সিরিয়ার জনগণ ৫৪ বছর ধরে ‘আসাদের সিরিয়া’ নামে পরিচিত একটি দেশে জীবনযাপন করছিল। দেশটির শিশুদের শেখানো হতো যে, দেয়ালেরও কান আছে। ভুল কথা বললে মানুষ গুম হয়ে যেতে পারে। আসাদ সরকারের একদলীয় শাসনব্যবস্থা এবং পারিবারিক কর্তৃত্ব বজায় রাখতে দেশজুড়ে ‘মুখাবারাত’ নামে পরিচিত গোপন পুলিশের বিভিন্ন শাখা কাজ করত।
প্রেসিডেন্ট বাশার আল-আসাদ এবং তার প্রয়াত পিতা হাফিজ আল-আসাদ বিরাজমান ছিলেন দেশের সর্বত্র। তাদের ছবি, পোস্টার ও ভাস্কর্যে ছেয়ে ছিল সিরিয়া। সেসব এই সপ্তাহে দীর্ঘদিনের দমন-পীড়নের ক্ষোভ থেকে ভেঙে ফেলা হয়েছে।
‘আসাদের সিরিয়া’র পতন তীব্র এবং আকস্মিক ছিল। কয়েক বছরের বিরতির পর আসাদের সশস্ত্র প্রতিপক্ষরা মাত্র ১২ দিনে তার শাসন উল্টে দিতে সক্ষম হয়। গত রবিবার সকালে রাজধানী দামেস্কের পতন ছিল প্রায় ১৪ বছরের দীর্ঘ সংগ্রামের চূড়ান্ত পরিণতি।
২০১১ সালের মার্চে শান্তিপূর্ণ বিক্ষোভের মাধ্যমে শুরু হওয়া এই আন্দোলন একসময় বিশৃঙ্খল গৃহযুদ্ধে রূপ নেয়। সিরিয়ার জনগণ শান্তিপূর্ণ প্রতিবাদ শুরু করেছিল, কিন্তু সরকার তাদের ওপর সহিংস দমন-পীড়ন চালায়। ফলে তা দ্রুত একটি রক্তক্ষয়ী গৃহযুদ্ধে পরিণত হয়। এতে বিভিন্ন বিদ্রোহী দল, বিদেশি জিহাদি যোদ্ধা এবং সিরিয়ার সামরিক বাহিনী একে অপরের বিরুদ্ধে লড়াই করেছিল।
২০১৮ সাল থেকে সিরিয়ার সংঘাত কার্যত অচলাবস্থায় ছিল। দেশটি কেবল নামেই ঐক্যবদ্ধ ছিল। উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলীয় ইদলিব প্রদেশ ছিল হায়াত তাহরির আল-শাম (এইচ.টি.এস.) নামে পরিচিত সুন্নি ইসলামপন্থীদের নিয়ন্ত্রণে, যা আগে আল-কায়েদার সিরীয় শাখা জাবহাত আল-নুসরা বা নুসরা ফ্রন্ট নামে পরিচিত ছিল।
তেলসমৃদ্ধ উত্তর-পূর্ব অঞ্চল প্রথমে আইএসআইএস এবং পরে কুর্দি নেতৃত্বাধীন সিরিয়ান ডেমোক্র্যাটিক ফোর্সেস (এসডিএফ)-এর অধীনে ছিল, যারা যুক্তরাষ্ট্র সমর্থিত। আজাজ শহরের আশেপাশের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চল ছিল তুরস্ক সমর্থিত সিরিয়ান ন্যাশনাল আর্মির নিয়ন্ত্রণে। দক্ষিণের কিছু অংশে জর্ডান-সমর্থিত বিদ্রোহী দলগুলো প্রভাব বিস্তার করেছিল। বাকি অংশ ছিল আসাদ সরকারের নিয়ন্ত্রণে।
গত ২৭ নভেম্বর যখন লেবাননে ইসরায়েল ও হেজবুল্লাহর মধ্যে যুদ্ধবিরতি কার্যকর হয়, একই দিনে হায়াত তাহরির আল-শাম (এইচটিএস) এবং তাদের মিত্ররা ইদলিবের ঘাঁটি থেকে হঠাৎ দক্ষিণে অগ্রসর হয়। বিদ্রোহীদের হাতে শহরগুলোর একের পর এক দ্রুত পতন ঘটে।
