সাওয়ারসোপ ফলটি নাকি কাস্টার্ড আপেলের নিকট আত্মীয়। ইংরেজিতে কাস্টার্ড আপেল শুনে ভিনদেশি ফল মনে হচ্ছে কি? কাস্টার্ড আপেল হলো আমাদের চিরচেনা আতা ফল; অঞ্চলভেদে যার অন্য নাম শরিফা, নোনা।
সাওয়ারসোপ ফলটি অনেকের কাছে অচেনা লাগতে পারে। কিন্তু দেশে গত কয়েক বছরে বৃক্ষমেলা এবং খবরে আলোচিত টক আতা সবার ঠিকই চেনা আছে। এর অন্য নাম আবার লক্ষণ ফল এবং গ্র্যাভিওলা; বাংলাদেশে করোসল ফল নামেও এর পরিচিতি আছে।
ক্যানসার প্রতিরোধে টক আতার জাদুকরি গুণ রয়েছে বলে মাঝেমধ্যেই খবরে শিরোনাম হয়। করোসল পাতার রস খেয়ে ক্যানসার রোগের জন্য আলাদা চিকিৎসা না করেই সুস্থ আছেন এমনও দাবিও এসেছে। দেশের কয়েকটি এলাকায় টক আতা ফলের গাছ চাষও হচ্ছে কয়েক বছর ধরে।
খেলে কি ক্যানসার সেরে যাবে?
দেশে চিকিৎসকদের কাছে এমন কোনো বৈজ্ঞানিক তথ্য-প্রমাণ এখন পর্যন্ত নেই। তবে আসলে টক আতা ক্যানসার নিরাময় করতে পারে না।
টক আতা ফলের কাঁটাযুক্ত ত্বকের রঙ গাঢ় সবুজ। ফলটির আকার ডিমের মতো এবং প্রায় ১২ ইঞ্চি পর্যন্ত লম্বা হতে পারে। ফলের ভেতরে অংশ রসালো এবং সাদা রঙের। ফলের স্বাদ টক-মিষ্টি। অনেকেই বলেন, এই ফল খেতে সুস্বাদু।
এই ফলে কয়েক ধরনের ভিটামিন গুণও রয়েছে। এরপরও টক আতা ক্যানসার তাড়ানোর ওষুধ বলে সোশাল মিডিয়ায় ওঠা হইচইকে স্রেফ ভ্রান্তি বলে এক প্রতিবেদনে জানাচ্ছে ইন্ডিয়া টুডে।
ইনস্টাগ্রামের ২০০ কোটির মত সক্রিয় ব্যবহারকারী আছে আর ফেসবুকে আছে ৩০০ কোটির উপরে। সোশাল মিডিয়ায় এখন অনেক ধরনের কনটেন্টের মাঝে স্বাস্থ্য নিয়ে অসংখ্য রিলস, ভিডিও আসছে। এসব কনটেন্টে স্বাস্থ্য নিয়ে হরেক রকম পরামর্শ থাকে।
ইনস্টাগ্রাম এবং ফেইসবুকে টক আতার ক্যানসাররোধী গুণ নিয়ে কনটেন্ট ইদানীং ট্রেন্ডিং বলে জানাচ্ছে ইন্ডিয়া টুডে। এসব প্রচার-প্রচারণার প্রভাব পড়েছে বাজারে। এরমধ্যে টক আতার জুস, সাপ্লিমেন্টস চলে এসেছে; প্রোটিন পাউডারের সঙ্গেও টক আতা মেশানো আছে বলা হচ্ছে।
এমনকি তাজা ফল বাজারেও টক আতার কাটতি বেড়ে গেছে। ২০২১ সালে টক আতার বৈশ্বিক ব্যবসা ছিল ১৫ কোটি ডলার। ধারণা করা হচ্ছে ২০২৭ সাল নাগাদ চার লাখ ৫৫ হাজার ৬০০ টন টক আতার উৎপাদন হবে। আর এর বাজার মূল্য হবে ৩৫ কোটি ডলার।
গ্রীষ্মমণ্ডলীয় অঞ্চলের এই ফল পশ্চিমে বেশ কাটতি পেয়েছে এরমধ্যে। সোশাল মিডিয়ার প্রভাবে ভারতেও এই টক আতা নিয়ে তথ্যবিভ্রাট দেখা দিয়েছে।
অনেক চিকিৎসক আছেন যারা আবার সোশাল মিডিয়াতে ইনফ্লুয়েন্সার হয়ে উঠেছেন। এই ইনফ্লুয়েন্সাররা দাবি করছেন, ক্যানসারের চিকিৎসায় কেমোথেরাপির মতো কার্যকর হয়ে ওঠে টক আতা ফল।
বিশেষজ্ঞরা কী বলছেন?
