বিশ বছর আগে ১০ ট্রাক অস্ত্র আটকের মামলায় বিচারিক আদালতের রায়ে মৃত্যুদণ্ড হয়েছিল সাবেক স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবরের; তবে হাই কোর্টের রায়ে খালাস পেলেন তিনি।
২১ আগস্টের গ্রেনেড হামলার মামলায়ও মৃত্যুদণ্ড থেকে এই মাসের শুরুতে হাই কোর্টের রায়ে খালাস পেয়েছিলেন বাবর।
তার তিন সপ্তাহের মধ্যে বুধবার ১০ ট্রাক অস্ত্র আটকের মামলাটিতে রায় দেয় বিচারপতি মোস্তফা জামান ইসলাম ও বিচারপতি নাসরিন আক্তারের হাই কোর্ট বেঞ্চ।
রায়ে বাবরের পাশাপাশি আরও ছয়জন খালাস পেয়েছেন। উলফার সামরিক কমান্ডার পরেশ বড়ুয়ার মৃত্যুদণ্ডের সাজা কমিয়ে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে। বাকি ছয় আসামির সাজা মৃত্যুদণ্ড থেকে কমিয়ে ১০ বছর কারাদণ্ড করা হয়েছে।
বাংলাদেশের ইতিহাসে অবৈধ অস্ত্রের সবচেয়ে বড় চালান আটকের ঘটনাটিতে ১০ বছর আগে দেওয়া রায়ে চট্টগ্রাম মহানগর বিশেষ ট্রাইব্যুনাল-১ ১৪ আসামির সবারই মৃত্যুদণ্ড দিয়েছিল।
রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের পর সেই আসামিদের কাউকে খালাস ও কারও সাজা কমিয়ে দেওয়া হাই কোর্টের রায়ে বলা হয়েছে, এই মামলার তদন্তে যথেষ্ট ত্রুটি ছিল।
বাবরের পাশাপাশি সিইউএফএল এর সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোহসিন উদ্দিন তালুকদার, সিইউএফএল’র সাবেক ব্যবস্থাপক (প্রশাসন) এনামুল হক এবং প্রতিরক্ষা গোয়েন্দা সংস্থার সাবেক প্রধান অবসরপ্রাপ্ত মেজর জেনারেল রেজ্জাকুল হায়দার চৌধুরী খালাস পেয়েছেন। পলাতক থাকা আসামি সাবেক শিল্প সচিব নুরুল আমিনকেও খালাস দেওয়া হয়েছে।
জামায়াতে ইসলামীর আমির, সাবেক শিল্পমন্ত্রী মতিউর রহমান নিজামী এবং অবসরপ্রাপ্ত ব্রিগেডিয়ার জেনারেল আবদুর রহিমও এই মামলায় মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত ছিলেন।
যুদ্ধাপরাধে নিজামীর মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হয়েছে, রহিম কারাগারে থাকা অবস্থায় মারা গেছেন। তবে তাদের দুজনকেও রায়ে খালাস দেওয়া হয়েছে।
পলাতক উলফা নেতা পরেশ বড়ুয়ার পাশাপাশি সাজা কমেছে জাতীয় গোয়েন্দা সংস্থার (এনএসআই) সাবেক পরিচালক অবসরপ্রাপ্ত উইং কমান্ডার সাহাব উদ্দিন আহাম্মদ, সাবেক উপপরিচালক অবসরপ্রাপ্ত মেজর লিয়াকত হোসেন, সাবেক মাঠ কর্মকর্তা আকবর হোসেন খান, হাফিজুর রহমান, দীন মোহাম্মদ ও হাজি আব্দুস সোবাহান।
বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার আমলে ২০০৪ সালের ১ এপ্রিল মধ্যরাতে চট্টগ্রামের আনোয়ারায় কর্ণফুলী নদী তীরে রাষ্ট্রায়ত্ত সার কারখানা চিটাগাং ইউরিয়া ফার্টিলাইজার লিমিটেডের (সিইউএফএল) সংরক্ষিত জেটিঘাটে দুটি মাছ ধরার ট্রলার থেকে বিপুল পরিমাণ অস্ত্র খালাস করে ট্রাকে তোলার সময় পুলিশ আটক করে।
পরে তদন্তে দেখা যায়, চীনের তৈরি এসব অস্ত্র ও গোলাবারুদ সমুদ্রপথে আনা হয়েছিল ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের বিদ্রোহী সংগঠন ‘উলফা’র জন্য। এই চালান বাংলাদেশ হয়ে ভারতে যাওয়ার কথা ছিল।
অস্ত্র উদ্ধারের পর ৩ এপ্রিল চট্টগ্রামের কর্ণফুলী থানায় ১৯৭৪ সালের বিশেষ ক্ষমতা আইনে চোরাচালানের অভিযোগে একটি এবং অস্ত্র আইনে আরেকটি মামলা হয়।
বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার আমলে মামলায় অভিযোগপত্র দেওয়া হয়েছিল। তবে ২০০৭ সালে সেনা সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় রাষ্ট্রপক্ষ আবার তদন্তের দাবি করে। এরপর ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় যাওয়ার পর আবার তদন্ত হয়।
অধিকতর তদন্তের পর জোট সরকারের শিল্পমন্ত্রী নিজামী, স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী বাবর ও উলফা নেতা পরেশ বড়ুয়াসহ ১১ জনকে নতুন করে আসামি করা হয়। সব মিলিয়ে আসামি দাঁড়ায় ৫২ জন।
