Beta
মঙ্গলবার, ১৭ ডিসেম্বর, ২০২৪
Beta
মঙ্গলবার, ১৭ ডিসেম্বর, ২০২৪

চার মুক্তিযোদ্ধার প্রথম স্মৃতিসৌধ দেখার গল্প বলে যে বিজ্ঞাপন

four-freedom fighters-saluting national-flag
[publishpress_authors_box]

১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধে প্রত্যক্ষ লড়াইয়ে অংশ নেওয়া বেঁচে থাকা মুক্তিযোদ্ধাদের অনেকেই বিজয়ের ৫৩ বছরে এসেও চাওয়া-পাওয়ার তোয়াক্কা করেন না। যে সম্মান তাদের পাওয়ার কথা কতটুকু তারা তা পেয়েছেন, তা নিয়েও নেই কোনও মাথাব্যথা। মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়ে দেশ স্বাধীন করতে পারার কৃতিত্বই যেন পৃথিবীর সবথেকে বড় সম্পদ পাওয়া। বিস্ময়কর হলেও সত্যি এমনও কিছু মুক্তিযোদ্ধা আছেন, যারা দেখেননি মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিস্মারক হয়ে দাঁড়িয়ে থাকা জাতীয় স্মৃতিসৌধ।

গত ১২ ডিসেম্বর বাংলাদেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম মোবাইল ফোন অপারেটর রবি’র একটি বিজ্ঞাপন প্রকাশ করে টেলিভিশন ও অনলাইন মিডিয়ায়। মহান মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণকারী চারজন মুক্তিযোদ্ধা-যারা কখনো জাতীয় স্মৃতিসৌধ দেখেননি, জীবন সায়াহ্নে এসে তাদের সেই অভিজ্ঞতার মুখোমুখি করা হয়েছে বিজ্ঞাপনটির মাধ্যমে।

প্রচারের পর থেকেই বিজ্ঞাপনটি প্রশংসিত হয় সর্বত্র। এখন পযন্ত ৩৮ হাজার শেয়ার হয়েছে। সাত কোটি দশ লাখ ভিউ, ১৪ হাজার শেয়ার হয়েছে রবির ফেইসবুক পেজে।

যেভাবে এল বিজ্ঞাপনটি নির্মাণের আইডিয়া

বিজয়ের মাসে মুক্তিযোদ্ধাদের সম্মান জানাতে এমন একটি অভিনব বিজ্ঞাপনের আইডিয়াটি সর্বপ্রথম যার মাথায় আসে তিনি বিজ্ঞাপনী সংস্থা বিটপি’র সিনিয়র ক্রিয়েটিভ ডিরেক্টর আদনান আদীব খান। প্রতিষ্ঠানটিতে কর্মসূত্রেই রবি’র প্রচারণামূলক কাজগুলোর জন্য নিয়োজিত ক্রিয়েটিভ টিম-এর নেতৃত্ব দিচ্ছেন তিনি।

“সাধারণ প্রোমোশনাল কনটেন্ট এর বাইরেও বিশেষ দিবসে আমরা বিভিন্ন ধরনের কনটেন্ট তৈরি করি। বিশেষ দিবসের জন্য আমরা কখনো কখনো আমাদের বিজ্ঞাপনের ভাষায় ‘প্রো-অ্যাকটিভ’ আইডিয়া তৈরি করতে হয়। যেটা ক্লায়েন্ট এর গতানুগতিক ফরমায়েসি কাজের বাইরে গিয়ে নিজেরাই তৈরি করি। ১৬ ডিসেম্বর উপলক্ষে এ আইডিয়াটাও একটা সে ধরনের আইডিয়া। হঠাৎই আমার মাথায় এসেছিল আইডিয়াটা। হুট করেই মনে এসেছিল, যে এমনও কি কোন মুক্তিযোদ্ধা আছেন, যারা কখনো স্মৃতিসৌধ দেখেন নাই! আইডিয়াটা যখন আমার মাথায় আসলো তখন সাথে সাথে চিফ ক্রিয়েটিভ অফিসারকে গিয়ে বললাম। আমাদের সিইও, এমডি তাদের সাথে শেয়ার করলাম। সবার আইডিয়াটা ভালো লাগলো। তারপর আমরা একটু খোঁজ নিলাম-যে সত্যিই এরকম কেউ আছেন কিনা। আমার গ্রামের কিংবা আমার সহকর্মীদের গ্রামের এমন কেউ আছেন কিনা যারা দেখেননি। একজন দু’জনকে পেয়েও গেলাম।”

