দুই যুগ সিরিয়া শাসন করা বাশার আল-আসাদ ক্ষমতাচ্যুত হয়ে দেশ ছেড়েছেন গত রবিবার। বিদ্রোহীরা আসাদ সরকারের পতন নিশ্চিত করার পরপরই সিরিয়ায় সক্রিয় হয়ে উঠে ইসরায়েল। একের পর এক বোমা হামলা চালিয়ে সিরিয়ার সামরিক সম্পদ ধ্বংসের পাশাপাশি দখলে নেয় দেশটির সবচেয়ে উঁচু পর্বত ‘মাউন্ট হারমন’।
কিন্তু এত কিছু থাকতে কেন সিরিয়ার সবচেয়ে উঁচু পর্বতটি দখলে নিল ইসরায়েল– সেই প্রশ্নের উত্তর খোঁজার চেষ্টা করেছে যুক্তরাষ্ট্রের সংবাদমাধ্যম সিএনএন।
ইসরায়েলি সামরিক বাহিনীর বরাতে সংবাদমাধ্যমটি বলছে, আসাদ সরকারের পতনের পর গত কয়েকদিনে ইসরায়েল সিরিয়ায় প্রায় ৫০০ লক্ষ্যবস্তুতে হামলা চালিয়েছে। এসব হামলায় সিরিয়ার নৌবাহিনীর জাহাজ থেকে শুরু করে অনেক স্থাপনা ধ্বংস হয়েছে।
পাশাপাশি সিরিয়ার ভূমি থেকে আকাশে নিক্ষেপযোগ্য ক্ষেপণাস্ত্রের প্রায় ৯০ শতাংশ এই সময়ে বোমা হামলা চালিয়ে ধ্বংস করা হয়েছে বলেও দাবি করেছে ইসরায়েলি বাহিনী।
তারা বলছে, সিরিয়ার এসব অস্ত্র ও সামরিক সম্পদ যাতে বিদ্রোহীদের হাতে না পড়ে এবং পরবর্তী সময়ে যাতে এগুলো ইসরায়েলের বিরুদ্ধে ব্যবহার করা না যায়, সে জন্যই সতর্কতামূলক ব্যবস্থা হিসেবে তারা এগুলো ধ্বংস করছে।
তবে সব কিছু ছাপিয়ে সিরিয়ার সবচেয়ে উঁচু পর্বত ‘মাউন্ট হারমন’ দখল করাকেই ইসরায়েলের বড় অর্জন হিসেবে দেখছেন বিশ্লেষকরা, যদিও ইসরায়েলি বাহিনী এই দখলদারিত্বকে ‘সাময়িক’ বলে উল্লেখ করেছে।
ইসরায়েলের কাছে হারমন পর্বতের গুরুত্ব কোথায়– সে সম্পর্কে জানতে চাইলে জেরুজালেম ইনস্টিটিউট ফর স্ট্র্যাটেজি অ্যান্ড সিকিউরিটির (জেআইএসএস) পরিচালক এফ্রায়িম ইনবার সিএনএনকে বলেন, “এটি অঞ্চলের সবচেয়ে উঁচু স্থান, যেখান থেকে লেবানন, সিরিয়া ও ইসরায়েলের উপর সহজে নজরদারি করা যায়। এটি কৌশলগতভাবে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। আর পর্বতের বিকল্প তো কিছু হয় না।”
মাউন্ট হারমনের চূড়া সিরিয়ায় অবস্থিত। গত ৫০ বছর ধরে এটি বাফার জোন হিসেবে ইসরায়েলি ও সিরিয়ার সামরিক বাহিনীকে আলাদা করে রেখেছিল। ইসরায়েল দখলে নেওয়ার আগে গত রবিবার পর্যন্ত মাউন্ট হারমনের চূড়াটি ছিল জাতিসংঘের শান্তিরক্ষীদের অধীনে।
মাউন্ট হারমন দখলে নেওয়ার পর গত শুক্রবার ইসরায়েলের প্রতিরক্ষামন্ত্রী ইসরায়েল কাটজ সেখানে দখলদারিত্ব বজায় রাখার ইঙ্গিত দেন। এক বিবৃতিতে তিনি বলেন, “সিরিয়ার পরিস্থিতি বিবেচনায় হারমন পর্বতের চূড়া নিয়ন্ত্রণে রাখা আমাদের নিরাপত্তার জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।”
এরপর এক ভিডিও বার্তায় ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু বলেন, “আমাদের সিরিয়ার অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ করার কোনও ইচ্ছা নেই। তবে আমাদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে যা কিছু প্রয়োজন, আমরা তা অবশ্যই করব।”
ইসরায়েল ১৯৬৭ সালের যুদ্ধে হারমন পর্বত সংলগ্ন গোলান মালভূমি দখল করে নেয় এবং এরপর থেকে তা ইসরায়েলের দখলেই রয়েছে। ১৯৭৩ সালে সিরিয়া অঞ্চলটি পুনর্দখলের চেষ্টা চালালেও ব্যর্থ হয়। ১৯৮১ সালে ইসরায়েল এই অঞ্চলকে নিজেদের অংশ হিসেবে ঘোষণা করে। আন্তর্জাতিক আইনে এই দখল অবৈধ হলেও ট্রাম্প প্রশাসন গোলান মালভূমির ওপর ইসরায়েলের দাবির স্বীকৃতি দেয়।
