সিরিয়ার প্রেসিডেন্ট বাশার আল-আসাদ সরকারকে উৎখাতে বিদ্রোহীদের নেতৃত্ব দেওয়া আবু মোহাম্মদ আল-জুলানি পেছন থেকে দেশটির শাসনকাজ পরিচালনা করবেন। আর ছোট একটি প্রদেশের প্রশাসকের অভিজ্ঞতা থাকা মোহাম্মদ আল বাশিরকে অস্থায়ী প্রধানমন্ত্রী হিসাবে নিযুক্ত করেছে বিদ্রোহীরা।
নতুন প্রধানমন্ত্রী বাশির গত মঙ্গলবার ক্ষমতাচ্যুত আসাদ সরকারের কর্মকর্তাদের সঙ্গে প্রথমবার বৈঠকে বসেছিলেন। বৈঠক চলাকালে তার পেছনে সিরিয়ার বিপ্লবের পতাকার পাশাপাশি ইসলামী বিশ্বাসের ঘোষণাসূচক একটি পতাকাও ছিল। পতাকাটি ইসলামি জিহাদিরা ব্যবহার করে।
২৪ বছর ধরে ক্ষমতায় থাকা স্বৈরশাসক আসাদের পতনের পর বিদ্রোহীদের প্রচারিত প্রথম মন্ত্রিসভার বৈঠকে ক্ষমতা হস্তান্তরের আলোচনার সময় এমন পতাকা ব্যবহার বিতর্কের সৃষ্টি করেছে। সোশাল মিডিয়ায় বিদ্রোহীদের এই কাজের তীব্র সমালোচনা হয়।
বিদ্রোহীরা সম্ভবত এই সমালোচনা বিবেচনায় নিয়েছে। পরে আল-জাজিরাকে সাক্ষাতকারে অস্থায়ী প্রধানমন্ত্রী বাশির শুধু নতুন সিরীয় পতাকা ব্যবহার করেন। ইসলামি পতাকাটি ব্যবহার করেননি।
দামেস্ক জয়ের আগে বাশির বিদ্রোহীদের ঘাঁটি ইদলিবের ছোট, রক্ষণশীল প্রদেশটির প্রশাসন পরিচালনা করেছিলেন। উত্তর-পশ্চিম সিরিয়ার ইদলিবে বিদ্রোহীদের শাসন পদ্ধতি থেকে তাদের ভবিষ্যৎ শাসন কেমন হতে পারে তার একটি ইঙ্গিত মেলে।
ইদলিবের বাসিন্দা ও বিশেষজ্ঞদের মতে, তাদের শাসন ছিল বাস্তবমুখী। অভ্যন্তরীণ ও বহিরাগত চাপের প্রভাবে তারা তাদের জিহাদি অতীত থেকে দূরে সরে এসেছিল। এর মধ্য দিয়ে তারা আন্তর্জাতিক গ্রহণযোগ্যতা অর্জনের চেষ্টা করেছে। তবে তাদের শাসন পূর্ণ গণতান্ত্রিক বা উদার ছিল না।
বিশেষজ্ঞরা সতর্ক করে বলেছেন, ইদলিবের মতো একটি ছোট প্রদেশ শাসনের অভিজ্ঞতা পুরো একটি রাষ্ট্র চালানোর জন্য যথেষ্ট নয়। সিরিয়ার মতো বৃহৎ ও বৈচিত্র্যময় দেশ পরিচালনা তাদের জন্য সম্পূর্ণ নতুন ও কঠিন চ্যালেঞ্জ হবে।
আবু মোহাম্মদ আল-জুলানি ও নতুন সরকারের চ্যালেঞ্জ
আসাদ সরকারকে উৎখাতে বিদ্রোহীদের নেতৃত্ব দেওয়া হায়াত তাহরির আল-শামকে (এইচটিএস) যুক্তরাষ্ট্র একটি সন্ত্রাসী সংগঠন হিসাবে তালিকাভুক্ত করেছিল। এই সংগঠনের নেতা আবু মোহাম্মদ আল-জুলানি সিদ্ধান্ত নিয়েছেন রাষ্ট্র পরিচালনায় পেছন থেকে কাজ করবেন।
তবে জুলানি বর্তমানে তার আসল নাম আহমাদ আল-শারা ব্যবহার করছেন। অন্তর্বর্তীকালীন সময়ের জন্য তিনি একজন টেকনোক্রেট মন্ত্রি হিসাবে বাশিরকে মনোনীত করেছেন।
জুলানি জানিয়েছেন, তার কর্মকর্তারা ইদলিব শাসন করে গুরুত্বপূর্ণ অভিজ্ঞতা অর্জন করেছেন। তবে তিনি স্বীকার করেন, তাদের সেই অভিজ্ঞতা রাষ্ট্র চালানোর জন্য যথেষ্ট নাও হতে পারে।