২০১৪ সালের ৩০ জানুয়ারি দুই মামলায় চট্টগ্রামের আদালতে এক সঙ্গে রায় হয়। তাতে ৩৮ আসামি খালাস পায়।
চোরাচালান মামলায় বিশেষ ক্ষমতা আইনের ২৫ বি ও ২৫ ডি ধারায় ১৪ আসামির ফাঁসির দণ্ডাদেশ হয়। অস্ত্র আইনে ওই ১৪ জনকে দেওয়া হয় যাবজ্জীবন কারাদণ্ড।
আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকাকালে আলোচিত এই মামলার রায় হয়েছিল। ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে গত আগস্টে তাদের সরকারের পতনের পর গত ৬ নভেম্বর এ মামলায় আসামিদের ডেথ রেফারেন্স (মৃত্যুদণ্ড অনুমোদন) ও আপিলের শুনানি শুরু হয়।
খালেদা জিয়ার সরকারের স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী বাবরসহ কয়েকজন আসামির আইনজীবী এস এম শাহজাহান রায়ের পর সাংবাদিকদের বলেন, তারা ন্যায় বিচার পেয়েছেন।
এই অস্ত্রের উৎস ও গন্তব্য নিয়ে যথেষ্ট প্রমাণ ছিল না দাবি করে তিনি বলেন, “এ মামলার শুরু থেকে আমরা কোর্টকে বলেছি, এই অস্ত্রশস্ত্র কোত্থেকে এসেছে, কোথায় যাবে, এগুলোর বাহক কারা? এটা যদি চোরাচালানের জন্য আনতে হয়, তাহলে বাংলাদেশের আইনে প্রমাণ করতে হলে দেখতে হবে যে, আর্থিকভাবে লাভবান হওয়ার জন্য হয়েছে।
“কিন্তু এখানে বিচারিক আদালতের রায়ে বলা হয়েছিল, অস্ত্রগুলো পার্শ্ববর্তী কোনও দেশে পাচার করার জন্য আনা হয়েছে। আমরা এটাই বলার চেষ্টা করেছি।”
২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলার মামলার মতো এ মামলায়ও প্রথম একটি তদন্তের পর ২৮ জন সাক্ষীর সাক্ষ্য নেওয়া হয়েছিল জানিয়ে এই আইনজীবী বলেন, “এরপর সরকার (আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় যাওয়ার পর) পরিবর্তনের ফলে আবার তদন্ত ও বিচার হয়ে একটি রায় হয়।
“এ মামলার বিচারিক আদালতে সমস্ত আসামিকে ফাঁসি দেওয়া হয়েছিল। এটা আমার ওকালতি জীবনে কমই দেখেছি।”
সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে আইনজীবী শাহজাহান বলেন, “অস্ত্রগুলো কারা এনেছিল, এটা প্রমাণ করতে রাষ্ট্রপক্ষ ব্যর্থ হয়েছে।”
বাবরের আইনজীবী মোহাম্মদ শিশির মনির সাংবাদিকদের বলেন, “দ্বিতীয় তদন্তের ভিত্তিতে লুৎফুজ্জামান বাবরকে এ মামলায় প্রধান আসামি করা হয়েছিল। হাই কোর্ট উনাকে খালাস দিয়েছেন এই কথা বলে যে, তিনি রাজনৈতিক উদ্দেশ্যের শিকার। তার বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট প্রমাণ কেউ হাজির করতে পারেনি।”
যারা ১০ বছরের সাজা ভোগ করেছেন, তাদের বিষয়ে রায়ের পর্যবেক্ষণ তুলে ধরে শিশির মনির বলেন, “ফৌজদারি কার্যবিধির ৩৫ (ক) ধারা প্রযোজ্য হবে। এর অর্থ হলো তারা বিচার চলা অবস্থায় যতদিন কারাগারে ছিলেন, এটি তাদের সাজার মেয়াদ থেকে বাদ যাবে।
“যদি বাদ যায় তাহলে তারা ১০ বছরের অধিক সময়, ২০০৪ সাল থেকে আজ পর্যন্ত তাদের কারাবাস হয় প্রায় ২০ বছর। ফলে তাদেরকে মুক্তি দিতে হবে।”
আসামিপক্ষের আইনজীবী শিশির মনির জানান, মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত ১৪ আসামির মধ্যে আপিল করেন চারজন, তারা খালাস পেয়েছেন। পলাতক আসামি নুরুল আমিনকেও খালাস দেওয়া হয়েছে। রায়ে নিজামী ও রহিমও খালাস পেয়েছেন।
প্রয়াত নিজামী ও রহিমের কোনও আপিল না থাকা সত্ব্বেও আদালত কোন যুক্তিতে খালাস দিল- জানতে চাইলে আইনজীবী শাহজাহান বলেন, “তাদের কোনও আপিল ছিল না, তারপরও কোর্ট বলেছেন- এই মামলার সব এভিডেন্স ও আদ্যোপান্ত বিবেচনা করে এই দুই জনের বিরুদ্ধে সাজা রাখার মতো কোনও এভিডেন্স নেই। এই জন্য তাদেরকে খালাস দিয়েছে।”
শিশির মনির বলেন, “পেপারবুকের হাজার হাজার পৃষ্ঠার কোথাও মতিউর রহমান নিজামীর নাম ছিল না যে, তিনি সামান্যতম অপরাধে ছিলেন। এমনকি তদন্ত কর্মকর্তার সাক্ষ্যেও উনার বিষয়ে কোনও বক্তব্য ছিল না। আমি কোর্টকে বলেছি, উনি দুনিয়াতে নেই, যদি নির্দোষ সাব্যস্তে খালাস পান, ন্যায়বিচার পান, তাহলে উনার আত্মা শান্তি পাবে।”