বিশ্ব চলচ্চিত্রের অন্যতম মর্যাদাপূর্ণ গ্লোন্ডেন গ্লোব অ্যাওয়ার্ডের জন্য সেরা পরিচালক হিসেবে মনোনীত হয়ে আবারও ভারতীয় শোবিজের আলোচনার মূল কেন্দ্রে পায়েল কাপাডিয়া।
৮২তম আসরে তার সিনেমা অল উই ইমাজিন অ্যাজ লাইট দুটি বিভাগে মনোনীত হয়েছে: সেরা বিদেশি ভাষার চলচ্চিত্র এবং সেরা পরিচালক।
এর আগেও ভারত থেকে বিদেশি ভাষার চলচ্চিত্র ক্যাটাগরিতে ভারতীয় পরিচালক মীরা নায়ারের পরিচালিত চলচ্চিত্র সালাম বোম্বে! (১৯৮৮) এবং মনসুন ওয়েডিং (২০০১), ভি শান্তরামের দো আঁখে বারাহ হাত (১৯৫৭), যৌথ প্রযোজনার গান্ধী (১৯৮২) এবং স্লামডগ মিলিয়নিয়ার (২০০৯)-এর মতো সিনেমা ‘সেরা বিদেশি চলচ্চিত্র’ ক্যাটাগরিতে মনোনয়ন পেয়েছে।
তবে পায়েল কাপাডিয়া ইতিহাস গড়েছেন প্রথম ভারতীয় নারী নির্মাতা হিসেবে গোল্ডেন গ্লোবে সেরা পরিচালক ক্যাটাগরিতে মনোনীত হয়ে।
সম্প্রতি এসএস রাজামৌলি পরিচালিত ভারতীয় সিনেমা আরআরআর (২০২২) ‘নাটু নাটু’ গানের জন্য গোল্ডেন গ্লোব জিতেছিল। তবে সেরা পরিচালক ক্যাটাগরিতে পায়েল কাপাডিয়ার মনোনয়ন নিঃসন্দেহে ভারতীয় সিনেমার এই যাত্রাকে নতুন উচ্চতায় নিয়ে গেছে।
এই বছর অল উই ইমাজিন অ্যাজ লাইট কান চলচ্চিত্র উৎসবে গ্রাঁ প্রিঁ পুরস্কার জেতার পর থেকে চলচ্চিত্রপ্রেমীদের মধ্যে উচ্ছ্বাস এবং কৌতূহল তৈরি করেছে।
পায়েল কাপাডিয়ার সিনেমার গল্প এবং স্বীকৃতি
সিনেমায় মুম্বাই শহরের আবেগঘন গল্প তিনজন নারীর জীবনের মাধ্যমে উপস্থাপন করা হয়েছে। নার্স প্রভা, তার বন্ধু অনু, এবং তাদের আরেক পরিচিত পার্বতীর জীবনের টানাপোড়েন, প্রেম, একাকিত্ব এবং আকাঙ্ক্ষার কাহিনী এই সিনেমার মূল প্রেক্ষাপট।
২০২৪ সালের মে মাসে কান চলচ্চিত্র উৎসবে প্রিমিয়ারের পর থেকে ছবিটি বিশ্বব্যাপী প্রশংসিত হয়। প্রভা এবং অনুর চরিত্রে কানি কুসরতি এবং দিব্যা প্রভা অনবদ্য অভিনয়ের মাধ্যমে মুম্বাই শহরের জীবনের কোলাহল এবং বিষণ্ণতাকে ফুটিয়ে তুলেছেন। এছাড়া পার্বতীর চরিত্রে ছায়া কদম তার অভিনয়ের মাধ্যমে এক গ্রামীণ নারীর সংগ্রামী জীবনের গল্প বলেছেন। ছবির প্রতিটি ফ্রেম মুম্বাইয়ের চেনা-অচেনা জীবনের এক টুকরো বাস্তবতা তুলে ধরে।
