বিজয়ের দিন ১৬ ডিসেম্বর; নয় মাস যুদ্ধ শেষে ৩০ লাখ শহীদের রক্ত এবং ২ লাখ নারীর সম্ভ্রমের বিনিময়ে ১৯৭১ সালের এই দিনে পাকিস্তানি বাহিনীকে হারিয়ে বিজয় পতাকা ওড়ায় বাংলাদেশ।
২০২৪ সালে এসে বিজয়ের এই দিন এবার উদযাপিত হচ্ছে কিছুটা ভিন্ন আবহে; ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের প্রেক্ষাপটে এবার রাষ্ট্রপ্রধান ও সরকার প্রধানের বাণীতে বৈষম্যহীন ও দুর্নীতিমুক্ত বাংলাদেশ গড়ার কথাই এসেছে গুরুত্ব নিয়ে। আর সেজন্য এসেছে একতাবদ্ধ হওয়ার আহ্বান।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে নেতৃত্ব দেওয়া দল আওয়ামী লীগ গত দেড় দশক একটানা দেশ শাসনের পর উৎখাত হয়েছে ‘ফ্যাসিবাদী’ তকমা নিয়ে।
যার পরিণতিতে এবারের বিজয়ের উৎসবে কোথাও নেই আওয়ামী লীগ; স্বাধীনতার স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নামও অনুপস্থিত রাষ্ট্রীয় বাণীতে।
এর মধ্যদিয়ে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা মুছে দেওয়ার প্রয়াত অভ্যুত্থানের পর গঠিত অন্তর্বর্তীকালীন সরকার চালাচ্ছে বলে অভিযোগ করেছে আওয়ামী লীগ।
তবে জুলাই আন্দোলনের নেতৃত্ব দেওয়া বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতাদের বক্তব্য বিপরীত। তারা বলছেন, আওয়ামী লীগ মুক্তিযুদ্ধকে ‘দলীয়’ গণ্ডিতে আবদ্ধ করে রেখেছিল, তা থেকে এখন মুক্তি পেয়েছে জনগণ।
বিজয় দিবসে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের বাণীতেও এসেছে জুলাই অভ্যুত্থানের কথা।
তিনি বলেছেন, “ছাত্র-শ্রমিক-জনতার গণঅভ্যুত্থানের মাধ্যমে গঠিত অন্তর্বর্তী সরকার একটি উন্নত, সমৃদ্ধ এবং সুশাসিত বাংলাদেশ গঠনে সবাই মিলে একসাথে কাজ করার অঙ্গীকার করছে। আমাদের দেশকে আরও উন্নত ও শক্তিশালী করতে এবং স্বাধীনতার পূর্ণ সুফল ভোগ করতে আমরা বদ্ধপরিকর।”
রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিনের বাণীতেও জুলাই আন্দোলনের আকাঙ্ক্ষা বাস্তবায়নের কথা ধ্বনিত হয়েছে। তিনি বলেছেন, “জুলাই-আগস্ট মাসে ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানের মাধ্যমে একটি বৈষম্যহীন ও দুর্নীতিমুক্ত বাংলাদেশ গড়ার যে স্বপ্ন এ দেশের মানুষ দেখেছে, তা অচিরেই বাস্তবায়িত হবে বলে আমি মনে করি। বীরের দেশ বাংলাদেশ বিশ্বের বুকে স্বমহিমায় প্রতিষ্ঠা লাভ করবে, ইনশাআল্লাহ।”
সোমবার বিজয় দিবসে রাষ্ট্রীয় কর্মসূচির শুরু হবে ভোরে ঢাকায় ৩১ বার তোপধ্বনির মধ্যদিয়ে। এরপর সাভারে স্মৃতিসৌধকেন্দ্রিক হবে দিবস পালনের মূল আয়োজন।
সূর্যোদয়ের সঙ্গে সঙ্গে রাষ্ট্রপ্রধান সাহাবুদ্দিন এবং প্রধান উপদেষ্টা ড. ইউনূস সাভারে জাতীয় স্মৃতিসৌধে ফুল দিয়ে মুক্তিযুদ্ধে শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানাবেন।
রাষ্ট্রপতি ও প্রধান উপদেষ্টার পর বীরশ্রেষ্ঠ পরিবার, যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা ও বীর মুক্তিযোদ্ধারা ফুল দেবেন স্মৃতিসৌধে। এরপর স্মৃতিসৌধ সর্ব সাধারণের জন্য উন্মুক্ত করা হবে।