টক আতাতে প্রচুর পরিমাণে অ্যান্টি-অক্সিডেন্ট গুণ রয়েছে; এ কথা বিশেষজ্ঞরাও বলছেন। কিন্তু এখনও পর্যন্ত এই ফলের ক্যানসার বিরোধী গুণের সুস্পষ্ট প্রমাণ উঠে আসেনি কোনো গবেষণায়।
স্যার গঙ্গারাম হসপিটালের সার্জিকাল অনকোলজি বিভাগের প্রধান এবং চেয়ারম্যান চিন্তামনি জোর দিয়ে বলেন, “এমন কোনোই প্রমাণ নেই যা থেকে আমরা বলতে পারি, এই টক আতা কারও ক্যানসার দূর করতে নিরাপদ চিকিৎসা।”
আর টক আতা ফলে যে অ্যান্টি-অক্সিডেন্ট এবং প্রদাহরোধী গুণ আছে তাও এখনও ক্লিনিকাল ট্রায়ালে দেখা হয়নি।
এ কারণে চিন্তামনি বলেন, “এই ফলের অ্যান্টি-ক্যানসার ক্ষমতা নিয়ে সন্দেহের অবকাশ আছে। এমনকি নিয়মিত খেলে মানুষের শরীর কতটুকু নিরাপদ থাকবে তাও দেখার বিষয়।”
গুরুগ্রামের ফর্টিস মেমোরিয়াল রিসার্চ ইনস্টিটিউটে মেডিকেল অনকোলজি বিভাগের সিনিয়র কনসালটেন্ট ড. সুমন এস কারান্থ জানালেন, পরীক্ষাগারে প্রাণির প্রোস্টেট, ফুসফুস, কোলন এবং স্তন ক্যানসার কোষে এই ফলের কার্যকারিতা পাওয়া গেছে।
“কিন্তু এমন গবেষণা এখনও মানব শরীরে পরিচালনা করা হয়নি।”
ক্লিনিকাল ট্রায়াল ছাড়া মানুষের ক্যানসার চিকিৎসায় টক আতা ফলে ভরসা করতে সতর্ক করলেন ড. কারান্থ।
এছাড়া এই ফল বেশি খেলে বিষক্রিয়া দেখা দিতে পারে। টক আতার অ্যাসিটোজেনিন যৌগের কারণে নিউরোটক্সিসিটি দেখা দিতে পারে; কমে যেতে পারে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাও।
গুরুগ্রামের সিকে বিরলা হসপিটালের মেডিকেল অনকোলজি বিভাগের পরামর্শক ড. পূজা বাব্বার আরেকটু ব্যাখ্যা যোগ করে বলেন, এই অ্যাসিটোজেনিন ক্যানসার কোষের ঝিল্লির যৌগগুলোর উপরও বিষক্রিয়া করতে পারে।
শেষমেশ বিশেষজ্ঞদের কথার সারমর্ম হচ্ছে, পরীক্ষাগারে প্রাণীদেহে এই ফলের ক্যানসার ঠেকানোর মতো কার্যকারিতা দেখা গেলেও মানব দেহে এমন কোনো পরীক্ষা চালানো হয়নি। ফলে টক আতা ক্যানসার সারাতে পারে তা কোনোভাবেই প্রমাণিত নয়।
তাহলে কি টক আতা খাওয়া বাদ দিতে হবে?
ক্যানসার ঠেকাতে পারার প্রমাণ না হলেও এটা ঠিক যে টক আতা ফলের পুষ্টিগুণ আছে। এই ফলে আছে ভিটামিন সি, বি১, বি২। অ্যান্টি-অক্সিডেন্ট ও ফাইবারের সঙ্গে টক আতায় আরও আছে পটাসিয়াম, ম্যাগনেসিয়াম, ক্যালসিয়ামের মতো মিনারেল।
ব্যাঙ্গালুরুতে একটি যোগাসন ও নেচারোপ্যাথি কেন্দ্রের পরামর্শক ড. শিল্পা এম আর জানালেন, ভিটামিন সি বেশি থাকায় এই ফল খেলে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়বে। শ্বেত রক্তকণিকা বাড়বে টক আতা খেলে।
টক আতা ফলে বেশি পরিমাণ ফাইবার থাকায় হজম শক্তি ভালো থাকে এবং কোষ্ঠকাঠিন্য প্রতিরোধ হয়। আবার পটাসিয়াম থাকায় রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে থাকে। অ্যান্টি-অক্সিডেন্ট এবং ভিটামিন সি থাকার কারণে টক আতা ফল খেলে কোলাজেন উৎপাদন বাড়ে। অর্থাৎ বুড়িয়ে যাওয়ার প্রবণতা ঠেকাতে পারে এই ফল।
রক্তে শর্করার পরিমাণ বেশি থাকলে টক আতা ফল খেলে উপকার মিলবে।
স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ, টাটকা টক আতা ফল খাওয়াই ভালো। বাজারে যেসব সাপ্লিমেন্ট মিলছে তা এখনও ফুড অ্যান্ড ড্রাগ অ্যাডমিনিস্ট্রেশন থেকে অনুমোদিত নয়।
তবে টক আতার পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া নিয়ে সচেতন থাকতে হবে। এই ফল বেশি খেলে মাথা ঘোরা ও বমি হতে পারে। কারও কারও রক্তচাপ কমেও যেতে পারে। কারও বেলায় এলার্জি দেখা দিতে পারে বলে সতর্ক করলেন ড. শিল্পা।