যুক্তরাষ্ট্রের দীর্ঘদিনের অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা, শাসনব্যবস্থার দুর্নীতি এবং ইসরায়েলি বিমান হামলায় ক্ষতিগ্রস্ত রাষ্ট্রীয় বাহিনীর কাছ থেকে তেমন কোনও প্রতিরোধ দেখা যায়নি।
পঞ্চাশ বছরেরও বেশি সময় ধরে আল-বাথ পার্টি এবং আল-আসাদ পরিবার শাসিত এই দেশটি একসময় ইসলামের উমাইয়া খেলাফতের কেন্দ্র ছিল। এটি আরব জাতীয়তাবাদের জন্মভূমিগুলোর একটি।
আল-আসাদ পরিবারের ৫৪ বছরের শাসনের আকস্মিক পতনকে সিরিয়ার জন্য একটি ঐতিহাসিক মুহূর্ত হিসাবে বিবেচনা করা হচ্ছে। ইসলামি সংগঠন হায়াত তাহরির আল শামের ক্ষমতা দখলের মধ্য দিয়ে দেশটি একটি আধুনিক ইসলামি প্রজাতন্ত্র হিসাবে আবির্ভূত হতে যাচ্ছে। এই দলটির নেতা আবু মোহাম্মদ আল জুলানি এক সময় আল কায়দায় যুক্ত ছিলেন।
৬৩৬ খ্রিস্টাব্দে মুসলিম বীর খালিদ বিন ওয়ালিদের দামেস্ক বিজয়ের মধ্য দিয়ে প্রথম সিরিয়া অঞ্চল ইসলামি শাসনে এসেছিল। প্রথম বিশ্বযুদ্ধ পর্যন্ত (১৯১৮) সর্বশেষ অটোমানদের অধীনে সিরিয়া মুসলিম শাসনে ছিল। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পর্যন্ত দেশটি ফরাসিদের অধীনে ছিল।
১৯৪৬ সালে সিরিয়া একটি স্বাধীন আরব জাতীয়তাবাদী ও ধর্মনিরপেক্ষ আধুনিক জাতিরাষ্ট্র হিসাবে যাত্রা শুরু করে। গত ৮ ডিসেম্বর সেই রাষ্ট্রব্যবস্থার অবসান ঘটে। ক্ষমতায় আসে ইসলামপন্থী সংগঠন এইচটিএসের নেতৃত্বাধীন বিদ্রোহীদের জোট। এই জোটে গণতন্ত্রপন্থী ন্যাশনাল ফ্রন্ট ফর লিবারেশন সহ আরও কয়েকটি ইসলামি সংগঠন এবং কুর্দি বিদ্রোহীদের জোট সিরিয়ার ডেমোক্রেটিক ফোর্সও রয়েছে।
ইতিহাসের বাঁকে বাঁকে সিরিয়া
সিরিয়া পশ্চিম এশিয়ার একটি দেশ, যা পূর্ব ভূমধ্যসাগর উপকূল এবং লেভান্ত অঞ্চলে অবস্থিত। এর পশ্চিমে ভূমধ্যসাগর, উত্তরে তুরস্ক, পূর্ব ও দক্ষিণ-পূর্বে ইরাক, দক্ষিণে জর্ডান, এবং দক্ষিণ-পশ্চিমে ইসরায়েল ও লেবানন। দেশটি ১৪টি গভর্নরেট নিয়ে গঠিত একটি প্রজাতন্ত্র।
দেশটির রাজধানী ও সবচেয়ে বড় শহর হলো দামেস্ক। ১ লাখ ৮৫ হাজার ১৮০ বর্গকিলোমিটার আয়তনের দেশটিতে প্রায় ২ কোটি ৫০ লাখ মানুষের বাস রয়েছে। জনসংখ্যার দিক থেকে এটি বিশ্বের ৫৭তম এবং আয়তনের দিক থেকে ৮৭তম দেশ।
‘সিরিয়া’ নামটি ঐতিহাসিকভাবে একটি বৃহত্তর অঞ্চলকে নির্দেশ করে, যা লেভান্তের সমার্থক এবং আরবিতে ‘আল-শাম’ নামে পরিচিত। সিরিয়া বহু প্রাচীন রাজ্য ও সাম্রাজ্যের কেন্দ্র ছিল। এর সবচেয়ে প্রাচীন সভ্যতা খ্রিস্টপূর্ব তৃতীয় সহস্রাব্দের এবলান রাজত্ব।
