সামরিক শাসন যেন মিয়ানমারের জনগণের নিয়তি হয়ে দাঁড়িয়েছে। মাঝখানে গণতান্ত্রিক শাসনকাঠামোয় ঝলক দেখা গেলেও ২০২১ সালের ফেব্রুয়ারিতে তা আবার নিভে যায়। শুরু হয় নতুন করে সামরিক শাসন।
মিয়ানমারে সামরিক শাসন থাকলেও সেনাবাহিনী খুব নির্বিঘ্নে দেশ পরিচালনা করতে পারছে না। দেশটির বিভিন্ন প্রান্তে একে একে উড়ছে বিদ্রোহীদের বিজয়ের পতাকা।
এমন পরিস্থিতির মধ্যেই গত রবিবারের একটি ঘটনা মিয়ানমারের জনগণের জন্য আশার আলো জাগাচ্ছে। সিরিয়ার বিদ্রোহীদের হঠাৎ বিজয়ের খবর মিয়ানমারের মানুষের মন ভরিয়ে দিয়েছে। বিদ্রোহীরা রাজধানী দখল করে এবং প্রেসিডেন্ট বাশার আল-আসাদকে রাশিয়ায় পালাতে বাধ্য করে। এর মধ্য দিয়ে সিরিয়ায় আসাদ পরিবারের দীর্ঘ শাসনের অবসান ঘটে।
দামেস্কের রাস্তায় সিরীয়দের স্বাধীনতা উদযাপনের ছবি ও খবর মিয়ানমারের জনগণ সোশাল মিডিয়ায় ব্যাপক মাত্রায় শেয়ার করেছে। তাদের এই শেয়ার ছিল আক্ষরিক অর্থেই দেশটির সামরিক শাসনের উদ্দেশে একটি বার্তা।
সিরিয়ার ঘটনার পর প্রশ্ন ওঠাই স্বাভাবিক যে, মিয়ানমারে কি এমন ঘটনার পুনরাবৃত্তি সম্ভব? সোশাল মিডিয়ায় এ নিয়ে তুমুল আলোচনা চলছে। আসাদ শাসনের পতন এবং সেটি মিয়ানমারে ঘটতে পারে কি না, এ বিষয়ে নানা মতামত ও মন্তব্য দেখা যাচ্ছে।
মিয়ানমারের বর্তমান শাসক মিন অং হ্লাইংয়েরও যদি একই পরিণতি হয়, তবে রাশিয়া বা চীন কি তাকে ও তার স্ত্রীকে আশ্রয় দেবে? এমন ফলাফল এখন কল্পনার মতো মনে হলেও মিয়ানমারের বিপ্লবের সমর্থকরা এমন ফলের প্রত্যাশা করছে। এনিয়ে সম্প্রতি একটি কার্টুনও প্রকাশিত হয়, যেখানে মিয়ানমারের শাসকগোষ্ঠীকে ব্যঙ্গ করা হয়েছে।
বিশ্লেষকরা মনে করছেন, পরিস্থিতি যেদিকে মোড় নিচ্ছে তাতে মিয়ানমারের শাসকগোষ্ঠী এখন ক্ষমতা হারানোর ভয়ে আছে।
সিরিয়ার ভবিষ্যৎ এখনও অনিশ্চিত। সামনে আরও বিশৃঙ্খলা বা নতুন যুদ্ধের আশঙ্কা রয়েছে। তারপরও মিয়ানমারের মানুষ দামেস্কের নৃশংস শাসন ব্যবস্থার পতনের খবর উৎসাহের সঙ্গে শেয়ার করেছে।
মিয়ানমারের শাসকগোষ্ঠীর নিয়ন্ত্রিত মিডিয়াগুলো আসাদের পরাজয় বা তার রাশিয়ায় পালিয়ে যাওয়ার খবর প্রকাশ করেনি। রাশিয়া আসাদ শাসনের ঘনিষ্ঠ মিত্র ছিল। আর দেশটি মিয়ানমারের সামরিক জান্তারও গুরুত্বপূর্ণ সহযোগী।
হঠাৎ পতনের ঘটনা প্রতিটি স্বৈরাচারী শাসনের জন্য ভয়ের। এটি যেকোনো স্থানে ঘটতে পারে। মিয়ানমারও এর ব্যতিক্রম নয়। সিরিয়ার জনগণের যে উচ্ছ্বাস দেখা যাচ্ছে, তা মিয়ানমারসহ অনেক দেশের জনগণের জন্য অনুপ্রেরণার। সামরিক জান্তা দ্রুত ভূখণ্ড হারাচ্ছে। এ অবস্থায় মিয়ানমারের জনগণ ও বিরোধী গোষ্ঠীগুলো স্বপ্ন দেখছে, হয়ত একদিন নেপিদোতে মিন অং হ্লাইংয়ের শাসনেরও একই পরিণতি ঘটবে।
