ফৌজদারি মামলায় অভিযুক্তের মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গে তার বিরুদ্ধে মামলাও নিষ্পত্তি হয়ে যায়। মতিউর রহমান নিজামীর মৃত্যু হয়েছে আট বছর আগে; ১০ ট্রাক অস্ত্র মামলায় মৃত্যুদণ্ডের রায়ের বিরুদ্ধে তার আপিলও ছিল না। কিন্তু এই মামলায় হাই কোর্টের রায়ে তাকেও খালাস দিয়েছে হাই কোর্ট।
ন্যায়বিচারের স্বার্থে উচ্চ আদালত নিজামীকে খালাস দিয়েছে বলে বুধবার রায়ের পর বলেছেন আইনজীবী মোহাম্মদ শিশির মনির, যিনি এই মামলার পাশাপাশি যুদ্ধাপরাধের মামলায় জামায়াত নেতাদের হয়ে আইনি লড়াই চালিয়েছিলেন।
একাত্তরে ইসলামী ছাত্র সংঘের সারা পাকিস্তানের সভাপতির দায়িত্ব পালনকারী মতিউর রহমান নিজামী ২০০১ সালে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর আমির হন।
পাবনা থেকে একাধিকবার নির্বাচিত সংসদ সদস্য নিজামী ২০০১ সালে খালেদা জিয়া নেতৃত্বাধীন বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারে প্রথমে কৃষিমন্ত্রী ও পরে শিল্পমন্ত্রী হয়েছিলেন।
নিজামী শিল্পমন্ত্রী থাকাকালে ২০০৪ সালের ১ এপ্রিল মধ্যরাতে চট্টগ্রামের আনোয়ারায় কর্ণফুলী নদী তীরে রাষ্ট্রায়ত্ত সার কারখানা চিটাগাং ইউরিয়া ফার্টিলাইজার লিমিটেডের (সিইউএফএল) জেটিঘাটে দুটি মাছ ধরার ট্রলার থেকে বিপুল পরিমাণ অস্ত্র ধরা পড়ে।
১০ ট্রাক সমপরিমাণ অস্ত্র পুলিশ আটকের পর তদন্তে দেখা যায়, চীনের তৈরি এসব অস্ত্র ও গোলাবারুদ সমুদ্রপথে আনা হয়েছিল ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের বিদ্রোহী সংগঠন ‘উলফা’র জন্য। এই চালান বাংলাদেশ হয়ে ভারতে যাওয়ার কথা ছিল।
অস্ত্র উদ্ধারের পর ৩ এপ্রিল চট্টগ্রামের কর্ণফুলী থানায় ১৯৭৪ সালের বিশেষ ক্ষমতা আইনে চোরাচালানের অভিযোগে একটি এবং অস্ত্র আইনে আরেকটি মামলা হয়।
জোট সরকার আমলে মামলায় অভিযোগপত্র দেওয়া হলেও ২০০৭ সালে সেনা সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় রাষ্ট্রপক্ষ আবার তদন্তের দাবি করে।
অধিকতর তদন্তের পর জোট সরকারের শিল্পমন্ত্রী নিজামী, স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবর ও উলফা নেতা পরেশ বড়ুয়াসহ ১১ জনকে নতুন করে আসামি করা হয়।
২০১৪ সালের ৩০ জানুয়ারি দুই মামলায় চট্টগ্রামের আদালতে এক সঙ্গে রায় হয়। তাতে ৩৮ আসামি খালাস পেলেও নিজামী বাবরসহ ১৪ আসামির মৃত্যুদণ্ডাদেশ হয়।
বাংলাদেশের ইতিহাসে সবচেয়ে বড় অস্ত্র আটকের এই মামলায় নিজামীকে জড়ানো রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ছিল বলে জামায়াত দাবি করে আসছিল।
এদিকে একাত্তরে বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ডের ‘হোতা’ হিসাবে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল ওই বছরের অর্থাৎ ২০১৪ সালের ২৯ অক্টোবর নিজামীকে মৃত্যুদণ্ড দেয়। ওই রায়ের বিরুদ্ধে নিজামী আপিল করলেও তার মৃত্যুদণ্ড বহালই থাকে।
এরপর রাষ্ট্রপতিও তার প্রাণভিক্ষার আবেদন নাকচ করলে ২০১৬ সালের ১১ই মে নিজামীর মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয় ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে।
এদিকে বাবরসহ অন্য আসামিরা ১০ ট্রাক অস্ত্র মামলায় বিচারিক আদালতের রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করলেও নিজামী মারা যাওয়ায় তা করতে পারেননি। আপিল ছিল না এই মামলায় মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত সাবেক সেনা কর্মকর্তা আবদুর রহিমেরও। তিনি কারাবন্দি থাকা অবস্থায় মারা যান।
দীর্ঘদিন ঝুলে থাকার পর ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে গত আগস্টে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর গত ৬ নভেম্বর এ মামলায় আসামিদের ডেথ রেফারেন্স (মৃত্যুদণ্ড অনুমোদন) ও আপিলের শুনানি শুরু হয়।
১১ কার্যদিবস শুনানির পর বুধবার রায় দেয় বিচারপতি মোস্তফা জামান ইসলাম ও বিচারপতি নাসরিন আক্তারের হাই কোর্ট বেঞ্চ। তাতে মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত ১৪ আসামির ছয়জনকে খালাস দেওয়া হয়। বাকি আটজনের সাজাও কমে।
মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত ১৪ আসামির মধ্যে চারজন আপিল করলেও নিজামী তার মধ্যে ছিলেন না বলে জানান আসামিপক্ষের আইনজীবী শিশির মনির।
তিনি বলেন, “আমি কোর্টকে বলেছি, উনি দুনিয়াতে নেই, যদি নির্দোষ সাব্যস্তে খালাস পান, ন্যায়বিচার পান, তাহলে উনার আত্মা শান্তি পাবে।”
আদালত কোন যুক্তিতে খালাস দিল- জানতে চাইলে আসামি পক্ষের আইনজীবী এস এম শাহজাহান সাংবাদিকদের বলেন, “তাদের (নিজামী-রহিম) কোনও আপিল ছিল না, তারপরও কোর্ট বলেছেন- এই মামলার সব এভিডেন্স ও আদ্যোপান্ত বিবেচনা করে এই দুই জনের বিরুদ্ধে সাজা রাখার মতো কোনও এভিডেন্স নেই। এই জন্য তাদেরকে খালাস দিয়েছে।”
শিশির মনির বলেন, “পেপারবুকের হাজার হাজার পৃষ্ঠার কোথাও মতিউর রহমান নিজামীর নাম ছিল না যে, তিনি সামান্যতম অপরাধে ছিলেন। এমনকি তদন্ত কর্মকর্তার সাক্ষ্যেও উনার বিষয়ে কোনও বক্তব্য ছিল না।”