প্রাচীন যুগে এই ভূখণ্ড সুমেরীয়, মিতানীয়, অ্যাসিরীয়, ব্যাবিলনীয়, মিশরীয়, হিট্টীয়, কানানীয়, ফিনিশীয়, আরামীয়, আমোরীয়, পারসীয়, গ্রিক এবং রোমান সাম্রাজ্যের শাসনের অধীনে ছিল। পূর্ব রোমান বা বাইজান্টাইনদের হাত থেকে অঞ্চলটি আসে মুসলমানদের শাসনে।
খ্রিস্টপূর্ব ৩৫০০-২৩০০ সাল পর্যন্ত প্রথম এবলা রাজত্ব ছিল অঞ্চলটির প্রাচীনতম স্বদেশীয় সভ্যতা। এবলা তৃতীয় সহস্রাব্দের পুরো সময় এবং দ্বিতীয় সহস্রাব্দের প্রথমার্ধে একটি গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্র ছিল। এই সভ্যতার আবিষ্কার প্রমাণ করেছে যে, লেভান্ত অঞ্চল প্রাচীনকালে কেন্দ্রীয় সভ্যতার একটি গুরুত্বপূর্ণ স্থান ছিল। এটি মিশর ও মেসোপটেমীয় সভ্যতার সমান মর্যাদাপূর্ণ ছিল।
প্রথম এবলান রাজ্যকে মানবেতিহাসের প্রথম স্বীকৃত বিশ্বশক্তি হিসাবেও বর্ণনা করা হয়। প্রথমে এটি খ্রিস্টপূর্ব ৩৫০০ সালে প্রারম্ভিক ব্রোঞ্জ যুগে একটি ছোট বসতি হিসেবে গড়ে ওঠে। পরে এবলা একটি বাণিজ্য সাম্রাজ্য এবং এরপর একটি বিস্তৃত শক্তিতে রূপ নেয়, যা উত্তর ও পূর্ব সিরিয়ার বেশিরভাগ অঞ্চলে আধিপত্য বিস্তার করেছিল। খ্রিস্টপূর্ব ১৬০০ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত পরপর তিনটি এবলা রাজত্ব গড়ে উঠেছিল।
ব্রোঞ্জ যুগে সিরিয়া ছিল হিট্টীয়, মিশরীয়, অ্যাসিরীয়, মিতানীয় এবং ব্যাবিলনীয় সাম্রাজ্যের মধ্যে প্রতিদ্বন্দ্বিতার প্রধান যুদ্ধক্ষেত্র। হিট্টীয়, অ্যাসিরীয় এবং ব্যাবিলনীয় সাম্রাজ্য পর্যায়ক্রমে এই অঞ্চল শাসন করে।
খ্রিস্টপূর্ব ১২৭৪ সালে কাদেশের যুদ্ধে মিশরের ফেরাউন রামেসেস দ্বিতীয় এবং হিট্টীয় রাজা মুওয়াতাল্লি দ্বিতীয় একে অপরের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেন। এটি প্রাচীন নিকটপ্রাচ্যের সবচেয়ে ভালোভাবে নথিবদ্ধ যুদ্ধ এবং এতে বিশ্বের প্রথম সংরক্ষিত শান্তি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়।
খ্রিস্টপূর্ব ৫৩৯ সালে সিরিয়া পারস্যের আখেমেনিদ সাম্রাজ্যের অংশ হয়। খ্রিস্টপূর্ব ৩৩০ সালে আলেকজান্ডার দ্য গ্রেটের নেতৃত্বে গ্রিকরা পারসিকদের হাত থেকে সিরিয়া দখল করে নেয়। তার মৃত্যুর পর এটি সেলিউসিড সাম্রাজ্যের অংশ হয়ে যায়।
খ্রিস্টপূর্ব ৬৩ সালে রোমান সেনাপতি পম্পি দ্য গ্রেট সিরিয়া দখল করে এবং এটি রোমান প্রদেশে পরিণত হয়। খ্রিস্টাব্দ ৫ম শতকে পশ্চিম রোমান সাম্রাজ্যের পতনের পর সিরিয়া পূর্ব রোমান বা বাইজেন্টাইন সাম্রাজ্যের অংশ হয়ে পড়ে।
