মধ্যপ্রাচ্যের রাজনীতিতে খেলোয়াড় হিসাবে চীনের নাম সচরাচর আসে না; সে কারণে বাশার আল আসাদ সরকারের পতনের পর যুক্তরাষ্ট্র কিংবা রাশিয়াই রয়েছে আলোচনায়; কিন্তু সিরিয়ায় চীনেরও রয়েছে স্বার্থ। ফলে সেখানে পট পরিবর্তন বিশ্ব রাজনীতির মোড়ল হয়ে ওঠা চীনের জন্যও গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে।
২৪ বছর ধরে ক্ষমতায় থাকা বাশারের পক্ষে রাশিয়া কিংবা ইরানের মতো খোলাখুলিভাবে না থাকলেও তার প্রতি চীনেরও ছিল পরোক্ষ সমর্থন। জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদে ভেটো দেওয়ার পাশাপাশি বিনিয়োগ ও সাহায্যের মাধ্যমে বাশারকে সহায়তা করে যাচ্ছিল বেইজিং।
গত বছর ১৯তম এশিয়ান গেমসের সময় চীনা প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং সিরিয়ার নেতা বাশারকে হাংজু শহরে স্বাগত জানান। সেসময় দুই দেশের মধ্যে একটি ‘কৌশলগত অংশীদারত্ব’ গড়ে তোলার ঘোষণা দেওয়া হয়।
কিন্তু এক বছরের ব্যবধানে এই অংশীদারত্ব ভেঙে পড়ল। ইসলামি সংগঠন হায়াত তাহরির আল-শামের (এইচটিএস) নেতৃত্বে বিদ্রোহীদের জোট সিরিয়ার রাজধানী দামেস্ক দখল করে নিলে বাশারকে পালিয়ে যেতে হয় রাশিয়ায়।
এই পরিস্থিতিতে চীন সতর্ক অবস্থান নিয়েছে। চীনের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, সিরিয়ায় স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে আনতে দ্রুত রাজনৈতিক সমাধান প্রয়োজন।
চীনের সতর্ক অবস্থান সিরিয়ার সঙ্গে তার সামগ্রিক সম্পর্কের দৃষ্টিভঙ্গিকে প্রকাশ করে। তবে বিশ্লেষকরা বলছেন, বাশার আল-আসাদের আকস্মিক ক্ষমতাচ্যুতি চীনের অর্থনীতিকে প্রভাবিত করবে। কারণ চীন বর্তমানে মধ্যপ্রাচ্যে তার প্রভাব বিস্তার করার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে।
চীনের সঙ্গে সিরিয়ার সম্পর্ক মূলত কৌশলগত সহযোগিতার ভিত্তিতে গড়ে উঠেছিল। দামেস্কে নতুন নেতৃত্বের আবির্ভাবের পর এই সম্পর্কের ধরন কেমন হবে, তা সামনের পরিস্থিতিই বলে দেবে।
বাশারের সঙ্গে চীনের সম্পর্ক কেমন ছিল
বাশার আল-আসাদ ক্ষমতায় থাকাকালে দামেস্ক ও বেইজিংয়ের মধ্যে সম্পর্ক ছিল বেশ ঘনিষ্ঠ। সেই সম্পর্কের উষ্ণতা দিনকে দিন বাড়ছিল।
আন্তর্জাতিক অঙ্গনে প্রায় বিচ্ছিন্ন সিরিয়ার নেতা বাশারের হাংজু যাওয়া ছিল দুই দশকের মধ্যে তার প্রথম আনুষ্ঠানিক চীন সফর। এই সফরে চীন এক দশকের বেশি সময়ের যুদ্ধে বিধ্বস্ত সিরিয়ার পুনর্গঠনে সহায়তার প্রতিশ্রুতি দেয়।
চীনা রাষ্ট্রীয় সংবাদমাধ্যমের খবর অনুযায়ী বাশারকে প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং বলেছিলেন, “এক অনিশ্চিত ও অস্থিতিশীল আন্তর্জাতিক পরিস্থিতির মুখোমুখি দাঁড়িয়ে চীন সিরিয়ার সঙ্গে কাজ চালিয়ে যেতে, একে অন্যকে দৃঢ়ভাবে সমর্থন করতে, বন্ধুত্বপূর্ণ সহযোগিতা বাড়াতে এবং আন্তর্জাতিক ন্যায়বিচার রক্ষা করতে ইচ্ছুক।”