ইসরায়েল কয়েক দশক ধরে হারমন পর্বতের ঢালের কিছু অংশ নিয়ন্ত্রণ করছিল এবং সেখানে একটি স্কি রিসোর্টও পরিচালনা করত। তবে পর্বতের চূড়াটি ছিল সিরিয়ার সীমানায়।
হারমন পর্বতের চূড়া ইসরায়েলের নিয়ন্ত্রণে থাকা দেশটির জন্য অনেক গুরুত্ব বহন করে। ৯ হাজার ২৩২ ফুট (২,৮১৪ মিটার) উচ্চতার এই স্থানটি সিরিয়া বা ইসরায়েলের যেকোনও জায়গার চেয়ে উঁচু। অন্যদিকে লেবাননের একটি মাত্র পর্বত রয়েছে যার চূড়া হারমনের চেয়েও উঁচু।
হারমন পর্বতের ভৌগলিক গুরুত্ব সম্পর্কে বলতে গিয়ে এফ্রায়িম ইনবার বলেন, “কেউ কেউ বলে যে এই ক্ষেপণাস্ত্রের যুগে ভূমির গুরুত্ব নেই– এটা একদমই মিথ্যা।”
২০১১ সালে প্রকাশিত এক একাডেমিক গবেষণায় তিনি হরমন পর্বতের বিভিন্ন সুবিধার কথা তুলে ধরেন, যেখানে বলা হয়, “এখান থেকে সহজে সিরিয়ার গভীরে ইলেকট্রনিক নজরদারি করা যায়, যার ফলে এখান থেকে ইসরায়েলকে লক্ষ্য করে কোনও হামলার চেষ্টা হলে তা আগেভাগেই জানতে ও সতর্কতামূলক ব্যবস্থা নিতে পারবে ইসরায়েল।”
আর এই পর্বতের ঢালও ইসরায়েলের নিয়ন্ত্রণে থাকায় সিরিয়ার রাজধানী এখন ইসরায়েলি কামানের আওতার চলে এসেছে।
সিরিয়ার বিদ্রোহী নেতা মোহাম্মদ আল-জুলানি শনিবার ইসরায়েলের কর্মকাণ্ডকে “সীমা অতিক্রম” হিসেবে আখ্যায়িত করেন। অন্যদিকে সিরিয়ার প্রতিবেশী কয়েকটি দেশ ইসরায়েলকে সিরিয়ার সব অঞ্চল থেকে সৈন্য সরিয়ে নেওয়ার আহ্বান জানিয়েছে।
জর্ডানের উপপ্রধানমন্ত্রী আয়মান সাফাদি সম্প্রতি আকাবায় তুরস্ক, ইরাক, মিশর ও ইউরোপীয় কমিশনের কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈঠকের পর ইসরায়েলের বিরুদ্ধে সিরিয়ার ক্ষমতার শূন্যতার ‘ফায়দা লোটার’ অভিযোগ তোলেন। একইসঙ্গে সাফাদি সতর্ক করেন, সিরিয়ার স্থিতিশীলতা এই “অঞ্চলের নিরাপত্তার স্তম্ভ” এবং সিরিয়ার সার্বভৌমত্বকে সম্মান না করলে “পরিস্থিতির বিস্ফোরণ” ঘটতে পারে।
এদিকে ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহু জোর দিয়ে বলেছেন, সিরিয়ার নতুন সরকারের প্রতি তার “হাত প্রসারিত” রয়েছে। তবে তিনি এবং অন্যান্য নিরাপত্তা বিশ্লেষক স্পষ্ট করেছেন, যে তারা কোনও ঝুঁকি নেবেন না।
ইসরায়েলের অবসরপ্রাপ্ত সামরিক কর্মকর্তা ইসরায়েল জিভে কথাতেও মেলে তেমন ইঙ্গিত। সিরিয়ায় ইসরায়েলের সামরিক অভিযানকে সমর্থন করে তিনি বলেন, “এটি আমাদের জন্য অনেক স্বস্তিদায়ক। কারণ সামরিক সরঞ্জাম সন্ত্রাসী সংগঠনগুলোর হাতে গেলে তার পরিণতি কী হয় তা অন্য দেশগুলোতে আমরা দেখেছি।”
যদিও হারমন পর্বতে ইসরায়েলি দখলদারিত্বকে সাময়িক বলে উল্লেখ করেছেন নেতানিয়াহু, তবে তিনি একইসঙ্গে জোর দিয়ে বলেছেন, সিরিয়ায় ক্ষমতার শূন্যতার সুযোগ নিয়ে জিহাদী কোনও গোষ্ঠীকে ২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর হামাসের চালানোর হামলার মতো ইসলায়েলের বাসিন্দাদের লক্ষ্য করে কোনও হামলা চালানোর সুযোগ তিনি দেবেন না।
এখান থেকে সৈন্য সরানোর শর্ত হিসেবে তিনি বলেন, “সিরীয় সেনাবাহিনীকে ১৯৭৪ সালের চুক্তি মেনে নেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিতে হবে এবং আমাদের সীমান্তের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে।”
তবে নেতানিয়াহুর এই শর্ত কবে পূরণ হবে, বা আদৌ হবে কিনা তা নিশ্চিত নয়।
ফলে এমন পরিস্থিতিতে ইসরায়েলি সেনারা দখলে নেওয়া হারমন পর্বতে তাদের অবস্থান সহজে ছাড়বে না বলেই মনে করেন ইনবার।