তিনি বলেন, “বিদ্রোহীরা শূন্য থেকে শুরু করেছে। ইদলিব ছোট ও সম্পদহীন ছিল। কিন্তু আল্লাহর রহমতে আমরা অতীতে অনেক ভালো কাজ করতে পেরেছি। তাদের অভিজ্ঞতা শূন্য নয়, এবং কিছু ক্ষেত্রে তারা সফলও হয়েছে।
“তবে পুরনো শাসনামলের কর্মকর্তাদের ছাড়া আমরা চলতে পারব না। আমাদের তাদের অভিজ্ঞতা থেকে উপকৃত হতে হবে।” সোমবার আসাদ সরকারের প্রধানমন্ত্রী মোহাম্মদ জালালির সঙ্গে ক্ষমতা হস্তান্তর নিয়ে আলোচনায় তিনি এসব কথা বলেন।
জুলানির মন্ত্রিরাও ইদলিবের ছোট একটি প্রদেশ পরিচালনার অভিজ্ঞতা থেকে পুরো সিরিয়া শাসনের আশা ব্যক্ত করেছেন। এটি সিরিয়ার ছয় দশকের মধ্যে প্রথম সরকার পরিবর্তন।
ইদলিবে সিরিয়ান সালভেশন গভর্নমেন্টের (এসএসজি) অধীনে বসবাস করা বিশেষজ্ঞ ও বাসিন্দারা বলছেন, বড় রাষ্ট্র পরিচালনায় অনভিজ্ঞতা এই মন্ত্রিসভাকে অন্তর্বর্তীকালীন সময় কার্যকরভাবে পরিচালনার জন্য অনেক ছাড় দিতে হবে এবং মানিয়ে চলতে হবে।
বিদ্রোহীদের শাসনে ইদলিব প্রদেশের পরিবর্তন দেখা ডা. ওয়ালিদ তামের ব্যক্তিগতভাবে জুলানির সঙ্গে কথা বলেছেন। তিনি এসএসজির (সিরিয়ান সালভেশন গভর্নমেন্ট) শাসনের প্রশংসাও করেন।
ডা. তামের বলেন, ইদলিবে মত প্রকাশের স্বাধীনতা বজায় ছিল। তবে তিনি এই বলেও সতর্ক করেছেন যে, বিদ্রোহীরা পুরো দেশ শাসনের জন্য এখনও প্রস্তুত হতে পারেনি।
তিনি বলেন, “আপনারা ইদলিব শাসন থেকে পুরো জাতি শাসনের দিকে গেছেন। আমি মনে করি না যে, আমরা যেটা দেখেছি, সেই সরকার পুরো সিরিয়া শাসনের জন্য যথেষ্ট দক্ষ ও সক্ষম।”
উত্তর সিরিয়ার ফ্রি ডক্টরস ইউনিয়নের প্রধান ডা. তামের নিজেকে একজন উদারপন্থী হিসাবে পরিচয় দেন। তিনি আরও জানিয়েছেন যে, এসএসজির শাসনে ইদলিব ‘খুবই নিরাপদ’ ছিল। বিদ্রোহীরা এইচটিএস-নিয়ন্ত্রিত প্রদেশে যাতায়াত বা চলাচলে কোনও বাধা দেয়নি।
তিনি বলেন, “সিরিয়া সামগ্রিকভাবে বসবাসের জন্য কঠিন জায়গা ছিল। তবে এসএসজি কারও ব্যক্তিগত জীবনে হস্তক্ষেপ করত না। বিভিন্ন পণ্য সহজলভ্য ছিল এবং মানুষের পোশাক বা জীবনধারার ওপর কোনও বিধিনিষেধ ছিল না।”
তবে ইদলিব প্রদেশে জীবন আর্থিকভাবে খুব একটা সমৃদ্ধিশালী ছিল না। বিদ্রোহীদের শাসনে জীবনযাপন করা ইদলিবের বাসিন্দা আবদেল লতিফ জাকুর সিএনএনকে বলেন, এসএসজির শাসনে অর্থনৈতিক অবস্থা ছিল ‘খুবই কঠিন’।
তিনি বলেন, “পর্যাপ্ত কাজ ছিল না, এবং অনেক মানুষ ঘরে বসে থাকত।” তিনি বর্তমানে তুরস্কে বসবাস করছেন।
নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা
২০১৭ সালে জুলানি ইদলিবে তার প্রভাব বিস্তার করার পর প্রতিদ্বন্দ্বী উগ্র ইসলামপন্থী গোষ্ঠীগুলোকে দমন করেন। এরপর একটি নতুন প্রকল্পের মাধ্যমে সরকার পরিচালনায় অভিজ্ঞ স্থানীয়দের ও শিক্ষাবিদদের নিয়ে একটি বেসামরিক সরকার গঠন করা হয়। এটি দখলকৃত এলাকায় জোরজবরদস্তি করে ধর্মীয় বাধ্যবাধকতা আরোপ করা অন্যান্য জিহাদী গোষ্ঠীর পদ্ধতি থেকে ভিন্ন ছিল।