চীন জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে বাশার আল-আসাদের বিরুদ্ধে গুরুতর প্রস্তাব আটকে দিতে ১০ বার ভেটো দিয়েছিল। সিরিয়ার যুদ্ধ সংক্রান্ত ৩০টি প্রস্তাবের মধ্যে ১০টিই আটক ছিল চীনের তৎপরতায়।
উদাহরণ হিসাবে বলা যায়, ২০২০ সালের জুলাই মাসে রাশিয়া ও চীন একটি প্রস্তাবে ভেটো দেয়। ওই প্রস্তাবে তুরস্ক থেকে সিরিয়ায় ত্রাণ সরবরাহের সময়সীমা বাড়ানোর কথা বলা হয়েছিল।
ভেটোর কারণ হিসেবে বলা হয়, এটি সিরিয়ার সার্বভৌমত্ব লঙ্ঘন করে। চীন ও রাশিয়া দাবি করে, ত্রাণ বিতরণ সিরিয়ার কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে হওয়া উচিৎ। অন্যদিকে, বাকি ১৩টি দেশ প্রস্তাবের পক্ষে ভোট দেয়।
২০১৯ সালের সেপ্টেম্বরে, রাশিয়া ও চীন সিরিয়ার বিদ্রোহী অধ্যুষিত ইদলিবে যুদ্ধবিরতির আহ্বান জানানো একটি প্রস্তাবে ভেটো দেয়।
আল-জাজিরার কূটনৈতিক সম্পাদক জেমস বেইস তখন মন্তব্য করেছিলেন, “চীন বেশ কয়েকবার রাশিয়ার সঙ্গে সংহতি প্রদর্শনের জন্য এ ধরনের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। তবে এই প্রস্তাবে মূল আপত্তি ছিল রাশিয়ার।”
গত ৮ ডিসেম্বর বাশার আল-আসাদের সরকারের পতনের পর চীন আনুষ্ঠানিকভাবে সিরিয়ার ভবিষ্যৎ নিয়ে নিরপেক্ষ অবস্থান বজায় রেখেছে। চীন এখন সিরিয়ার নতুন পরিস্থিতির প্রতি সতর্ক দৃষ্টি রাখছে।
চীনের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র মাও নিং গত সোমবার এক সংবাদ সম্মেলনে বলেন, “সিরিয়ার ভবিষ্যৎ ও ভাগ্য নির্ধারণ করবে সিরিয়ার জনগণ। আমরা আশা করি, সংশ্লিষ্ট সব পক্ষ দ্রুত একটি রাজনৈতিক সমাধানে পৌঁছাবে এবং স্থিতিশীলতা ও শৃঙ্খলা পুনঃপ্রতিষ্ঠা করবে।”
সিরিয়ায় চীনের অর্থনৈতিক সহায়তা
চীন সিরিয়ায় শুধু রাশিয়ার সহচর হিসাবেই কাজ করেনি, গত এক দশকে আর্থিক সহায়তার হাতও বাড়িয়েছে। এটি বাশার সরকারের প্রতি চীনের সমর্থনের একটি স্পষ্ট উদাহরণ।
২০১৬ সালের ডিসেম্বরে সিরীয় সরকার বিদ্রোহীদের বিরুদ্ধে বিজয় লাভ করে আলেপ্পো পুনর্দখল করে। ওই সময়েই চীন তার সহায়তা কৌশলে গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন আনে। এমনটাই বলছে সাইপ্রাস-ভিত্তিক স্বাধীন ঝুঁকি ও উন্নয়ন পরামর্শক প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর অপারেশনাল অ্যানালাইসিস অ্যান্ড রিসার্চ (সিওএআর)।
সিওএআর’র তথ্য অনুযায়ী, ২০১৬ সালে সিরিয়ায় চীনের সহায়তা ছিল প্রায় ৫ লাখ মার্কিন ডলার। ২০১৭ সালে তা ১০০ গুণ বেড়ে ৫ কোটি ৪০ লাখ ডলারে পৌঁছায়।