মুসলিম বিজয়
সপ্তম শতাব্দীতে মুসলিম বিজয়ীরা আরব উপদ্বীপ থেকে এই অঞ্চলে প্রবেশ করে। ৬৩৬ খ্রিস্টাব্দে ইয়রমুকের যুদ্ধে আরব বাহিনী বাইজেন্টাইন বাহিনীকে পরাজিত করে সিরিয়া অধিকার করে। তখন থেকেই আরবরা সিরিয়ায় কয়েক শতাব্দী ধরে বসবাস করছিল। মুআবিয়া বিন আবু সুফিয়ান ‘গ্রেটার সিরিয়া’র প্রথম শাসক এবং প্রথম উমাইয়া খলিফা হন।
৬৫০ খ্রিস্টাব্দে উমাইয়া রাজবংশ দামেস্ককে তাদের সাম্রাজ্যের রাজধানী হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করে। সেসময় সিরিয়া চারটি অঞ্চলে বিভক্ত ছিল— দামেস্ক, হোমস, ফিলিস্তিন ও জর্ডান। উমাইয়াদের সময় ইসলামি সাম্রাজ্য দ্রুত বিস্তার লাভ করে এবং স্পেন থেকে ভারত এবং মধ্য এশিয়ার কিছু অংশ মুসলিম শাসনে আসে। ফলে সিরিয়া অর্থনৈতিকভাবে সমৃদ্ধ হয়ে ওঠে, কারণ এটি ছিল সেই সাম্রাজ্যের কেন্দ্রস্থল।
৭৫০ সালে আব্বাসীয়রা উমাইয়া রাজবংশকে উৎখাত করে এবং ইসলামি সাম্রাজ্যের রাজধানী বাগদাদে স্থানান্তরিত করে। আব্বাসীয়দের হাত থেকে মিসরের তুলুনিদরা (৮৮৭–৯০৫) সিরিয়া দখল করে নেয়। তুলুনিদদের পর কিছু সময় বিশৃঙ্খলার পর সিরিয়া মিশরের ইখশিদিদের (৯৪১–৯৬৯) অধীনে যায়। এরপর আলেপ্পোর হামদানিদের উত্থান ঘটে।
বাইজেন্টাইনরা ফের ৯৬৯ সালে অ্যানটিওক এবং আলেপ্পো দখল করে। এর পর সিরিয়া বিশৃঙ্খলার মধ্যে পড়ে, যা হামদানি, বাইজেন্টাইন এবং দামেস্কভিত্তিক ফাতিমিদের মধ্যে সংঘর্ষের ক্ষেত্র হয়ে ওঠে।
৯৯৬ সালের মধ্যে বাইজেন্টাইনরা পুরো সিরিয়া দখল করে নিলেও, ১১শ শতাব্দীর বেশিরভাগ সময় বিশৃঙ্খলা অব্যাহত থাকে, কারণ বাইজেন্টাইন, ফাতিমি এবং বাগদাদের বুয়িদদের মধ্যে আধিপত্যের জন্য সংগ্রাম চলছিল।
এরপর, ১০৮৪-১০৮৬ সালে সেলজুক তুর্কিরা মালিক-শাহ প্রথমের শাসনকালে সিরিয়া দখল করে। পরে, ১১৫৪ সালে জেঙ্গিদ রাজবংশের নূর-দিন আলেপ্পো এবং দামেস্কের মধ্যবর্তী এলাকা দখল করেন, যা বুরিদ রাজবংশের কাছ থেকে নেওয়া হয়েছিল। পরবর্তীকালে ১১৭৫-১১৮৫ সালের মধ্যে সালাদিন, যিনি মিসরের আইউবি রাজবংশের প্রতিষ্ঠাতা, সিরিয়া দখল করেন।
ক্রুসেড (১০৯৫-১২৯২)
প্রথম ক্রুসেড ১০৯৫ সালে শুরু হয়। ওই সময়ে পোপ আরবান (দ্বিতীয়) বাইজেন্টাইন সাম্রাজ্যকে সাহায্য করতে একটি সামরিক অভিযান আহ্বান করেন, যাতে সেলজুক (তুর্কি) আক্রমণকারীদের বিরুদ্ধে লড়াই করা যায়। এছাড়া, ক্রুসেডগুলোর উদ্দেশ্য ছিল খ্রিস্টানদের পবিত্র ভূমি জেরুজালেম অধিকার করা।
