সিরিয়ায় দুই যুগের শাসক বাশার আল-আসাদের শাসনের অবসান ঘটিয়ে ইতোমধ্যে নতুন প্রধানমন্ত্রী নিয়োগ দিয়েছে দেশটির বিদ্রোহীদের জোট। আগামী মার্চ পর্যন্ত অন্তর্বর্তী প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব পাওয়া মোহাম্মদ আল-বশির এরই মধ্যে বিদেশে অবস্থানরত সিরীয় শরাণার্থীদের দেশে ফিরে আসার আহ্বান জানিয়েছেন।
বার্তা সংস্থা এএফপি জানিয়েছে, সিরিয়ার নতুন অন্তর্বর্তীকালীন প্রধানমন্ত্রী দেশটির বর্তমান পরিস্থিতিকে শরণার্থীদের ফেরার জন্য নিরাপদ বলে অভিহিত করেছে। একইসঙ্গে দেশ পুনর্গঠনে এই শরণার্থীরা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখার সুযোগও দেখছেন তিনি।
দায়িত্ব নেওয়ার পর বিদেশে থাকা শরণার্থীদের দেশে ফেরানোকে প্রথম লক্ষ্য নির্ধারণ করেছেন জানিয়ে ইতালির একটি দৈনিককে আল-বশির বলেন, “সিরিয়া এখন একটি মুক্ত দেশ, যা তার গৌরব এবং মর্যাদা পুনরুদ্ধার করেছে। আমরা দেশের পুনর্গঠন এবং পুনর্জন্মের জন্য সবার সাহায্য প্রয়োজন।”
১৩ বছরের গৃহযুদ্ধে স্থানচ্যুত ১ কোটি ৩০ লাখ মানুষ
বিদ্রোহীদের হাতে গত রবিবার ক্ষমতা হারান সিরিয়ার দুই যুগের কর্তৃত্ববাদী শাসক বাশার আল-আসাদ। ক্ষমতা হারিয়ে পরিবার নিয়ে এখন তিনি আছেন রাশিয়ায়। রবিবার বিদ্রোহীদের কাছে ক্ষমতা হারালেও বাশার আল-আসাদের বিরুদ্ধে সিরিয়ায় বিদ্রোহের শুরু আরও ১৩ বছর আগে, ২০১১ সালে, যা এক পর্যায়ে রূপ নেয় বড় ধরনের গৃহযুদ্ধে।
তবে রাশিয়া ও ইরানের মতো ঘনিষ্ঠ মিত্রদের সহায়তায় কঠোর হাতে বিদ্রোহীদের দমন করে এতদিন টিকে ছিলেন বাশার আল-আসাদ।
২০১১ সালে বাশার আল-আসাদের বিরুদ্ধে যখন বিদ্রোহের সূচনা হয়, তখন সিরিয়ার জনসংখ্যা ছিল প্রায় ২ কোটি ১০ লাখ। এরপর থেকে গত ১৩ বছরের গৃহযুদ্ধে দেশটিতে প্রায় ৫ লাখ মানুষ নিহত ও ১০ লাখের বেশি মানুষ আহত হয়। আর স্থানচ্যুত হয় প্রায় ১ কোটি ৩০ লাখ মানুষ।
স্থানচ্যুত হওয়া এই ১ কোটি ৩০ লাখ মানুষের প্রায় অর্ধেকই বাশার আল-আসাদের দমনমূলক নীতি ও গৃহযুদ্ধের কারণে দেশ ছেড়ে শরণার্থী হিসেবে বিভিন্ন দেশে আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়।