২০১৮ সালের অক্টোবরে চীন সিরিয়ার বৃহত্তম বন্দর লাতাকিয়ায় ৮০০টি বৈদ্যুতিক জেনারেটর অনুদান দেয়। এছাড়া চীন সিরিয়ার তেল ও গ্যাস খাতে প্রায় ৩ বিলিয়ন ডলার দীর্ঘমেয়াদি বিনিয়োগ করেছে।
২০০৮ সালে চীনের পেট্রোকেমিক্যাল প্রতিষ্ঠান সিনোপেক ইন্টারন্যাশনাল পেট্রোলিয়াম এক্সপ্লোরেশন অ্যান্ড প্রোডাকশন কর্পোরেশন প্রায় ২ বিলিয়ন ডলারে কানাডার ক্যালগেরিভিত্তিক তাংগানিকা অয়েল কোম্পানি কিনে নেয়। তাংগানিকা সিরিয়ার সঙ্গে উৎপাদন ভাগাভাগি চুক্তি করেছিল এবং দেশটির দুটি স্থাপনায় পরিচালনাগত স্বার্থ বজায় রেখেছিল।
২০০৯ সালে চীনের রাষ্ট্র-নিয়ন্ত্রিত বহুজাতিক কোম্পানি সিনোচেম সিরিয়ায় কার্যরত ব্রিটিশ তেল ও গ্যাস অনুসন্ধানকারী প্রতিষ্ঠান এমারাল্ড এনার্জি ৮৭৮ মিলিয়ন ডলারে কিনে নেয়।
২০১০ সালে চীন ন্যাশনাল পেট্রোলিয়াম কর্পোরেশন (সিএনপিসি) শেলের সিরিয়া ইউনিটে ৩৫ শতাংশ শেয়ার কিনতে শেলের সঙ্গে একটি চুক্তি সই করে।
চলতি বছরের শুরুর দিকে পশ্চিম সিরিয়ার হোমস শহরের কাছে একটি বড় ফটোভোল্টাইক প্ল্যান্ট নির্মাণের জন্য চীনা একটি কোম্পানির সঙ্গে ৩৮.২ মিলিয়ন ইউরো (প্রায় ৪০ মিলিয়ন ডলার) চুক্তি হয়। এ তথ্যটি বার্লিনভিত্তিক প্রকাশনা দ্য সিরিয়া রিপোর্ট প্রকাশ করে।
২০২২ সালে সিরিয়া চীনের বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভে (বিআরআই) যোগ দেয়। প্রকল্পটি এশিয়া, আফ্রিকা, ইউরোপ এবং লাতিন আমেরিকার সঙ্গে সংযোগ স্থাপনের জন্য সড়ক, বন্দর এবং রেলপথের একটি নেটওয়ার্ক নির্মাণ করছে।
তবে, বিআরআইতে যোগ দেওয়ার পর থেকে সিরিয়ায় বিনিয়োগের গতি ধীর। যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞার আশঙ্কায় সাম্প্রতিক বছরগুলোতে চীন সিরিয়ার কিছু প্রকল্প থেকে সরে এসেছে।
তবুও, অবজারভেটরি অফ ইকোনমিক কমপ্লেক্সিটির তথ্য অনুযায়ী, তুরস্ক ও সংযুক্ত আরব আমিরাতের পর সিরিয়া এখনও সবচেয়ে বেশি আমদানি করে চীন থেকে।
২০২২ সালে সিরিয়ায় চীনের রপ্তানির পরিমাণ ছিল ৪২৪ মিলিয়ন ডলার। এই রপ্তানির প্রাধান্য পণ্যগুলো ছিল মূলত কাপড়, লোহা ও রবারের টায়ার। তুলনায় চীনে সিরিয়ার রপ্তানি নগণ্য। সিরিয়া থেকে চীন কিছু সাবান, জলপাই তেল এবং অন্যান্য উদ্ভিজ্জ পণ্য আমদানি করে।
চীনের ওপর কী প্রভাব
“বাশার আল-আসাদের পতন চীনের জন্য একটি কূটনৈতিক সহযোগী হারানোর সমতুল্য”- এমন মন্তব্য করেছেন লন্ডনভিত্তিক থিংক ট্যাংক চ্যাথাম হাউসের এশিয়া প্যাসিফিক কর্মসূচির জ্যেষ্ঠ গবেষণা ফেলো উইলিয়াম ম্যাথিউস। তার মতে, ওই অঞ্চলে চীনের সার্বিক কৌশল ছিল বাস্তবভিত্তিক সম্পর্ক স্থাপন।
ম্যাথিউস বলেন, হায়াত তাহরির আল-শাম (এইচটিএস) সম্ভবত চীনের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সহযোগিতায় আগ্রহী হবে না। তবে চীন নতুন সরকারের সঙ্গে সম্পর্ক বজায় রাখার চেষ্টা করবে।
