বাংলাদেশের অর্থনৈতিক সংস্কারে এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের (এডিবি) সঙ্গে ৬০ কোটি ডলারের বাজেট সহায়তা ঋণের চূড়ান্ত চুক্তি হয়েছে।
বুধবার অর্থ মন্ত্রণালয়ের অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগ (ইআরডি) ও এডিবির মধ্যে এই ঋণ চুক্তি হয়েছে রাজধানীর শেরেবাংলা নগরের এনইসি সম্মেলন কক্ষে। চুক্তিতে ইআরডি সচিব মো. শাহরিয়ার কাদের ছিদ্দিকী ও এডিবির বাংলাদেশ কার্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত আবাসিক প্রতিনিধি জিংবো নিং সই করেন।
গত বুধবার ম্যানিলায় এডিবির বোর্ড সভায় বাংলাদেশের জন্য এই ঋণ অনুমোদন পায়। এখন চূড়ান্ত চুক্তি স্বাক্ষরিত হওয়ায় শিগগির এই অর্থ বাংলাদেশের রিজার্ভে যুক্ত হবে।
‘স্ট্রেনদেনিং ইকোনমিক ম্যানেজমেন্ট অ্যান্ড গভর্নেন্স প্রোগ্রাম, সাবপ্রোগ্রাম-১’ শীর্ষক কর্মসূচী বাস্তবায়নে এই ঋণ দিচ্ছে এডিবি। চুক্তির আওতায় বাজেট সহায়তা হিসেবে এডিবি জাপানি মুদ্রায় ৯ হাজার ১৭৬ কোটি ইয়েন দিচ্ছে। বর্তমান বিনিময় হার অনুযায়ী এর পরিমাণ ৬০ কোটি মার্কিন ডলার। আর বাংলাদেশি মুদ্রায় ৭ হাজার ২০০ কোটি টাকা।
বিশ্বব্যাংক, এডিবিসহ বিভিন্ন দাতা সংস্থা প্রকল্প সহায়তার পাশাপাশি বাজেট সহায়তাও দিয়ে থাকে। বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্পের বিপরীতে বিনিয়োগ হিসেবে সহায়তা দেয় তারা। এ ছাড়া সরকারকে অনেকটা নগদ অর্থ হিসেবে বাজেট সহায়তা দেয়। এই অর্থ সরকার নিজের মতো করে খরচ করতে পারে।
তবে দুই ক্ষেত্রেই নানা ধরনের সংস্কারের শর্তও থাকে। বাজেট সহায়তা ঋণে প্রকল্প ঋণের চেয়ে নমনীয় শর্ত থাকে।
রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের পর বিভিন্ন দাতা সংস্থার প্রতিনিধিরা প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে ৩ বিলিয়ন ডলারের বেশি বাজেট সহায়তার আশ্বাস দেয়।
প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে ইআরডি জানিয়েছে, এটি একটি নীতি ভিত্তিক ঋণ। বাংলাদেশের অর্থনৈতিক সংস্কার, আর্থিক ব্যবস্থাপনা শক্তিশালীকরণ, রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন সংস্থার ব্যবস্থাপনা ও উন্নত বিনিয়োগ পরিবেশ এবং বাণিজ্য নীতি শক্তিশালীকরণের শর্তে এই ঋণ দিচ্ছে এডিবি।
ইআরডি আরও জানিয়েছে, এডিবির এই ঋণের পূর্ব শর্তগুলোর মধ্যে কিছু শর্ত ইতোমধ্যে অর্জিত হয়েছে।
এই ঋণ দিয়ে বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ ও পাবলিক প্রাইভেট পার্টনারশিপ (পিপিপি) কর্তৃপক্ষ, বাংলাদেশ প্রতিযোগিতা কমিশন এবং যৌথমূলধন কোম্পানি ও ফার্মসমূহের পরিদপ্তর সংস্কার করা হবে।