ক্রুসেডারদের বিরুদ্ধে জিহাদে নেমে ফাতিমি আমির নূর আল-দিন (১১১৬-১১৭৪) দামেস্ক দখল করে সিরিয়ানদের একত্রিত করেন। নূর আল-দিন সালাদিনকে মিসরে সিরীয় বাহিনীর কমান্ডার এবং উজির হিসাবে নিয়োগ করেন। এর কয়েকবছর পর সালাদিন ফাতিমি (শিয়া) শাসন উচ্ছেদ করে তার আইউবি রাজবংশ প্রতিষ্ঠা করেন। ১১৮৭ সালের হিট্টিনের যুদ্ধ ছিল তার একটি বিখ্যাত বিজয়।
১২ ও ১৩ শতাব্দীতে সিরিয়ার কিছু অংশ ক্রুসেডার রাজ্যগুলোর অধীনে ছিল— এডেসার কাউন্টি (১০৯৮–১১৪৯), অ্যানটিওকের প্রিন্সিপ্যালিটি (১০৯৮–১২৬৮) এবং ত্রিপোলির কাউন্টি (১১১০–১২৮৯)।
দাস রাজবংশ (১২৯১–১৫১৭)
সালাদিনের মৃত্যুর ৫০ বছর পর ১১৯৩ সালে আইউবি রাজবংশের পতন ঘটে এবং মামলুক বা দাসরা মিসরে শাসন শুরু করে।
এদিকে, ১২৫০ সালের মধ্যে মঙ্গোলরা মধ্য এশিয়া এবং পশ্চিম এশিয়ার অধিকাংশ দেশ আক্রমণ করে। মধ্যপ্রাচ্যে, মঙ্গোলরা বাগদাদ হয়ে দামেস্কেও প্রবেশ করে এবং আলেপ্পো ভেদ করে যায়। ১২৬০ সালে আইন জালুতের যুদ্ধে মামলুকরা মঙ্গোলদের পরাজিত করে এবং সিরিয়া ও লেবানন দখল করে।
১৪০০ সালে মোঙ্গল সম্রাট তৈমুর লং ফের সিরিয়া আক্রমণ করেন। তিনি আলেপ্পোর যুদ্ধে মামলুক বাহিনীকে পরাজিত করেন এবং দামেস্ক দখল করেন।
অটোমান সাম্রাজ্য (১৫১৬–১৯১৪)
১৫১৬ সালে লেভান্ত অঞ্চলের অংশ হিসাবে সিরিয়াও অটোমান সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত হয়। সিরিয়া প্রথম বিশ্বযুদ্ধ (১৯১৪–১৯১৮) পর্যন্ত অটোমান শাসনের অধীনে ছিল। যুদ্ধ চলাকালে আরব ও ব্রিটিশ বাহিনী তুর্কি শাসকদের এই অঞ্চল থেকে বিতাড়িত করে।
অটোমান শাসনের শেষ সময়ে বৃহত্তর সিরিয়ার অন্তর্ভুক্ত ছিল— বর্তমান সিরিয়া, লেবানন, ইসরায়েল, জর্ডান, ফিলিস্তিন, এবং তুরস্ক ও ইরাকের কিছু অংশ।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় অটোমান সাম্রাজ্য জার্মানি ও অস্ট্রো-হাঙ্গেরিয়ান সাম্রাজ্যের পক্ষে যুদ্ধে যোগ দেয়। যুদ্ধে তারা পরাজিত হয় এবং অটোমানদের অধীনে থাকা নিকট প্রাচ্যের পুরো অঞ্চল ব্রিটিশ ও ফরাসি সাম্রাজ্যের নিয়ন্ত্রণে চলে যায়।
যুদ্ধ চলাকালে, ১৯১৬ সালে দুই মিত্র কূটনীতিক— ফ্রান্সের ফ্রাঁসোয়া জর্জ-পিকো এবং ব্রিটেনের মার্ক সাইকস— অটোমান সাম্রাজ্যের যুদ্ধ-পরবর্তী বিভাজন নিয়ে সাইকস-পিকো চুক্তি গোপনে সম্পাদন করেন। প্রথমে, দুটি অঞ্চলকে একটি প্রায় সোজা সীমান্তরেখা দিয়ে বিভক্ত করা হয়েছিল, যা জর্ডান থেকে ইরান পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল।