এক্ষেত্রে আফগানিস্তানের তালেবান সরকারের সঙ্গে চীনের সম্পর্ক একটি উদাহরণ হিসাবে দেখান তিনি, যদিও এখনই এবিষয়ে নিশ্চিত করে কিছু বলা যাবে না।
এবছরের ৩০ জানুয়ারি শি জিনপিংয়ের সরকার তালেবান শাসিত আফগানিস্তানের কূটনৈতিক প্রতিনিধি হিসাবে বিলাল কারিমিকে আনুষ্ঠানিকভাবে স্বীকৃতি দেয়।
বিশ্বের কোনও দেশই তালেবান সরকারকে আনুষ্ঠানিকভাবে স্বীকৃতি দেয়নি, তারপরও বেইজিং তাকে চীনে আফগান রাষ্ট্রদূত হিসাবে স্বীকৃতি দিয়েছে। অনেক চীনা কোম্পানিও তালেবান সরকারের সঙ্গে ব্যবসায়িক চুক্তি সই করেছে।
চীনবিষয়ক একজন স্বাধীন স্ট্র্যাটেজিস্ট অ্যান্ড্রু লেং বলেছেন, চীন তালেবানের সঙ্গে ভালো সম্পর্ক বজায় রেখেছে। এটা ইঙ্গিত দেয় যে হায়াত তাহরির আল-শাম (এইচটিএস) চীনের জন্য বড় কোনও সমস্যা সৃষ্টি করবে না।
অতীতে হংকংয়ের সরকারে বেশ কিছু উচ্চপদে দায়িত্ব পালন করেছিলেন লেং। তিনি বলেন, “ধরে নেওয়া যায় যে চীনের অবকাঠামো নির্মাণের সক্ষমতা যুদ্ধবিধ্বস্ত মধ্যপ্রাচ্যে চাহিদা পাবে।”
তবে চীন সেই বিনিয়োগের চাহিদায় কীভাবে প্রতিক্রিয়া জানাবে, তা পরিষ্কার নয়।
ম্যাথিউস বলেন, “চীন সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বিদেশি বিনিয়োগের প্রতি আরও সতর্ক মনোভাব গ্রহণ করেছে। তারপরও সিরিয়ায় নতুন বিনিয়োগ করতে পারে চীন। তবে সেই বিনিয়োগ অস্থিতিশীলতার ঝুঁকি এবং দীর্ঘমেয়াদি প্রভাবের সুযোগের ভিত্তিতে সংশোধিত হবে।”
ম্যাথিউস আরও বলেন, “আসাদের পতন চীনের জন্য একটি চ্যালেঞ্জ। কারণ মধ্যপ্রাচ্যে অর্থনৈতিক এবং উন্নয়ন অংশীদার হিসাবে চীনের ক্রমবর্ধমান আগ্রহ রয়েছে, বিশেষত প্রযুক্তি এবং প্রতিরক্ষা ক্ষেত্রে।”
২০২৩ সালের মার্চে সৌদি আরব ও ইরানের মধ্যে একটি কূটনৈতিক সমঝোতায় মধ্যস্থতা করেছিল চীন। এটি ছিল একটি অবাক করা ঘটনা। কারণ দেশ দুটির মধ্যে ২০১৬ সালে সম্পর্ক ছিন্ন হওয়ার পর থেকে উত্তেজনা চলছিল।
এবছরের জুলাই মাসে বেইজিং প্রতিদ্বন্দ্বী ফিলিস্তিনি গ্রুপ হামাস ও ফাতাহর পাশাপাশি ১২টি ছোট ফিলিস্তিনি গ্রুপকে আমন্ত্রণ জানায়। তিন দিনের নিবিড় আলোচনার পর এই গ্রুপগুলো একটি ‘জাতীয় ঐক্য’ চুক্তিতে সই করে। এই চুক্তির লক্ষ্য, হামাস-ইসরায়েল যুদ্ধ শেষে গাজার ওপর ফিলিস্তিনি নিয়ন্ত্রণ বজায় রাখা।
ম্যাথিউসের মতে, “চীনের জন্য প্রধান প্রতিবন্ধকতা হলো আসাদের পতন আঞ্চলিক স্থিতিশীলতার জন্য যে ঝুঁকি সৃষ্টি করেছে তা। এতে সিরিয়ার প্রতিবেশী দেশগুলোতেও সংঘাত ছড়িয়ে পড়ার সম্ভাবনা রয়েছে।”
বলা হচ্ছে, সিরিয়ায় বাশার আল-আসাদের পতন মধ্যপ্রাচ্যে রাজনৈতিক ভারসাম্য নষ্ট করে দিয়েছে। এখন চীনের ভূমিকা ও কৌশল কী হবে, তা ভবিষ্যতের রাজনৈতিক ভারসাম্যের ওপরই নির্ভর করবে।
তথ্যসূত্র : আল জাজিরা