দেশের অর্থনীতির সবচেয়ে উদ্বেগজনক সূচক বিদেশি মুদ্রার সঞ্চয়ন বা রিজার্ভের অন্যতম প্রধান উৎস প্রবাসীদের পাঠানো অর্থের ইতিবাচক ধারা অব্যাহত রয়েছে। আগস্ট, সেপ্টেম্বর, অক্টোবর ও নভেম্বরের পর বছরের শেষ মাস ডিসেম্বরেও বেশি রেমিটেন্স পাঠাচ্ছেন প্রবাসীরা।
বাংলাদেশ ব্যাংক রবিবার রেমিটেন্স প্রবাহের সাপ্তাহিক যে তথ্য প্রকাশ করেছে, তাতে দেখা যায়, চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছরের ষষ্ট মাস ডিসেম্বরের প্রথম সাত দিনে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে অবস্থানকারী প্রবাসীরা ব্যাংকিং চ্যানেলে ৬১ কোটি ৬৪ লাখ ৫০ হাজার (১.৭২ বিলিয়ন) ডলার দেশে পাঠিয়েছেন।
বর্তমান বিনিময় হার (প্রতি ডলার ১২০ টাকা) হিসাবে টাকার অঙ্কে এই অর্থের পরিমাণ ৭ হাজার ৩৯৭ কোটি টাকা। প্রতিদিনের গড় হিসাবে এসেছে ৮ কোটি ৮০ লাখ ডলার; টাকার অঙ্কে যা এক হাজার ৫৬ কোটি টাকা।
বাকি ২৪ দিন এই হারে এলে গত চার মাসের মতো ডিসেম্বরেও ২ বিলিয়ন (২০০ কোটি) ডলারের বেশি রেমিটেন্স আসবে।
গত বছরের ডিসেম্বরে ১৯৯ কোটি ১২ লাখ (১.৯৯ বিলিয়ন) ডলার পাঠিয়েছিলেন প্রবাসীরা।
চলতি অর্থবছরের চতুর্থ মাস অক্টোবরে ২৩৯ কোটি ৫১ লাখ (২.৩৯ বিলিয়ন) ডলার রেমিটেন্স আসে, যা গত বছরের অক্টোবরের চেয়ে ২১ দশমিক ৫০ শতাংশ বেশি।
চলতি অর্থবছরের পঞ্চম মাস নভেম্বরে ২১৯ কোটি ৯৫ লাখ (২ বিলিয়ন) ডলার রেমিটেন্স এসেছে, যা গত বছরের নভেম্বরের চেয়ে ১৪ শতাংশ বেশি। চতুর্থ মাস অক্টোবরে ২৩৯ কোটি ৫১ লাখ (২.৩৯ বিলিয়ন) ডলার রেমিটেন্স এসেছে দেশে; প্রবৃদ্ধি হয়েছিল ২১ দশমিক ৫০ শতাংশ বেশি।
তৃতীয় মাস সেপ্টেম্বরে এসেছিল ২৪০ কোটি ৪৮ লাখ (২.৪০ বিলিয়ন) ডলার। দ্বিতীয় মাস আগস্টে এসেছিল ২২২ কোটি ৪১ লাখ (২.২২ বিলিয়ন) ডলার। প্রথম মাস জুলাইয়ে এসেছিল ১৯১ কোটি ৩৭ লাখ (১.৯১ বিলিয়ন)।
অর্থবছরের পাঁচ মাসের (জুলাই-নভেম্বর) হিসাবে রেমিটেন্স এসেছে এক হাজার ১১৩ কোটি ৭৩ লাখ (১১.১৪ বিলিয়ন) ডলার, যা গত বছরের একই সময়ের চেয়ে ২৬ দশমিক ৪৪ শতাংশ বেশি। ২০২৩-২৪ অর্থবছরের জুলাই-নভেম্বর সময়ে ৮৮০ কোটি ৮৪ লাখ (৮.৮১ বিলিয়ন) প্রবাসী আয় এসেছিল।
সব মিলিয়ে ২০২৪-২৫ অর্থবছরের পাঁচ মাস ৭ দিনে (১ জুলাই থেকে ৭ ডিসেম্বর) ১ হাজার ১৭৫ কোটি ৩৭ লাখ (১১.৭৫ বিলিয়ন) ডলার রেমিটেন্স এসেছে দেশে।
কোটা সংস্কার আন্দোলনকে ঘিরে দেশজুড়ে সহিংসতা, মৃত্যু, ইন্টারনেট বন্ধ, কারফিউ, মামলা, গ্রেপ্তার ও প্রবাসীদের উৎকণ্ঠার প্রেক্ষাপটে জুলাই মাসে রেমিটেন্স কমেছিল বলে মনে করেন অর্থনীতিবিদ ও ব্যাংকাররা।
ওই সময় আন্দোলনকে ঘিরে সংঘাত-সহিংসতার জন্য সরকারকে দায়ী করে রেমিটেন্স না পাঠাতে সোশাল মিডিয়ায় প্রবাসীদের প্রতি আহ্বান জানিয়েছিলেন কেউ কেউ।
আন্দোলনে সৃষ্ট সহিংস পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে ১৯ জুলাই রাতে কারফিউ জারি করে আওয়ামী লীগ সরকার। এরপর ২৩ জুলাই পর্যন্ত ব্যাংক বন্ধ ছিল। ইন্টারনেট সংযোগ না থাকায় ব্যাংকের অনলাইন লেনদেনও বন্ধ ছিল।