যুদ্ধের শেষের দিকে মসুল অঞ্চলে তেলের সন্ধান মেলে। এর ফলে, ১৯১৮ সালে ফ্রান্সের সঙ্গে আরেকটি চুক্তি হয়, যেখানে এই অঞ্চলটি ব্রিটিশ প্রভাবাধীন অঞ্চলে (পরবর্তীকালে যা ইরাক হয়) অন্তর্ভুক্ত করা হয়। মধ্যবর্তী জোর প্রদেশের ভাগ্য অস্পষ্ট ছিল, তবে আরব জাতীয়তাবাদীদের দখলে আসায় এটি সিরিয়ার সঙ্গে যুক্ত হয়।
এই সীমান্ত ১৯২০ সালে সিরিয়া যখন লীগ অব নেশনের ম্যান্ডেট হিসেবে স্বীকৃতি পায়, তখন আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত হয় এবং তা আজও অপরিবর্তিত রয়েছে।
ফরাসি ম্যান্ডেট (১৯২০-১৯৪৬)
১৯২০ থেকে ১৯৪৬ সালের মধ্যে সিরিয়া ফরাসিদের অধীনে ছিল। এই সময়ে দেশটি ব্যাপক রাজনৈতিক অস্থিরতার শিকার হয় এবং জাতীয়তাবাদী রাজনীতির উত্থান ঘটে। তারা স্বাধীনতার জন্য লড়াই শুরু করেন।
১৯৩০ সালের ১৪ মে ফরাসি হাই কমিশনার সিরিয়া রাষ্ট্রের জন্য একটি সংবিধান প্রণয়ন করেন। ২২ মে সিরিয়া রাষ্ট্রকে সিরিয়া প্রজাতন্ত্র ঘোষণা করা হয় এবং নতুন সংবিধান চালু করা হয়।
সেপ্টেম্বর ১৯৩৬ সালে সিরিয়ার জাতীয়তাবাদীদের সঙ্গে ফ্রান্স স্বাধীনতার জন্য একটি চুক্তি স্বাক্ষর করে। ফ্রান্স নীতিগতভাবে সিরিয়ার স্বাধীনতা মেনে নিলেও সামরিক এবং অর্থনৈতিক প্রভাব বজায় রাখে।
সিরিয়ার আধুনিক প্রজাতন্ত্রের প্রথম নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট হন হাশিম আল-আতাসি। তবে, চুক্তিটি কার্যকর হয়নি কারণ ফরাসি আইনসভা এটি অনুমোদন করতে অস্বীকৃতি জানায়।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হওয়ার পর সিরিয়ার আধুনিক জাতীয়তাবাদীরা ১৯৪১ সালে পুনরায় স্বাধীনতা ঘোষণা করে। তবে ১৯৪৪ সালের ১ জানুয়ারি এটি স্বাধীন প্রজাতন্ত্র হিসেবে আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি পায়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষে ১৯৪৫ সালে ফরাসি সৈন্য প্রত্যাহারের ধীরগতির কারণে সিরিয়ায় বিক্ষোভ শুরু হয়। ফরাসিরা এই বিক্ষোভ দমন করতে হামলা চালায়।
এমন পরিস্থিতিতে ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রী উইনস্টন চার্চিলের নির্দেশে ব্রিটিশ বাহিনী সিরিয়ায় প্রবেশ করে। তারা ১ জুন ফরাসি বাহিনীকে তাদের ব্যারাকে ফিরিয়ে নিয়ে যায়। ব্রিটিশ এবং সিরিয়ার জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের চাপের মুখে ফরাসি বাহিনী ১৯৪৬ সালের এপ্রিলে শেষ সৈন্য প্রত্যাহার করে। এর মধ্য দিয়ে সিরিয়া পূর্ণ স্বাধীনতা পায় এবং একটি প্রজাতান্ত্রিক সরকার গঠিত হয়।