ঢাকার পাশাপাশি সারাদেশেও সরকারি নানা কর্মসূচির মধ্য দিয়ে বিজয় দিবস উদযাপন হবে। বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও সংগঠনও নানা কর্মসূচিতে বিজয় উদযাপন করবে।
রাষ্ট্রপতির বাণী
রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিন তার বাণীতে মুক্তিযুদ্ধে আত্মোৎসর্গকারী সব শহীদ, সব জাতীয় নেতাদের স্মরণের পাশাপাশি বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনসহ বিভিন্ন গণতান্ত্রিক আন্দোলনে শহীদদেরও স্মরণ করেছেন।
দীর্ঘ শোষণ-বঞ্চনার ইতিহাস তুলে ধরে তিনি বলেছেন, ৫২ এর ভাষা আন্দোলনের মধ্যদিয়ে স্বাধীনতার যে স্বপ্নযাত্রা শুরু হয়েছিল, দীর্ঘ আন্দোলন-সংগ্রাম ও নানা চড়াই-উতরাই পেরিয়ে ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ স্বাধীনতার ঘোষণার মাধ্যমে তা পূর্ণতা পায়। দীর্ঘ নয় মাস সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর অর্জিত হয় চূড়ান্ত বিজয়।
রাজনৈতিক স্বাধীনতার পাশাপাশি অর্থনৈতিক মুক্তিও যে স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষা ছিল, তা তুলে ধরে রাষ্ট্রপতি বলেন, “কিন্তু বিজয়ের পাঁচ দশক পার হলেও জনগণের অর্থনৈতিক মুক্তি এখনও অর্জিত হয়নি। বারবার আমাদের গণতান্ত্রিক অগ্রযাত্রা ও অর্থনৈতিক মুক্তির পথচলা বাধাগ্রস্ত হয়েছে।
“এ বছর জুলাই-আগস্ট মাসে ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানের মাধ্যমে একটি বৈষম্যহীন ও দুর্নীতিমুক্ত বাংলাদেশ গড়ার যে স্বপ্ন এ দেশের মানুষ দেখেছে, তা অচিরেই বাস্তবায়িত হবে বলে আমি মনে করি। বীরের দেশ বাংলাদেশ বিশ্বের বুকে স্বমহিমায় প্রতিষ্ঠা লাভ করবে, ইনশাআল্লাহ।”
লাখো শহীদের আত্মত্যাগের বিনিময়ে অর্জিত স্বাধীনতার সুফল জনগণের দোরগোড়ায় পৌঁছে দিতে গণতন্ত্রকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেওয়ার ওপর জোর দেন সাহাবুদ্দিন।
রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে পরমতসহিষ্ণুতা ও পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধের সংস্কৃতি গড়ে তোলার আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন, “আসুন, ২০২৪ সালের বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে একটি বৈষম্যমুক্ত দেশ গড়তে এবং মুক্তিযুদ্ধের লক্ষ্য বাস্তবায়ন ও শোষণমুক্ত সমাজ প্রতিষ্ঠায় নিজ নিজ অবস্থান থেকে আরও বেশি অবদান রাখি। দেশ ও জাতিকে উন্নয়ন ও সমৃদ্ধির পথে আরও এগিয়ে নিয়ে যাই, গড়ে তুলি উন্নত-সমৃদ্ধ এক নতুন বাংলাদেশ।”
প্রধান উপদেষ্টার বাণী
প্রধান উপদেষ্টা ড. ইউনূস বাণীতে ১৬ ডিসেম্বরের গুরুত্ব তুলে ধরে বলেন, “দিনটি বাংলাদেশের ইতিহাসে একটি অত্যন্ত গৌরবময় এবং স্মরণীয় দিন । ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর, মহান মুক্তিযুদ্ধে বিজয়ের মাধ্যমে আমরা অর্জন করি স্বাধীনতার স্বাদ এবং জাতি হিসেবে নিজস্ব পরিচিতি। লাখ লাখ শহীদের রক্ত ও ত্যাগের বিনিময়ে আমরা পেয়ে যাই আমাদের কাঙ্ক্ষিত স্বাধীনতা।
