গাজীপুরের টঙ্গীর তুরাগ তীরে বিশ্ব ইজতেমা মাঠ দখলকে কেন্দ্র করে মাওলানা জুবায়েরপন্থি ও সাদপন্থিদের মধ্যে সংঘর্ষে ৪ জন নিহত ও ৫০ জনের বেশি আহত হয়েছেন।
আগামী ৩১ জানুয়ারি থেকে শুরু হওয়ার কথা বিশ্ব ইজতেমার প্রথম পর্ব। এর আগেই মাঠ দখল নিয়ে বুধবার ভোরে তাবলীগ জামাতের দুই পক্ষের সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছে।
রক্তক্ষয়ী এই সংঘর্ষের পর ইজতেমা মাঠের নিয়ন্ত্রণ নিয়েছে সরকার। মাঠে প্রবেশ নিষিদ্ধ করেছে গাজীপুর মেট্রোপলিটন পুলিশ। এছাড়া আশপাশের এলাকায় সভা-সমাবেশ, মিছিলের মতো কর্মসূচি নিষিদ্ধ করেছে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ।
উদ্ভূত পরিস্থিতিতে দুই পক্ষের নেতাদের নিয়ে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে পৃথক বৈঠক করেছেন স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) মো. জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরীসহ কয়েকজন উপদেষ্টা। বৈঠকের পর দুই পক্ষই সংঘর্ষের জন্য একে অন্যকে দোষারোপ করে।
সংঘর্ষের ঘটনায় জড়িতদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার ঘোষণা দিলেও সরকার ইজতেমা আয়োজনের বল ঠেলে দিয়েছে দুই পক্ষের কোর্টে। তাদের আলোচনা করে সমস্যার সমাধান করতে বলেছেন স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা।
তিনি বলেন, “ইজতেমার তারিখ সরকার বাতিল করেনি। তারা আলোচনা করুক।”
ডিএমপির নির্দেশনা
ইজতেমা মাঠের আশেপাশে সব ধরনের সভা, সমাবেশ, মিছিল, শোভাযাত্রা ও বিক্ষোভে নিষিদ্ধ করেছে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ (ডিএমপি)।
ডিএমপির মিডিয়া ও পাবলিক রিলেশন বিভাগ বুধবার এক গণবিজ্ঞপ্তিতে বলেছে, সম্প্রতি উদ্ভূত পরিস্থিতি মোকাবেলায় জনশৃঙ্খলা রক্ষার্থে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ অর্ডিন্যান্স (অর্ডিন্যান্স নং-III/৭৬) এর ২৯ ধারায় অর্পিত ক্ষমতাবলে বুধবার বিকাল ২টা থেকে কামারপাড়া, আব্দুল্লাহপুর, উত্তরা সেক্টর-১০ এবং তৎসংলগ্ন তুরাগ নদীর দক্ষিণ পশ্চিম এলাকায় যেকোনো প্রকার সভা-সমাবেশ, মিছিল, শোভাযাত্রা, বিক্ষোভ ইত্যাদি পরবর্তী নির্দেশ না দেওয়া পর্যন্ত নিষিদ্ধ করা হলো।
মাঠে প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা গাজীপুর পুলিশের
ইজতেমা মাঠে জনসাধারণের প্রবেশ নিষিদ্ধ করে গণবিজ্ঞপ্তি জারি করেছে গাজীপুর মহানগর পুলিশ। বুধবার দুপুর দুইটা থেকেই এটি কার্যকর করা হয়েছে।
গণবিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, পরবর্তী নির্দেশ না দেওয়া পর্যন্ত টঙ্গী বিশ্ব ইজতেমা ময়দানসহ আশেপাশের তিন কিলোমিটার এলাকার মধ্যে দুই বা ততোধিক ব্যক্তি একত্রে ঘোরাফেরা, জমায়েত ও কোনও মিছিল সমাবেশ করতে পারবে না। কোনও অস্ত্র-শস্ত্র, ছুরি, লাঠি, বিস্ফোরক দ্রব্য বা এ জাতীয় কোনও পদার্থ বহন করতে পারবে না। কোনও লাউড স্পিকার বা এ জাতীয় কোনও যন্ত্র দ্বারা উচ্চস্বরে কোনও শব্দ করতে পারবে না। আইন অমান্যকারীদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
সংঘর্ষের জন্য দুঃখ প্রকাশ সাদপন্থিদের
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে প্রথম বৈঠক হয় সাদপন্থিদের সঙ্গে। বৈঠক শেষে সাদপন্থিদের নেতা রেজা আরিফ বলেন, “মাঠে আমাদের বিপুল সংখ্যক সাথী অবস্থান করছিলেন। এমন পরিস্থিতে বিপরীত পক্ষ ওই মাঠে যাওয়ার চেষ্টা করলে দুই পক্ষের একটা সংঘর্ষ হওয়ার সম্ভাবনা দেখা দেয়। আমরা যেহেতু শান্তির পক্ষে, সেহেতু সংঘর্ষ এড়াতে প্রশাসনের অনুরোধে আমরা মাঠ ছেড়ে দিয়েছি।”
জুবায়েরপন্থিদের প্রতি আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন, “সরকারের সিদ্ধান্ত আমরা মেনে নিয়ে মাঠ ছেড়ে দিয়েছি। উনারাও (জুবায়েরপন্থি) যেন দেশের স্বার্থে ইসলামের স্বার্থে কোনোরকম সমস্যার চেষ্টা না করেন। উনারা যেন রাস্তায় নেমে না আসেন, কোনও ধরনের উষ্কানিমূলক বক্তব্য প্রচারের চেষ্টা না করেন।