স্বাধীনতার পর অস্থিরতা
সিরিয়া ১৯৪৬ সালের ১৭ এপ্রিল স্বাধীনতা লাভ করে। স্বাধীনতার পর থেকে ১৯৬০-এর দশকের শেষ পর্যন্ত দেশটির রাজনীতি ছিল অস্থিরতাপূর্ণ। ১৯৪৬ থেকে ১৯৫৬ সালের মধ্যে সিরিয়ায় ২০টি ভিন্ন মন্ত্রিসভা গঠিত হয় এবং চারটি পৃথক সংবিধান প্রণয়ন করা হয়। ১৯৪৮ সালে প্রথম আরব ইসরায়েল যুদ্ধেও যোগ দিয়েছিল সিরিয়া।
এসময় ক্ষমতা মূলত সেনাবাহিনীর নিয়ন্ত্রণে ছিল এবং একের পর এক অভ্যুত্থান ঘটছিল। ১৯৪৭ সালে প্রতিষ্ঠিত আরব সমাজতান্ত্রিক দল বাথ পার্টিও সেনা অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়েই ১৯৬৩ সালে ক্ষমতায় আসে।
তবে তখন সংসদীয় প্রতিষ্ঠানগুলো দুর্বল ছিল। এগুলো মূলত ভূমি মালিক অভিজাত শ্রেণি এবং বিভিন্ন সুন্নি শহুরে নেতাদের নিয়ন্ত্রণে থাকতো। অর্থনীতি সুষ্ঠুভাবে পরিচালিত হয়নি এবং গ্রামের কৃষক সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণের উন্নতির জন্য তেমন কিছু করা হয়নি।
১৯৫৬ সালে সুয়েজ সংকট এবং দ্বিতীয় আরব-ইসরায়েল যুদ্ধের পর সিরিয়া সোভিয়েত ইউনিয়নের সঙ্গে একটি চুক্তি স্বাক্ষর করে। এই চুক্তির মাধ্যমে সরকারে কমিউনিস্ট প্রভাবের সুযোগ তৈরি হয়। বিনিময়ে সোভিয়েত ইউনিয়ন সিরিয়ায় বিমান, ট্যাংক এবং অন্যান্য সামরিক সরঞ্জাম সরবরাহ করে।
এসময় মিশরের নাসেরবাদ বা প্যান-আরব মতবাদ এবং সাম্রাজ্যবাদবিরোধী আদর্শ সিরিয়া ও মিসরের মধ্যে ঘনিষ্ঠ সম্পর্কের ধারণাকে শক্তিশালী করে তোলে। সুয়েজ সংকটের পর মিসরের প্রেসিডেন্ট গামাল আবদেল নাসেরের নেতৃত্বের প্রতি সিরিয়ায় ব্যাপক সমর্থন তৈরি হয়।
১৯৫৮ সালের ১ ফেব্রুয়ারি সিরিয়ার প্রেসিডেন্ট আল-কুয়াতলি এবং মিশরের প্রেসিডেন্ট নাসের দুই দেশকে একত্রিত করে সংযুক্ত আরব প্রজাতন্ত্র (ইউএআর) গঠনের ঘোষণা দেন। তবে, এই ঐক্য সফল হয়নি। মাত্র চার বছরেরও কম সময় তা টিকে ছিল
সিরিয়ার ওপর মিশরের আধিপত্যের কারণে অসন্তুষ্টি দেখা দিলে আবদ আল-করিম আল-নাহলাওয়ির নেতৃত্বে বিরোধী গোষ্ঠী ১৯৬১ সালের ২৮ সেপ্টেম্বর ক্ষমতা দখল করে। দুই দিন পর, মিশর থেকে আলাদা হয়ে সিরিয়া পুনরায় নিজেকে সিরিয়া আরব প্রজাতন্ত্র হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করে। ১৯৬০-এর দশকে বারবার সামরিক অভ্যুত্থান, বিদ্রোহ, অসন্তোষ এবং রক্তক্ষয়ী দাঙ্গা দেশটির রাজনীতিকে অস্থির করে তোলে।
বাথ পার্টির অধীনে সিরিয়া