“বিজয় দিবস কেবল আমাদের গর্বের উৎস নয়, এটি আমাদের শপথের দিনও। শপথ আমাদের একতাবদ্ধ থাকার, দেশের সার্বভৌমত্ব রক্ষার এবং মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ধারণ করার।”
স্বাধীনতা সংগ্রামের শহীদদের স্মরণ এবং তাদের আত্মত্যাগকে সম্মান জানিয়ে ড. ইউনূস বলেন, “ছাত্র-শ্রমিক-জনতার গণঅভ্যুত্থানের মাধ্যমে গঠিত অন্তর্বর্তী সরকার একটি উন্নত, সমৃদ্ধ এবং সুশাসিত বাংলাদেশ গঠনে সবাই মিলে একসাথে কাজ করার অঙ্গীকার করছে। আমাদের দেশকে আরও উন্নত ও শক্তিশালী করতে এবং স্বাধীনতার পূর্ণ সুফল ভোগ করতে আমরা বদ্ধপরিকর।”
দিবসে জাতীয় কর্মসূচি
বিজয় দিবসে সাভারে জাতীয় স্মৃতি সৌধে মূল কর্মসূচির পাশাপাশি দিনভর নানা আয়োজন থাকছে ঢাকায়।
সরকারি ছুটির এই দিনে সরকারি-আধাসরকারি, স্বায়ত্তশাসিত ও বেসরকারি সব ভবনে জাতীয় পতাকা উত্তোলন করা হবে। গুরুত্বপূর্ণ ভবন ও স্থাপনাগুলোতে হবে আলোকসজ্জা।
বিজয় দিবসের তাৎপর্য তুলে ধরে সংবাদপত্রে বিশেষ ক্রোড়পত্র প্রকাশ হবে। টেলিভিশনগুলোতে হবে মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক অনুষ্ঠানমালা। বাংলাদেশ ডাক বিভাগ স্মারক ডাকটিকেট প্রকাশ করবে।
শিল্পকলা একাডেমি, বাংলা একাডেমি, জাতীয় জাদুঘর, মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর, বাংলাদেশ শিশু একাডেমিসহ বিভিন্ন সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠন মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক আলোচনা, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, শিশুদের চিত্রাঙ্কন, রচনা ও ক্রীড়া প্রতিযোগিতা এবং মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক প্রামাণ্যচিত্র প্রদর্শনের আয়োজন করেছে।
দেশের সব জেলা ও উপজেলায় দিনব্যাপী বিজয়মেলা আয়োজন করা হয়েছে। শিশুদের জন্য মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক চিত্রাঙ্কন প্রতিযোগিতা ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান আয়োজন করা হয়েছে। বিদেশে বাংলাদেশ দূতাবাসেও দিবসের তাৎপর্য তুলে ধরে বিভিন্ন কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়েছে।
চট্টগ্রাম, খুলনা, মোংলা ও পায়রা বন্দর, ঢাকার সদরঘাট, পাগলা (নারায়ণগঞ্জ) ও বরিশালসহ বিআইডব্লিউটিসির ঘাটে এবং চাঁদপুর ও মুন্সিগঞ্জ ঘাটে বাংলাদেশ নৌবাহিনী ও কোস্টগার্ডের জাহাজগুলো দুপুর ২টা থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত জনসাধারণের দেখার জন্য উন্মুক্ত থাকবে। দেশের সব শিশু পার্ক ও জাদুঘরগুলো উন্মুক্ত থাকবে, টিকেট ছাড়াই এদিন ঢোকা যাবে।
বঙ্গভবনে বিকালে বীরশ্রেষ্ঠ পরিবারগুলোকে সংবর্ধনা দেওয়া হবে। এছাড়া মহানগর, জেলা ও উপজেলায় বীর মুক্তিযোদ্ধা এবং শহীদ পরিবারের সদস্যদের সংবর্ধনা অনুষ্ঠিত হবে।
ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানে দেশের শান্তি ও অগ্রগতি কামনা করে বিশেষ দোয়া ও উপাসনার আয়োজন করা হবে। এতিমখানা, বৃদ্ধাশ্রম, হাসপাতাল, জেলখানা, সরকারি শিশুসদনসহ অনুরূপ প্রতিষ্ঠানগুলোতে উন্নতমানের খাবার পরিবেশন করা হবে।