মিশরে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী শেহবাজ শরিফের সঙ্গে বৈঠক করে একাত্তরের অমীমাংসিত সমস্যাগুলোর সমাধানের আহ্বান জানিয়েছেন প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস।
কায়রোতে ডি-৮ সম্মেলনের ফাঁকে একটি হোটেলে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা বৈঠক করেন বলে বাসস জানিয়েছে।
বৈঠকে ড. ইউনূস বলেন, “বিষয়গুলো বারবার আসছে। আসুন আমরা সামনে এগিয়ে যেতে সেই বিষয়গুলোর ফয়সালা করি।”
জবাবে শরিফকে উদ্ধৃত করে বাসসের প্রতিবেদনে বলা হয়, “১৯৭৪ সালের ত্রিপক্ষীয় চুক্তিতে বাংলাদেশ, পাকিস্তান ও ভারত বিষয়গুলো মীমাংসা করেছে। কিন্তু যদি অন্যান্য অমীমাংসিত সমস্যা থাকে, তবে সেগুলো দেখতে পেলে তিনি খুশি হবেন।”
ভারতীয় উপমহাদেশে ব্রিটিশ শাসনের অবসানের পর ১৯৪৭ সালে পাকিস্তানের ভাগে পড়েছিল বর্তমান বাংলাদেশ, পূর্ব পাকিস্তান নামে।
দীর্ঘ শোষণ-বঞ্চনার পর ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ যখন পাকিস্তানি বাহিনী গণহত্যা শুরু করেছিল, তখন প্রতিরোধ যুদ্ধে নামতে হয়েছিল বাঙালিকে। নয় মাসের যুদ্ধে ৩০ লাখ শহীদের রক্তের বিনিময়ে আসে বাংলাদেশের স্বাধীনতা। সেই যুদ্ধে বাংলাদেশের পাশে ছিল প্রতিবেশী দেশ ভারত।
স্বাধীনতা সংগ্রামে নেতৃত্ব দেওয়া আওয়ামী লীগ গত দেড় দশক বাংলাদেশ শাসনের পর ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে গত আগস্টে উৎখাত হলে ড. ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তী সরকার ক্ষমতায় আসে।
অগাস্টের পর থেকে ভারতের সঙ্গে সম্পর্কে টানাপড়েনের মধ্যে পাকিস্তানের সঙ্গে সম্পর্ক বিনির্মাণের প্রয়াস দৃশ্যমান। এর মধ্যেই কায়রোয় পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠক করলেন ড. ইউনূস।
১৯৭১ সালের ২৫ মার্চের গণহত্যার জন্য পাকিস্তান এখন পর্যন্ত ক্ষমা চায়নি, বাংলাদেশে আটকে পড়া পাকিস্তানিদের ফেরত নেওয়াও হয়নি। অবিভক্ত পাকিস্তানে যুক্ত থাকা অবস্থায় ন্যায্য অর্থনৈতিক হিস্যাও বাংলাদেশ পায়নি। যেসব বিষয় মাঝে-মাঝেই বাংলাদেশে আলোচনায় ওঠে।
ড. ইউনূস পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রীকে বলেন, “ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য বিষয়গুলো চিরতরে সুরাহা করে ফেলা ভালো হবে।”
ব্যবসা-বাণিজ্য বৃদ্ধি এবং ক্রীড়া ও সাংস্কৃতিক প্রতিনিধিদের বিনিময়ের মাধ্যমে দুই দেশের মধ্যে সম্পর্ক জোরদার করতেও দুজন সম্মত হন বলে বাসস জানিয়েছে।
বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান হিসেবে দায়িত্ব নেওয়ার পর ড. ইউনূস বৈদেশিক নীতির মূল বৈশিষ্ট্য হিসাবে সার্কের পুনরুজ্জীবনসহ পারস্পরিক স্বার্থ সম্পর্কিত বিষয় নিয়েও আলোচনা করেন।
প্রয়োজনীয় সংস্কার করে ২০২৬ সালের মধ্যভাগে সাধারণ নির্বাচন আয়োজনের পরিকল্পনাও শেহবাজ শরিফকে জানান প্রধান উপদেষ্টা।
পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ঢাকা ও ইসলামাবাদের মধ্যে কৌশলগত সম্পর্ক গড়ে তোলার আহ্বান জানিয়ে বলেন, “আমরা সত্যিই আমাদের ভ্রাতৃপ্রতীম বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্ক জোরদার করার অপেক্ষায় রয়েছি।”
সার্ক পুনরুজ্জীবনে প্রচেষ্টার জন্য ড. ইউনূসকে স্বাগত জানান এবং আঞ্চলিক সংস্থার শীর্ষ সম্মেলন আয়োজনের সম্ভাবনা নিয়ে কাজ করার জন্য বাংলাদেশকে ধন্যবাদ জানান।
ড. ইউনূস বলেন, “আমি সার্কের ধারণার একজন বড় অনুরাগী। আমি ইস্যুটি নিয়ে কথা বলেই যাব। আমি সার্ক নেতাদের শীর্ষ সম্মেলন চাই। যদি তা কেবল একটি ফটো সেশনের জন্যও হয়, তবুও এটি একটি শক্তিশালী বার্তা বহন করবে।”
পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী বাংলাদেশের রাষ্ট্র পরিচালিত চিনিকলগুলোকে আরও ভালোভাবে পরিচালনার জন্য প্রযুক্তিগত সহায়তার প্রস্তাব দেন।
ডেঙ্গু মোকাবেলায় পাকিস্তানের অভিজ্ঞতা থেকে বাংলাদেশ উপকৃত হতে পারে বলেও মন্তব্য করেন তিনি।
শেহবাজ বলেন, “প্রায় এক দশক আগে পাঞ্জাবে ডেঙ্গুর বিরুদ্ধে আমাদের লড়াই বিশ্বমানের বলে প্রশংসিত হয়েছিল। বাংলাদেশি কর্মকর্তাদের সঙ্গে আমাদের অভিজ্ঞতা শেয়ার করার জন্য আমরা বাংলাদেশে প্রতিনিধি দল পাঠাতে পারি।”
বৈঠকে পাকিস্তানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ইসহাক দার, বাংলাদেশের প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ দূত লুৎফে সিদ্দিকী উপস্থিত ছিলেন। লুৎফে সিদ্দিকী পাকিস্তানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ইসহাক দারকে ফেব্রুয়ারিতে মালয়েশিয়া যাওয়ার পথে বাংলাদেশ সফরের আমন্ত্রণ জানান।
পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী শরিফও ড. ইউনূসকে তার সুবিধামত সময়ে পাকিস্তান সফরের আমন্ত্রণ জানান।