শুরু হলো স্ক্রিপ্টের কাজ। একটি ক্রিয়েটিভ ও বড় গবেষণা টিম তৈরি করলো স্ক্রিপ্ট ও বাজেট। নিয়ে যাওয়া হল রবি’র কাছে। রবিও সাদরে গ্রহণ করলো আদনান আদীবের আইডিয়াটি।

“রবি টিমও খুব এক্সাইটেড হয়ে পড়ে যে এরকম একটা আইডিয়া এক্সিকিউট করবো আমরা। তারপর আমরা একটা বাজেট তৈরি করে প্রোডাকশান হাউজকে কাজটা দেই।”

আদনান আদীব জানান, শুধু নিজেরাই মুক্তিযোদ্ধাদের খুঁজে বের করার কাজটি করেননি। এ কাজে পূর্ণাঙ্গ সহযোগিতা করেছে মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর। তারাই মুক্তিযোদ্ধাদের পরিচয় নিশ্চিত করেন। মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে যোগাযোগ পর্বটিও ছিল আনন্দময়। বয়োবৃদ্ধ মুক্তিযোদ্ধাদের পরিবারের সাথে যোগাযোগ করা হলে প্রথম দিকে তারা বুঝতে পারছিলেন না- এটা কেমনতর কাজ! পরে যখন তারা বুঝতে পারেন, খুবই আনন্দিত হন। মুক্তিযোদ্ধারাও সানন্দে রাজি হন প্রত্যেকেই।

কেন এই মুক্তিযোদ্ধারা কখনো স্মৃতিসৌধ দেখতে পারেননি?

মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে একজন সিলেটের হবিগঞ্জের চা শ্রমিক হিরালাল মুন্ডা। যুদ্ধ করেছেন ৪ নম্বর সেক্টরে। মুক্তিযুদ্ধের পর সারাজীবন চা শ্রমিক হিসেবে আমু চা বাগানেই কাটিয়েছেন। তার একমাত্র ছেলেও তাই, জীবনে দু’বার মাত্র ঢাকায় এসেছিলেন। কখনো তাদের ঢাকায় আসার প্রয়োজন হয়নি, সুযোগও হয়নি।

ব্রাক্ষ্মণবাড়িয়ার অধিবাসী মুক্তিযোদ্ধা শামসুল আলম। যুদ্ধ করেছেন তিন নাম্বার সেক্টরে। মুক্তিযুদ্ধের সময় পায়ে গুলি খেয়েছিলেন। খুব একটা চলাফেরা করতে পারেন না। খুব বেশিদূর গেলে হয়তো গ্রামের বাজার পর্যন্ত। নিকটজন বলতে কেবল তার স্ত্রীকে নিয়েই তার বসবাস। ঢাকায় আসা হলেও কখনো স্মৃতিসৌধ পযন্ত আসার সুযোগ হয়নি তার।

নেত্রোকোনার বাসিন্দা নাজিম উদ্দিন খান। ১১ নম্বর সেক্টরের বীর মুক্তিযোদ্ধা। তিনিও স্ত্রীকে নিয়েই একা জীবন যাপন করেন। কখনো নেত্রোকোনা শহরের বাইরে যাওয়ার কথা ভাবতেই পারেননি।

পাবনার মুক্তিযোদ্ধা আব্দুস সাত্তার মোল্লা। যুদ্ধ করেছেন সাত নম্বর সেক্টরে। পরিবার থেকে কখনোই তাকে খুব বেশি বাইরে চলাফেরা করতে দেয়া হয় না। সারাজীবনে ঢাকায় এসেছিলেন দু’বার। শুটিংয়েও তাকে নিয়ে আসতে বেগ পেতে হয়েছে টিমের সকলের। বয়োবৃদ্ধ চার মুক্তিযোদ্ধার সকলকেই রাখতে হয়েছে পরম যত্নে।

আদনান আদীব জানান, তাদের যখন ঢাকায় আনা হয়, স্মৃতিসৌধে যাওয়ার আগ মুহূর্ত পযন্ত তারা প্রচণ্ড ‘থ্রিলড’ অনুভব করছিলেন। সে দৃশ্য ছিল দেখার মতো।

বিজ্ঞাপনে তুলে ধরা হয় তাদের সত্যিকার অনুভূতি

বিজ্ঞাপনটি যে প্রোডাকশান হাউজটি নির্মাণ করে তার নাম রেট্রো পিকচার্স। প্রযোজক গোলাম দস্তগীর শান। পরিচালকের নাম সজল আহমেদ। সকাল সন্ধ্যার মুখোমুখি হন তারাও। জানান এটি নির্মাণ পর্বের গল্প। সজল জানান, মুক্তিযোদ্ধাদের কখনো বুঝতে দেয়া হয়নি শুটিং হচ্ছে, ক্যামেরা চলছে। কৃত্রিম কোনও দৃশ্যায়ন করতে হয়নি তাদের।