ব্রাসেলসভিত্তিক ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইসিস গ্রুপের জ্যেষ্ঠ বিশ্লেষক জেরোম ড্রেভন সিএনএনকে বলেন, “স্যালভেশন গভর্নমেন্টের আগে বিভিন্ন গোষ্ঠীর নিজস্ব বিচার ব্যবস্থা, কারাগার ও সামাজিক সেবা ছিল। এইচটিএস অন্যান্য গোষ্ঠীগুলোর শাসন দায়িত্ব কেড়ে নেয় এবং নিজেদের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করে।”
আল জাজিরা জানায়, ২০১৭ সালে প্রতিষ্ঠার পর স্যালভেশন গভর্নমেন্ট বা এসএসজি চারটি নীতির কথা জানিয়ে একটি বিবৃতি দেয়। এর মধ্যে একটি ছিল, ইসলামি শরীয়াহ হবে ‘আইন প্রণয়নের একমাত্র উৎস’। এতে জনগণের সিরিয় ও ইসলামি পরিচয় রক্ষার প্রয়োজনীয়তার ওপরও জোর দেওয়া হয়।
এসএসজি একটি কার্যকর সরকার হিসাবে কাজ করত। তারা নিয়মিত মন্ত্রিসভা বৈঠক করত, যেখানে কর্মকর্তারা স্যুট পরে আসতেন। তারা প্রেস বিবৃতি প্রকাশ করত এবং ১১টি মন্ত্রণালয় পরিচালনা করত, যার মধ্যে বিচার, ক্রীড়া ও শিক্ষাও অন্তর্ভুক্ত ছিল।
এসএসজি কর আদায় করত, ইদলিবের সীমিত সম্পদ ব্যবস্থাপনা করত এবং ৪০ লাখ মানুষের শাসন পরিচালনা করত। এছাড়া তারা ৩০ লাখ বাস্তুচ্যুত মানুষের জন্য ত্রাণ সরবরাহে আন্তর্জাতিক মানবিক সংস্থাগুলোর সঙ্গে সমন্বয় করত।
সরকারের কাঠামো ও শাসনব্যবস্থা
তবে এসএসজি গণতান্ত্রিক উপায়ে নির্বাচিত হতো না। মন্ত্রীদের নিয়োগ শুরা বা পরামর্শ পরিষদের অনুমোদনের মাধ্যমে সম্পন্ন হতো। এই পরিষদ গঠিত হতো স্থানীয় বিশিষ্ট ব্যক্তিদের নিয়ে, যাদের মধ্যে কিছু সদস্য জুলানির এইচটিএস মনোনীত ছিলেন। সাত বছরের শাসনামলে এসএসজির নেতৃত্বে কোনও নারীকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি।
জেরোম ড্রেভন বলেন, “এটি একটি ইসলামি শাসনব্যবস্থা, কিন্তু টেকনোক্রেট কৌশলে পরিচালিত। তাদের উদ্দেশ্য ছিল ধর্মকে কীভাবে বাস্তবায়ন করা হবে, তা নিয়ন্ত্রণ করা।”
জাতিসংঘের ২০২২ সালের একটি প্রতিবেদন ইদলিবে এইচটিএসের শাসনামলে জীবনযাত্রার কঠোর চিত্র উঠে আসে।
প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, “জীবনযাত্রার ব্যয় বা ধর্মীয় বিষয়ে ব্যক্তিগত কথোপকথনে মন্তব্য করার কারণেও মানুষকে আটক করা হয়েছে। এসব মন্তব্যকে অপবাদ বা ধর্মদ্রোহ হিসাবে চিহ্নিত করা হতো, যার শাস্তি এক বছরের কারাদণ্ড।”
কর্তৃপক্ষ “নারীদের ‘অপ্রাসঙ্গিক’ পোশাক পরার অভিযোগে বা বিনোদন সংক্রান্ত নিষেধাজ্ঞা লঙ্ঘনের জন্যও গ্রেপ্তার করত।”
ডা. ওয়ালিদ তামের জানান, সময়ের সঙ্গে জুলানি দৈনন্দিন প্রশাসনিক কার্যক্রম থেকে নিজেকে দূরে রাখেন। তিনি কেবল তখনই হস্তক্ষেপ করতেন, যখন কোনও বড় ইস্যু তার গোষ্ঠীর প্রভাবকে বিপন্ন করার ঝুঁকি তৈরি করত।