অল উই ইমাজিন অ্যাজ লাইট ছিল ৩০ বছর পর কানের মূল প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণকারী কোনো ভারতীয় সিনেমা।
মুম্বাই শহরকে কেন্দ্র করে তৈরি এই চলচ্চিত্রটি বাস্তবতার সঙ্গে কল্পনাকে মিশিয়ে নতুনভাবে গল্প বলার এক অনন্য উদাহরণ। ছবির ‘সিটি সিম্ফনি’ নামে পরিচিত উদ্বোধনী দৃশ্য, যেখানে মুম্বাই শহরের কোলাহল এবং দৈনন্দিন জীবনের গুঞ্জন শ্রুতিমধুর সঙ্গীতের মতো উঠে আসে, দর্শকদের হৃদয় ছুঁয়ে গেছে।
কান চলচ্চিত্র উৎসবের গ্র্যান্ড থিয়েটার লুমিয়েরে-তে পায়েলের চলচ্চিত্রটি প্রিমিয়ারে আট মিনিটের দীর্ঘ স্ট্যান্ডিং ওভেশন (দাঁড়িয়ে করতালি) পেয়েছিল।
পেছনের গল্প
সম্প্রতি এল্লি পত্রিকার প্রতিবেদক একতা সিনহাকে একটি বিশেষ সাক্ষাৎকার দিয়েছেন পায়েল কাপাডিয়া। সেখানে উঠে এসেছে এই সিনেমাটি নিয়ে নানা কথা।
মুম্বাইয়ের মামি মুম্বাই ফিল্ম ফেস্টিভ্যালে ‘অল উই ইমাজিন অ্যাজ লাইট’ -এর প্রিমিয়ার বিশেষ গুরুত্ব রেখেছিল। কাপাডিয়া বলেন, “মামি-তে স্ক্রিনিংটা অসাধারণ ছিল। যেহেতু সিনেমাটি মুম্বাইকে কেন্দ্র করে, দর্শকরা এটি ব্যক্তিগতভাবে সংযোগ করতে পেরেছেন এবং শহর নিয়ে তাদের নিজস্ব গল্পগুলোও শেয়ার করেছেন।”
চলচ্চিত্রটির সবচেয়ে প্রিয় অংশগুলোর একটি হলো এর উদ্বোধনী দৃশ্য, যেটিকে কাপাডিয়া ‘সিটি সিম্ফনি’ বলে বর্ণনা করেছেন। মুম্বাইয়ের শব্দ—গাড়ির হর্ন, দূর থেকে আসা মানুষের কণ্ঠস্বর, এবং জীবনের একটি সাধারণ গুঞ্জন—সবকিছু কাহিনীর সঙ্গে মিশে গেছে। কাপাডিয়া বলেন, “আমি বরাবরই কল্পনা এবং তথ্যচিত্রকে একত্রিত করার প্রতি আগ্রহী।”
চলচ্চিত্রটির আরেকটি স্মরণীয় দৃশ্য হলো, যখন প্রভা তার বন্ধু অনুকে তর্কের মধ্যে ‘স্লাট’ (বেশ্যা) বলে ডাকে। এটি নারীদের মধ্যকার সম্পর্কের অভ্যন্তরীণ বিদ্বেষের বিষয়টি তুলে ধরে।
কাপাডিয়া বলেন, “সমাজ আমাদের নারীদের একে অপরের বিরুদ্ধে যেভাবে প্রতিযোগিতায় নামিয়ে দেয় সেখানে তাদের বন্ধুত্বের মধ্যেও এরকম দেখেছি আমি। কখনো কখনো আমি নিজেও আমার বন্ধুদের নিরাশ করেছি এই কারণে। তাই এই চলচ্চিত্রটি এসব বিষয়কে প্রশ্ন করে। এই ধরনের মনোভাব আমাদের মধ্যে কীভাবে প্রোথিত হয়- এটি সে মুহূর্তকে তুলে ধরে। কিন্তু একই সঙ্গে এও দেখায় যে, নারীরা এই আচরণগুলো ভুলে একে অপরকে আরও ভালোভাবে বুঝতে চেষ্টা করছে।”