আসাদের মতো মিন অং হ্লাইংও গত চার বছরে নিজের নাগরিকদের বিরুদ্ধে অপরাধ করেছে। জনগণ সেই নৃশংসতার স্মৃতি সহজে ভুলবে না।
আসাদের পতনের সঙ্গে সঙ্গে মিয়ানমারের মানুষ ঘরের কাছের আরও একটি সুখবর উদযাপন করছে। দেশটির জাতিগত বিরোধী শক্তি রাখাইন ও চিন রাজ্যের আরও কিছু গুরুত্বপূর্ণ শহর দখল করেছে।
রাখাইনে মংডুর পতনের পর আরাকান আর্মি (এএ) মিলিটারি অপারেসন্স কমান্ড ১৫-এর কমান্ডার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল থুরেইন তুনকে আটক করেছে। এখন মিয়ানমার-বাংলাদেশ সীমান্ত সম্পূর্ণ এএ-র নিয়ন্ত্রণে। চিন রাজ্যে জান্তাবিরোধীরা রাজ্যের রাজধানী হাখা এবং থান্টলাংয়ের মধ্যবর্তী কৌশলগত সমতলের জান্তার শেষ ঘাঁটিও দখল করে নিয়েছে।
উত্তরের কাচিন রাজ্যে চীনের চাপ উপেক্ষা করে কাচিন ইনডেপেন্ডেন্স আর্মি (কেআইএ) ভামো ও মানসি টাউনশিপে জান্তার ঘাঁটিতে আক্রমণ চালিয়ে যাচ্ছে।
অন্যান্য স্বৈরাচারী শাসকদের মতো মিন অং হ্লাইংও এক বিভ্রমের জগতে বাস করছেন। তার সৈন্যরা একে অপরের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করে বিরোধী বাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণ করছে। সারাদেশে তার নিয়ন্ত্রণাধীন এলাকা ক্রমশ কমছে। তারপরেও তিনি বিশ্বাস করেন, মিয়ানমার, ‘সোনালী ভূমি’, ‘স্থিতিশীল’ ও ‘শান্তিপূর্ণ’। গত সপ্তাহে নেপিদোতে জাতীয় ক্রীড়া উৎসবের বক্তৃতার সময়ও তিনি এমন চিত্রই তুলে ধরার চেষ্টা করেন।
২০২১ সাল থেকে মিন অং হ্লাইংয়ের শাসনামলে মিয়ানমারের অনেক অংশই কার্যত ধ্বংস হয়ে গেছে। দেশটিতে রাজনৈতিক ও সামাজিক অস্থিতিশীলতা এখন অনেকটা সাধারণ বিষয় হয়ে উঠেছে। তার সেনাবাহিনী বিরোধী বাহিনীর অপ্রতিরোধ্য চাপের সম্মুখীন। সেনাবাহিনী এখন নিজেদের ভাঙন ঠেকাতে ব্যস্ত। তবুও মিন অং হ্লাইং এখনও বিশ্বাস করেন, চীন ও রাশিয়ার মতো বিদেশি মিত্রদের সাহায্যে তিনি দেশে স্বাভাবিক পরিস্থিতি ফিরিয়ে আনতে পারবেন।
তবে বিশ্লেষকরা মনে করছেন, এই পরিস্থিতিতে মিন অং হ্লাইংয়ের মনে রাখা উচিত, যখন সিরীয় বিদ্রোহীরা দামাস্কাসের দিকে এগুচ্ছিল এবং আসাদকে পালাতে বাধ্য করেছিল, তখন আসাদের মিত্র ইরান ও রাশিয়া থেকে কোনো সাহায্য আসেনি।
মিয়ানমারে বিরোধী বাহিনীর বিজয় চলমান। ফলে দেশটির সামরিক শাসকও আসাদের মতো একই পরিণতি ভোগ করবেন, এ সম্ভাবনা অস্বীকার করা যায় না। এটা ঠিক যে আসাদের পতনের ঘটনা ৬ হাজার কিলোমিটারের বেশি দূর থেকেই মিয়ানমারের জনগণকে আন্দোলিত করেছে। একই সঙ্গে ভয় ধরিয়ে দিয়েছে নেপিদোর শাসকগোষ্ঠীকে।
তথ্যসূত্র : ইরাবতী।