটলেই নিবন্ধন প্রক্রিয়া শেষ হয়ে যায়। তবু মৌসুম শুরু পরেও পর্যটকদের দেখা মিলছে না।”
১৭ বর্গ কিলোমিটার আয়তনের ছোট্ট এই দ্বীপটিতে সাড়ে ১০ হাজার মানুষ বসবাস। এক সময় দ্বীপের মানুষের প্রধান আয়ের উৎস ছিল সমুদ্র থেকে মাছ আহরণ। কিন্তু গত ২০ বছরে বদলে গেছে এই আয়ের মাধ্যম। এখন দ্বীপের শতভাগ মানুষ পর্যটনের ওপর নির্ভরশীল।
সেন্ট মার্টিন ইউনিয়ন পরিষদের প্যানেল চেয়ারম্যান খোরশেদ আলম বলেন, “নভেম্বর থেকে মার্চ এই পাঁচ মাস পর্যটন থেকে আয় করে দ্বীপের মানুষ। সেই আয় দিয়েই চলে গোটা বছর। কিন্তু এ বছর পাঁচ মাস সময় পাওয়া যাচ্ছে না। আবার সরকার নির্ধারিত দুই হাজার পর্যটকও প্রতিদিন যাচ্ছেনা। বাকি মৌসুম এরকম চলতে থাকলে কী হবে, সেটা ভেবেই এখন চিন্তিত দ্বীপের মানুষ।”
বাজারের রেস্তোরাঁ পরিচালনা করেন ব্যবসায়ী আবু তালেব। তিনি জানালেন, ১৪ বছর আগেও তার তিনটি ফিশিং ট্রলার ছিল। এখন আর তা নেই। একটি রেস্তোরাঁ ও কয়েক রুমের একটি কটেজ পরিচালনা করে সংসারের খরচচালান তিনি।
এবারের পর্যটক সংখ্যা দেখে তিনি চিন্তিত। দুই মাসের আয় দিয়ে গোটা বছর আদৌ চলতে পারবেন কিনা, তা বুঝতে পারছেন না।
দ্বীপের জেটি ঘাট বাজার থেকে পশ্চিম পাড়ার দূরত্ব এক কিলোমিটারের কম। এই পথের জন্য গফুর মিয়া নামের এক ইজিবাইক চালক চাইলেন ৩০০ টাকা।
এত টাকা কেন চাইছেন জানতে চাইলে তিনি সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “পর্যটকদের কাছ থেকে ভাড়া আদায় করেই আমাদের সংসার চলে। যার কিছু অংশ মালিককে দিয়ে দিতে হয়। আগে প্রতিদিন ১০-২০ হাজার করে পর্যটক আসত, এবার আসছে এক হাজারের কম। আমাদের কোনোভাবেই চলছে না।
“মৌসুম শেষ হলে দুই মাস পর আমাকে কী হবে, কে জানে!”
পর্যটনকেন্দ্রীক এই দ্বীপে বৈধ-অবৈধ আবাসিক হোটেল ও কটেজর সংখ্যা ২১৭টি। যেগুলোয় কাজ অনেক মানুষ। অনেকেই বিপুল বিনিয়োগ করেছেন। এখন তারা পড়েছেন বিপাকে।
দ্বীপের বাসিন্দা ও কটেজ মালিক আবদুল মজিদ বললেন, অনেক টাকা বিনিয়োগ করে গড়ে ওঠা এসব আবাসিক হোটেল-কটেজে এখন চলছে খরা।
“নানা শঙ্কায় আবাসিক প্রতিষ্ঠানগুলো এবার অনেকেই সংস্কারও করেনি। যারা করেছেন তাদের হোটেল-কটেজে থাকার মতো পর্যটেই তো আসছেন না।”
ফলে দ্বীপের অন্যদের মতো দুশ্চিন্তায় হোটেল-কটেজ ব্যবসায়ী ও কর্মচারীরাও।
গত ২২ অক্টোবর পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রাণলয়ের সভায় সেন্ট মার্টিনের বিষয়ে নানা বিধিনিষেধের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। যার পরিপ্রেক্ষিতে গত ২৮ অক্টোবর একই মন্ত্রণালয়ের উপসচিব অসমা শাহীনের সই করা একটি পরিপত্র জারি হয়।
পরিপত্রে পাঁচটি বিষয়ের কথা উল্লেখ করা হয়। যেগুলো হলো, সেন্ট মার্টিনে নৌযান চলাচলের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌ পরিবহণ কর্তৃপক্ষ পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ের সম্মতি নিয়ে তবেই অনুমতি দেবে, নভেম্বর মাসে দ্বীপে পর্যটক গেলেও দিনে ফিরে আসতে হবে; রত্রিযাপন করা যাবে না।
ডিসেম্বর ও জানুয়ারি মাসে রাত্রিযাপন করা যাবে; তবে সেক্ষেত্রে পর্যটকের সংখ্যা গড়ে প্রতিদিন দুই হাজারের বেশি হতে পারবে না।
দ্বীপে রাতে আলো জ্বালানো যাবে না, শব্দ দূষণ সৃষ্টি করে এমন কোনও কাজ করা যাবে না, নিষিদ্ধ থাকবে বার-বি-কিউ পার্টিও।