“মুসলমান মুসলমান মারামারি, তাবলীগের সাথীর সঙ্গে সাথীর মারামারি- এটা একেবারেই ঠিক হয়নি। আমরা এ জন্য দুঃখ প্রকাশ করছি। ভবিষ্যতে এ ধরনের কর্মকাণ্ড যেন না হয়, সে বিষয়ে যাবতীয় চেষ্টা আমাদের থাকবে।”
সাদপন্থিদের নিষিদ্ধ করার দাবি জুবায়েরপন্থিদের
সাদপন্থিদের সন্ত্রাসী বলে মন্তব্য করে বাংলাদেশে তাদের নিষিদ্ধের দাবি জানিয়েছেন জুবায়েরপন্থি মাওলানা ও বাংলাদেশ খেলাফত মজলিসের মহাসচিব মো. মামুনুল হক।
স্বরাষ্ট্রসহ সাত উপদেষ্টার সঙ্গে বৈঠক শেষে সাংবাদিকদের ব্রিফিংয়ে হেফাজতে ইসলামের সাবেক এই যুগ্ম মহাসচিব বলেন, ইজতেমা মাঠে হামলায় শেষ খবর পাওয়া পর্যন্ত ৪ জন শাহাদাত ও অসংখ্য মানুষ জখম হয়েছে।
মো. মামুনুল হক বলেন, “টঙ্গীর ঘটনাকে অনেকে দুই পক্ষের সংঘর্ষ বলছেন। কিন্তু আসলে তা নয়। বরং এটা ছিল হামলা। রাতের আঁধারে ঘুমন্ত মুসল্লীদের ওপর হামলা চালিয়ে তাদের হতাহত করেছে সাদপন্থিরা। আমাদের নিরীহ ভাইদের খুন করা হয়েছে।
“এই ঘটনার অনেক সিসিটিভি ফুটেজ সামাজিক যোগোযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়েছে। সেসব ভিডিওতে স্পষ্ট কাদের নেতৃত্বে কারা হামলা চালিয়েছে। আমাদের দাবি, এই হত্যাকাণ্ডের জন্য দায়ী প্রত্যেককে গ্রেপ্তার করতে হবে। আজকের মধ্যেই যেন গ্রেপ্তারের সেই ঘটনা দেখতে পাই, আমরা সেই অনুরোধ জানিয়েছি।”
মামুনুল হক বলেন, “সাদপন্থিরা সন্ত্রাসী কায়দায় জোড় করে ইজতেমা মাঠ দখল করেছিল। ইতোমধ্যেই সেই মাঠ তারা ছেড়ে দিয়েছে। উদ্ভূত পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে ইজতেমা মাঠ এলাকায় ১৪৪ ধারা জারি করেছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় তাদের নেওয়া সেই সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নে আমরা সহযোগীতার আশ্বাস দিয়েছি। যারা বাংলাদেশ বিরোধী অপপ্রচারে লিপ্ত, সেই অপশক্তির হয়ে কাজ করছে সাদপন্থিরা। সেই অপশক্তি রোখা শুধু আলেমদের কাজ নয়, এটা রাষ্ট্র ও প্রশাসনেরও কাজ।
“২০১৮ সালেও তারা এভাবে হামলা চালিয়ে ৫ হাজার লোককে আহত করেছিল, সেই সময়ও কয়েকজনকে হত্যা করে তারা। কিন্তু এরপরও রহস্যজনক কারণে তখন তাদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। এবারও তারা একই ঘটনার পুনরার্বৃত্তি করল। এজন্য আমরা সাদপন্থিদের সন্ত্রাসী আখ্যা দিয়ে তাদের নিষিদ্ধের দাবি জানিয়েছি। আশা করি, এ বিষয়েও যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহণ করা হবে।”
বৃহস্পতিবার টঙ্গীর তুরাগ তীর অভিমুখে যে লংমার্চ কর্মসূচি ছিল, তা হবে কি না জানতে চাইলে তিনি বলেন, “কাকরাইলে মুরুব্বি আলেমদের সম্মেলন চলছে। সেখানে গিয়ে আলোচনার পর সিদ্ধান্ত জানানো যাবে।”
যা বললেন স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা
ইজতেমা মাঠে সংঘর্ষে চারজন নিহত হয়েছেন জানিয়ে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা বলেন, “যারা টঙ্গী বিশ্ব ইজতেমার মাঠ নিয়ন্ত্রণকে কেন্দ্র করে হতাহতের ঘটনায় জড়িত, তাদের অবশ্যই আইনের আওতায় আনা হবে। এতে ছাড় দেওয়ার কোনও অবকাশ নেই। খুনিদের কোনও অবস্থায় ছাড় দেওয়ার সুযোগ নাই। যারা প্রকৃত দোষী তাদের আইনের আওতায় আনা হবে।”
দুপুরে তাবলীগ জামাতের দুই গ্রুপের সঙ্গে বৈঠক শেষে উপদেষ্টা আরও বলেন, “কেউ আইনের ঊর্ধ্বে নয়। অন্যায়কারীকে কোনও ছাড় দেওয়া হবে না। সঠিক তদন্ত করে আইনের আওতায় আনা হবে।”
তিনি বলেন, “তাবলীগ জামাতের দুই গ্রুপকে অনমনীয় অবস্থান থেকে সরে এসে ছাড় দিতে হবে। তবেই আমরা একটি সুন্দর ও সুশৃঙ্খল বিশ্ব ইজতেমা উপহার দিতে পারব।”
উপদেষ্টা এসময় বিশ্ব ইজতেমার মাঠে অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনায় নিহতদের আত্মার মাগফেরাত কামনা করেন এবং আহতদের আশু আরোগ্য কামনা করেন।