আদেশ জারি করে শাসন
সংবিধান বা নির্বাচিত আইনসভা ছাড়াই বিদ্রোহীরা আদেশ জারি করে ইদলিব শাসন করত। তারা একটি সংকর নাগরিক-ইসলামিক আদালত কাঠামো গড়ে তোলে। এতে আইনজীবীরা, একজন প্রসিকিউটর এবং আপিল প্রক্রিয়া অন্তর্ভুক্ত ছিল।
জেরোম ড্রেভনের মতে, জুলানি তার শাসিত সমাজের প্রয়োজন অনুযায়ী খাপ খাইয়ে নেওয়ার মতো বাস্তববাদী ছিলেন। জনসাধারণের অসন্তোষের কারণে তিনি ধীরে ধীরে কঠোর শরিয়া আইন প্রয়োগ বন্ধ করেন।
নারী-পুরুষের সহজ মেলামেশা ও ধূমপান নিষিদ্ধ না করা এবং তার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ মেনে নেওয়ার মতো দৃষ্টান্ত স্থাপন করেন। শরিয়া ভিত্তিক নৈতিকতার জন্য গঠিত একটি বিশেষ ইউনিট বাতিল করা হয়, যদিও নারীদের চুল ঢাকার জন্য উৎসাহ দেওয়া হতো।
ড্রেভন বলেন, “বাস্তবে এটি (ইদলিব প্রশাসন) সফল একটি প্রকল্প ছিল। কারণ, জনগণের কিছু অংশ এতে আস্থা রেখেছিল। এটি স্থিতিশীল ছিল, অর্থনীতি বাকি সিরিয়ার তুলনায় ভালো কাজ করছিল এবং এখানকার কর্তৃত্ববাদ আসাদের পরিবারের শাসনের সঙ্গে কোনোভাবেই তুলনীয় ছিল না।”
তবে ব্যতিক্রমও ছিল। গত বছর এসএসজি একটি ‘নৈতিকতা ডিক্রি’ জারি করেছিল। এতে শিশুদের ইসলামি পোশাক বিধি মানতে এবং শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে সংগীত সীমিত করার নির্দেশ দেওয়া হয়।
তবে পরে সেটি বাতিল করা হয়। ড্রেভন বলেন, আন্তর্জাতিক প্রতিবাদের ফলে ত্রাণ সহায়তা ও অনুদান বন্ধ হয়ে যাওয়ার ভয়ে জুলানি পরে ডিক্রিটি স্থগিত করেছিলেন।
গণতন্ত্রে রূপান্তরের চ্যালেঞ্জ
ভিন্নমতাবলম্বীদের গ্রেপ্তার ও নির্যাতনের অভিযোগে গত বছর ইদলিবে জুলানির বিরুদ্ধে বড় ধরনের প্রতিবাদ হয়েছিল।
সিএনএনকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে জুলানি বলেন, “কারাগারে ঘটে যাওয়া নিপীড়ন আমাদের নির্দেশে বা অনুমতিতে হয়নি। এই ঘটনার জন্য দায়ীদের বিরুদ্ধে ইতোমধ্যে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে।”
ড্রেভন বলেন, সিরিয়ার গণতন্ত্রে রূপান্তর একটি দীর্ঘ ও জটিল প্রক্রিয়া হবে। কারণ, দেশটি ছয় দশক ধরে স্বৈরতান্ত্রিক শাসনের যাতাকলে ছিল।
তিনি বলেন, “ইদলিবের সরকার ছিল শাসনের এক নতুন ধরণ। আপনি একটি যুদ্ধকালীন সশস্ত্র গোষ্ঠীর কাছ থেকে খুব ছোট একটি অঞ্চলে সামাজিক গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা গড়ে তোলার আশা করতে পারেন না।
“তাদের যুদ্ধ পরিস্থিতিতে বাস্তববাদী হতে হয়েছে। সিরিয়া গত পাঁচ-ছয় দশকে গণতন্ত্র দেখেনি। তাই এক সপ্তাহের মধ্যেই দেশটির গণতান্ত্রিক হয়ে উঠার আশা করা যায় না।”
তথ্যসূত্র : সিএনএন