১৯৬৩ সালে বাথপন্থী অভ্যুত্থান সিরিয়ার আধুনিক ইতিহাসে একটি গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন সূচিত করে। এর পর বাথ পার্টি একচেটিয়াভাবে ক্ষমতা দখল করে একদলীয় শাসন ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করে এবং এর রাষ্ট্রীয় মতাদর্শের মাধ্যমে নতুন সামাজিক-রাজনৈতিক ব্যবস্থা গড়ে তোলে।
বাথপন্থী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পর থেকে সিরিয়া একটি সর্বগ্রাসী শাসনব্যবস্থার অধীনে পরিচালিত হতে শুরু করে। এটি এমন একটি শাসনব্যবস্থা যেখানে রাষ্ট্রের পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ থাকে সমাজের সব দিক—রাজনীতি, অর্থনীতি, সংস্কৃতি এবং ব্যক্তিগত জীবন পর্যন্ত। বাথ পার্টির প্রভাব প্রতিদিনের জীবনের সব দিকেই বিস্তৃত হয়। নাগরিক সমাজ, রাজনৈতিক কার্যক্রম, অর্থনীতি, ধর্মীয় জীবন, সংস্কৃতি ও সামাজিক কর্মকাণ্ড— সবকিছুই বাথ পার্টির সংগঠন এবং গোপন পুলিশের মাধ্যমে নজরদারি, নিয়ন্ত্রণ ও দমন করা হয়।
১৯৬৬ সালের প্রথম দিকে বাথ পার্টির জাতীয় কমান্ডকে ক্ষমতাচ্যুত করে দলের চরম বামপন্থী সামরিক কমান্ডাররা। এই সেনা অভ্যুত্থানের নেতৃত্ব দেন জেনারেল সালাহ জাদিদ। জাদিদের শাসনামলে সিরিয়া সোভিয়েত ব্লকের সঙ্গে যুক্ত হয় এবং ইসরায়েলের বিরুদ্ধে কঠোর নীতি গ্রহণ করে। পাশাপাশি ‘প্রতিক্রিয়াশীল’ আরব রাষ্ট্র, বিশেষত সৌদি আরবের বিরোধিতা করে এবং আরব সামরিক জোটের বদলে ‘গণযুদ্ধ’ শুরুর আহ্বান জানায়।
দেশের ভেতরে জাদিদ দ্রুতগতিতে সমাজতান্ত্রিক পরিবর্তন আনার চেষ্টা করেন, যা বিশৃঙ্খলা এবং অর্থনৈতিক সংকট সৃষ্টি করে। সরকারবিরোধীদের কঠোরভাবে দমন করা হয়। সংসদের পরিবর্তে বাথ পার্টি আইন প্রণয়নকারী প্রতিষ্ঠান হিসাবে কার্যক্রম চালায় এবং অন্যান্য রাজনৈতিক দল নিষিদ্ধ করা হয়।
১৯৬৭ সালের ছয় দিনের যুদ্ধে ইসরায়েলের হাতে সিরিয়ার পরাজয়ের পর জাদিদের সরকারের প্রতি জনসমর্থন দ্রুত কমতে থাকে। এই যুদ্ধে ইসরায়েল সিরিয়ার বিমান বাহিনীর বড় অংশ ধ্বংস করে এবং গোলান মালভূমি দখল করে নেয়।
১৯৭০ সালের ১৩ নভেম্বর প্রতিরক্ষামন্ত্রী হাফিজ আল-আসাদ রক্তপাতহীন এক সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে ক্ষমতা দখল করেন। এর মধ্য দিয়ে সিরিয়ায় শুরু হয় আসাদ পরিবারের শাসন। গত ৮ ডিসেম্বর তাদের সেই শাসনের অবসান ঘটে।
তথ্যসূত্র : আল জাজিরা, দ্য নিউ ইয়র্কার, এনসাইক্লোপেডিয়া ব্রিটানিকা, উইকিপিডিয়া