সজল আহমেদ বলেন, “যখন বিটপী থেকে আমাদের ডাক আসে, তখন আমরা যাই। গল্পটি শুনি, আইডিয়াটা শুনেই আমার গায়ের রোম দাঁড়িয়ে যায়। তাৎক্ষণিক সিদ্ধান্ত নেই কাজটি আমরা করবো। প্রথম কিছুদিন আমি শুধুই ভেবেছি কিভাবে তাদের উপস্থাপন করবো। কিভাবে চারজন রিয়েল মুক্তিযোদ্ধাকে সঠিক সম্মানটা দেখিয়ে এটি নির্মাণ করবো। তিন-চারদিন শুধুই ভেবেছি। প্রথমে আমরা বিজ্ঞাপনের পেছনের ভয়েজ স্ক্রিপ্টটা দেখি, সেটা তৈরি করি। গল্পের প্রাণটা সে জায়গা থেকেই আসে।”

তারপরই আমরা পুরো প্রোডাকশান টিম নেমে পড়ি। আমরা চেয়েছি অথেনটিক লোকেশনটাতে গিয়েই শুটিংটা করি। আমার প্রডিউসার গোলাম দস্তগির শান পরিকল্পনা ও বাজেটটি মঞ্জুর করেন। সে কারণেই আমরা যা করতে চেয়েছি তা করতে পেরেছি। মুক্তিযোদ্ধাদের পরিপূর্ণ সম্মান দিয়ে একদিন আগে আমরা তাদের ঢাকায় নিয়ে আসি। তারপর একদম অনটাইম লাইভ মোমেন্টাতে আমরা শুটিংটা করেছি।

ওনারা সবাই খুব সহযোগিতা করেছেন। এটার সঙ্গে যারা যারা জড়িত ছিল সকলেই সর্বোচ্চটুকু দিয়ে কাজ করেছে বলেই এটাতে প্রাণ প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।

বিজ্ঞাপনটি প্রচারের পর…

নির্মাতা সজল আহমেদ জানান, বিজ্ঞাপনটি টিভিতে প্রচারের পর অংশ নেয়া মুক্তিযোদ্ধাদের সকলেই খুব আনন্দিত হয়েছেন। ফোন করেছেন তাকে। বিজ্ঞাপনটি নির্মাণের সময় প্রত্যেকেই একবাক্যে বলেছেন, ‘স্বাধীনতার পর এই প্রথম আমরা হয়তো পরিপূর্ণ সম্মানটুকু পাচ্ছি।’ কাজের সময়ও তাদের আমরা সে সম্মানটুকু দিতে চেষ্টা করেছি। তারা প্রায়ই ফোন করেন, কথা বলেন, তাদের ‍উচ্ছ্বাস প্রকাশ করেন। তাদের সাথে হৃদ্যতার একটা সম্পর্ক হয়ে গেছে। প্রচারের পর সাধারণ মানুষের কাছ থেকে এত অভূতপূর্ব সাড়া কাজটিকে সার্থক করেছে।

বিজ্ঞাপনটির প্রযোজক গোলাম দস্তগির শান বলেন, “যে কোন প্রোডাকশান হাউজের একটা ড্রিম থাকে এ ধরনের একটি কাজ করার। সাধারণত বিজ্ঞাপন দেখে আমরা স্কিপ করি, বিরক্ত হই। ওই জায়গা থেকে এরকম একটা বিজ্ঞাপন যেটা একাত্তরকে নিয়ে হবে সেরকম একটা কাজ আমাদের প্রোডাকশান হাউজ থেকে হবে এটা একটা ভাগ্যের ব্যাপার। খুব চার্মিং ব্যাপার। আমাদের পরিকল্পনা অনুযায়ী কাজটা করতে পেরেছি এটা আমাদের জন্য বড় পাওয়া। হিরালাল মুণ্ডার মতো মুক্তিযোদ্ধাকে যে এখন সারাদেশের মানুষ চিনতে পারছে তা থেকে বড় প্রাপ্তি আর কী হতে পারে…।”

সবশেষে, নিজের প্রতিক্রিয়া জানিয়ে আদনান আদীব বলেন, “আমিতো মুক্তিযুদ্ধ দেখিনি, মুক্তিযোদ্ধাদের কাছ থেকে দেখতে পারা, তাদের সম্মান জানানোর একটা উপলক্ষ তৈরি করতে পেরে আমি খুবই আনন্দিত, গর্বিত ও উদ্বেলিত।”

আরও পড়ুন

সর্বশেষ

সর্বাধিক পঠিত