কয়েক দিন লেনদেন বন্ধের পর ২৪ জুলাই ব্যাংক চালু হয়। ব্যাংকিং কার্যক্রম বন্ধ থাকায় ১৯ জুলাই থেকে ২৩ জুলাই বৈধ পথে তথা ব্যাংকের মাধ্যমে দেশে কোনও প্রবাসী আয় আসেনি।
৫ আগস্ট শেখ হাসিনা সরকারের পদত্যাগের পর রেমিটেন্স প্রবাহে আরও ধীরগতি লক্ষ্য করা যায়। ৮ আগস্ট ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে যাত্রা শুরু হয় অন্তর্বর্তী সরকারের; রেমিটেন্স প্রবাহেও গতি ফেরে।
দেশে দীর্ঘদিন ধরে বিদেশি মুদ্রার সঙ্কট চলছে। কোভিড মহামারীর সময়ে আমদানি তলানিতে নামায় একপর্যায়ে রিজার্ভ ৪৮ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়ে গিয়েছিল। কিন্তু রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ শুরুর পর বিশ্ববাজারে সব ধরনের পণ্যের দাম বেড়ে যাওয়ায় আমদানি খরচ অনেক বেড়ে যায়। একই সাথে প্রবাসী আয় ও রপ্তানিতে যথেষ্ট প্রবৃদ্ধি না হওয়ায় রিজার্ভ দ্রুত কমতে থাকে।
সঙ্কট কাটাতে ও রিজার্ভ বাড়াতে প্রবাসী আয়সহ বিদেশ থেকে অর্থ আনতে নানা ধরনের পদক্ষেপ নিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। গত কয়েক মাসে এসব পদক্ষেপের ইতিবাচক প্রভাব পড়েছে প্রবাসী আয়ে।
গত ২০২৩-২৪ অর্থবছরে ২৩ দশমিক ৯১ বিলিয়ন ডলার রেমিটেন্স এসেছিল দেশে, যা ছিল আগের অর্থবছরের (২০২২-২৩) চেয়ে ১০ দশমিক ৬৫ শতাংশ বেশি।
রিজার্ভ বাড়ছে
রিজার্ভের প্রধান দুই উৎস হচ্ছে রপ্তানি আয় ও প্রবাসীদের পাঠানো অর্থ। এই দুই সূচক বাড়ায় রিজার্ভ বাড়ছে।
গত বৃহস্পতিবার (৪ ডিসেম্বর) বাংলাদেশ ব্যাংক যে ‘উইকলি সিলেক্টেড ইকোনমিক ইন্ডিকেটরস’ প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে, তাতে দেখা যায়, আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) হিসাব পদ্ধতি বিপিএম-৬ (ব্যালেন্স অব পেমেন্ট অ্যান্ড ইন্টারন্যাশনাল ইনভেস্টমেন্ট পজিশন) হিসাবে বাংলাদেশের রিজার্ভ ছিল ১৮ দশমিক ৮৪ বিলিয়ন ডলার। ‘গ্রস’ হিসাবে ছিল ২৪ দশমিক ৮৪ বিলিয়ন ডলার।
এক সপ্তাহ আগে ২৮ নভেম্বর রিজার্ভ ছিল ১৮ দশমিক ৭৩ বিলিয়ন ডলার। ‘গ্রস’ হিসাবে ছিল ২৪ দশমিক ৪৫ বিলিয়ন ডলার।
দুই সপ্তাহ আগে ২০ নভেম্বর বিপিএম-৬ হিসাবে রিজার্ভের পরিমাণ ছিল ১৮ দশমিক ৫০ বিলিয়ন ডলার। ‘গ্রস’ হিসাবে ছিল ২৪ দশমিক ২৭ বিলিয়ন ডলার।
এ হিসাবে দেখা যাচ্ছে, সপ্তাহের ব্যবধানে বিপিএম-৬ হিসাবে রিজার্ভ বেড়েছে ১১ কোটি ডলার। দুই সপ্তাহের ব্যবধানে বেড়েছে ৩৪ কোটি ডলার।
গত ১২ নভেম্বর এশিয়ান ক্লিয়ারিং ইউনিয়নের (আকু) সেপ্টেম্বর-অক্টোবর মেয়াদের ১ দশমিক ৫০ বিলিয়ন ডলার আমদানি বিল পরিশোধের পর বিপিএম-৬ হিসাবে রিজার্ভ কমে ১৮ দশমিক ৪৬ বিলিয়ন ডলারে নেমে এসেছিল। ‘গ্রস’ হিসাবে রিজার্ভ নেমেছিল ২৪ দশমিক ১৭ বিলিয়ন ডলারে।
তার আগে ৭ নভেম্বর বিপিএম-৬ হিসাবে রিজার্ভ ছিল ২০ বিলিয়ন ডলার। ‘গ্রস’ হিসাবে ছিল ২৫ দশমিক ৭৩ বিলিয়ন ডলারে।
বাংলাদেশ ব্যাংক প্রতি সপ্তাহের শেষ দিন বৃহস্পতিবার ‘উইকলি সিলেক্টেড ইকোনমিক ইন্ডিকেটরস’ প্রতিবেদন প্রকাশ করে। তাতে রিজার্ভের পাশপাশি অর্থনীতির গুরুত্বপূর্ণ সূচকের হালনাগাদ তথ্য পাওয়া যায়।