জাতিসংঘের হিসাব অনুযায়ী, চলতি বছর পর্যন্ত সিরিয়ায় অভ্যন্তরীণভাবে বাস্তুচ্যুত মানুষের সংখ্যা প্রায় ৭৪ লাখ। প্রতিবেশী দেশগুলোতে শরণার্থী হিসেবে আশ্রয় নেওয়া সিরীয়দের সংখ্যা প্রায় ৪৯ লাখ। এর বাইরে আরও প্রায় ১৩ লাখ সিরীয় অন্যান্য দেশে শরণার্থী হিসেবে আশ্রয় নিয়েছে, যাদের একটি বড় অংশ গেছে ইউরোপের দেশগুলোতে।
কোন দেশে কত শরণার্থী
প্রতিবেশী দেশগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি সিরীয় শরণার্থী রয়েছে তুরস্ক, লেবানন, জর্ডান ও ইরাকে। আর ইউরোপের দেশগুলোর মধ্যে জার্মানিতে সিরীয় শরণার্থীদের সংখ্যা সবচেয়ে বেশি।
আল জাজিরার এক প্রতিবেদন বলছে, সিরিয়ার নিবন্ধিত শরণার্থীদের প্রায় অর্ধেকের বাস তুরস্কে, সংখ্যা যা ৩১ লাখ। এই হিসাবে বিশ্বে সবচেয়ে বেশি সংখ্যক শরণার্থীর আশ্রয়স্থল তুরস্ক। তুরস্ক সরকার সিরীয় শরণার্থীদের অস্থায়ী ভিত্তিতে বৈধভাবে থাকার অনুমতি দিলেও তাদের জন্য নাগরিকত্ব পাওয়ার সুযোগ রাখেনি।
লেবানন সিরিয়ান শরণার্থীদের দ্বিতীয় বৃহত্তম আশ্রয়স্থল, যেখানে প্রায় ৭ লাখ ৭৪ হাজার নিবন্ধিত শরণার্থী রয়েছে। নিবন্ধনবিহীন ব্যক্তিদের অন্তর্ভুক্ত করলে এই সংখ্যা প্রায় ১৫ লাখে পৌঁছাবে। এই সংখ্যা লেবাননের মোট জনসংখ্যার এক পঞ্চমাংশ। অর্থাৎ বর্তমানে লেবাননে থাকা প্রতি পাঁচজন মানুষের মধ্যে একজন সিরীয় শরণার্থী।
বিশ্বে সিরীয় শরণার্থীদের তৃতীয় বৃহত্তম আবাসস্থল এখন জার্মানি। জাতিসংঘের তথ্য বলছে, ইউরোপের দেশটিতে বর্তমানে প্রায় ৭ লাখ ১৬ হাজার অবস্থান করছে। তবে প্রেসিডেন্ট বাশার আল-আসাদের পতনের পর জার্মানি সিরীয় নাগরিকদের নতুন করে আশ্রয়ের আবেদন নেওয়া স্থগিত করেছে। এই সিদ্ধান্তের ফলে দেশটির আশ্রয় প্রত্যাশী ৪৭ হাজার ৭৭০ জনের আবেদন প্রক্রিয়া ঝুলে গেছে।
অন্য দেশগুলোর মধ্যে জর্ডানে ৬ লাখ ৪৯ হাজার, ইরাকে ২ লাখ ৮৬ হাজার, মিশরে ১ লাখ ৫৬ হাজার, অস্ট্রিয়ায় ৯৭ হাজার, সুইডেনে ৮৬ হাজার, নেদারল্যান্ডসে ৬৫ হাজার ও গ্রীসে ৫০ হাজারের মতো সিরীয় শরণার্থী হিসেবে বসবাস করছে।
জাতিসংঘের শরণার্থী সংস্থা (ইউএনএইচসিআর) জানিয়েছে, সাম্প্রতিক সময়ে বিদেশে থাকা সিরীয় শরণার্থীদের দেশে ফেরার প্রবণতা বেড়েছে। চলতি বছরের প্রথম আট মাসে প্রায় ৩৪ হাজার শরণার্থী নিজ দেশে ফিরে গেছে বলে সংস্থাটি নিশ্চিত হয়েছে। অবশ্য প্রকৃত সংখ্যা আরও বেশি হতে পারে বলে মনে করা হয়।