কানের সাফল্য নিয়ে তিনি সাক্ষাৎকারে বলেন, “আমি খুবই অবাক হয়েছিলাম, কিন্তু একই সঙ্গে খুশি এবং কৃতজ্ঞও ছিলাম। জুরি বোর্ডে এমন সব চলচ্চিত্র নির্মাতা ছিলেন, যাদের আমি গভীরভাবে শ্রদ্ধা করি—মিস্টার কোরিদা, গ্রেটা গারউইগ, নাদিন লাবাকি—যাদের কাজ আমি বহু বছর ধরে অনুসরণ করেছি। যখন তারা আমাকে বিজয়ী বলে ঘোষণা দেন, তখন মুহূর্তটি আরও বিশেষ এবং স্বপ্নময় মনে হয়েছিল।”
সিনেমার কাহিনী সংক্ষেপ
সিনেমাটি শুরু হয় প্রভার কাছে তার স্বামীর পাঠানো জার্মানি থেকে আসা একটি ‘সারপ্রাইজ গিফট’- হাই-টেক রাইস কুকার নিয়ে। এমনিতে তাদের মধ্যে যোগাযোগ ছিলই না। হঠাৎ এই উপহার প্রভার মনোজগতে ভিন্ন আলোড়ন তৈরি করে। ওদিকে অপর নার্স চরিত্র আনু প্রেমে পড়ে এক মুসলিম ছেলের। হিন্দু-মুসলিম প্রেম, তার ওপর আবার ভিড়-ভাট্টার মুম্বাই শহরে একটু যৌন মিলনের জন্য জায়গা খুঁজে পাওয়া নিয়ে তার স্ট্রাগল।
আরেকজন পার্বতী, যাকে বাড়ি থেকে উৎখাত করা হচ্ছে এবং যার ফিরে যেতে হবে নিজের গ্রামে। ঢিলেঢালাভাবে এগোচ্ছে মনে হলেও, এ সিনেমার গাঁথুনিতে এক অদৃশ্য টানটান উত্তেজনা রয়েছে, যা কেবল অনুভব করা যায়।
পরিশেষ
কানে পরিচালক পায়েলের সাফল্যের ইতিহাস অবশ্য বহু পুরোনো। এর আগে আ নাইট অব নোয়িং নাথিং নামে একটি ডকুমেন্টারির জন্য কান চলচ্চিত্র উৎসবে গোল্ডেন আই পুরস্কার জিতেছিলেন পায়েল।
এ বছর গোল্ডেন গ্লোবে সর্বাধিক ১০টি শাখায় মনোনয়ন পেয়েছে ফ্রান্সের জ্যাক অদিয়া নির্মিত সংগীতনির্ভর থ্রিলার এমিলিয়া পেরেস । তিনি সহ পায়েল কাপাডিয়ার পুরস্কারের প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে রয়েছেন আনোরা সিনেমার পরিচালক শন বেকার, কনক্লেভ সিনেমার পরিচালক এডওয়ার্ড বার্গার, দ্য ব্রুটালিস্ট-এর পরিচালক ব্রাডি করবেট, সাবস্ট্যানস সিনেমাটির পরিচালক কোরালি ফার্গেট।
৮২তম গোল্ডেন গ্লোব অ্যাওয়ার্ডসের ২৭টি বিভাগে মনোনীতদের নাম ঘোষণা করা হয় সোমবার। ২০২৫ সালের ৫ জানুয়ারি যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালিফোর্নিয়ায় বেভারলি হিলসের দ্য বেভারলি হিলটন হোটেলে জমকালো অনুষ্ঠানে গোল্ডেন গ্লোব অ্যাওয়ার্ডস দেয়া হবে।