পরিকল্পনা কমিশনের কার্যক্রম বিভাগ, জাতীয় রাজস্ব বোর্ড ও বাংলাদেশ ব্যাংকের মাধ্যমে এ কর্মসূচি বাস্তবায়ন করা হবে। নীতি সংস্কারের মাধ্যমে দেশের অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনা শক্তিশালীকরণ এবং বেসরকারি খাতের উন্নয়নে স্বচ্ছ ও জবাবদিহিমূলক নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা জোরদার করা হবে।
এ বিষয়ে এডিবির একজন কর্মকর্তা সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, এই ঋণের অর্থ মূলত বাজেট সহায়তা হিসেবেই দেওয়া হচ্ছে। এখন চূড়ান্ত চুক্তি হয়ে যাওয়ায় খুব শিগগির এই অর্থ এডিবির কাছ থেকে ছাড় হয়ে রিজার্ভে যুক্ত হবে।
চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছরের বাজেটের আকার ৭ লাখ ৯৭ হাজার কোটি টাকা। রাজস্ব আয় ধরা হয়েছে ৫ লাখ ৪১ হাজার কোটি টাকা। বাজেট ঘাটতি ২ লাখ ৫৬ হাজার কোটি টাকা দেখানো হয়েছে। ঘাটতি অর্থায়নে বৈদেশিক ঋণ নেওয়া হবে এক লাখ ২৭ হাজার ২০০ কোটি টাকা। বাজেটের হিসাব অনুযায়ী বাংলাদেশের জিডিপির আকার ৪৬৬ বিলিয়ন ডলার।
এডিবি জানিয়েছে, এ ঋণ কর্মসূচীর বিষয়ে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ), বিশ্ব ব্যাংক ও অন্যান্য উন্নয়ন সহযোগীদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে পরামর্শ করা হয়েছে। বাংলাদেশ পৃথিবীর সবচেয়ে কম, জিডিপির মাত্র ৭ দশমিক ৪ শতাংশ রাজস্ব আহরণকারী দেশ।
গত ৪ ডিসেম্বর বাংলাদেশ ব্যাংক যে ‘উইকলি সিলেক্টেড ইকোনমিক ইন্ডিকেটরস’ প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে, তাতে দেখা যায়, আইএমএফের হিসাব পদ্ধতি বিপিএম-৬ (ব্যালেন্স অব পেমেন্ট অ্যান্ড ইন্টারন্যাশনাল ইনভেস্টমেন্ট পজিশন) হিসাবে বাংলাদেশের রিজার্ভ ছিল ১৮ দশমিক ৮৪ বিলিয়ন ডলার। ‘গ্রস’ হিসাবে ছিল ২৪ দশমিক ৮৪ বিলিয়ন ডলার।
রিজার্ভের প্রধান দুই উৎস রপ্তানি আয় ও প্রবাসীদের পাঠানো রেমিটেন্সের ঊর্ধ্বমুখী ধারা অব্যাহত রয়েছে। এ অবস্থায় এডিবির বাজেট সহায়তার ৬০ কোটি ডলার যোগ হলে বিপিএম-৬ হিসাবে রিজার্ভ ২০ বিলিয়ন ডলারে গিয়ে ঠেকবে বলে জানিয়েছেন বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তারা।
এডিবি বাংলাদেশের অন্যতম প্রধান উন্নয়ন সহযোগী। ১৯৭৩ সালে সদস্যপদ লাভ করার পর থেকে এডিবি আর্থিক সহায়তার একটি বড় অংশ বাংলাদেশকে দিয়ে আসছে।
এডিবি এখন পর্যন্ত বাংলাদেশ সরকারকে ৩২ হাজার ৪৯৭ দশমিক ৪৭ মিলিয়ন মার্কিন ডলারের ঋণ সহায়তা ও ৫৭১ দশমিক ২ মিলিয়ন মার্কিন ডলারের অনুদান সহায়তা প্রদান করেছে।
বাংলাদেশে উন্নয়ন সহায়তার ক্ষেত্রে এডিবি সাধারণত বিদ্যুৎ, জ্বালানি, পরিবহন, শিক্ষা, স্থানীয় সরকার, কৃষি, পানি সম্পদ ও সুশাসন সেক্টরকে প্রাধান্য দেয়।