ভারতের মসজিদ-মন্দির কেন্দ্রিক বিতর্ক নিয়ে এবার মুখ খুললেন হিন্দুত্ববাদী সংগঠন রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘের (আরএসএস) প্রধান মোহন ভাগবত।
অযোধ্যার বাবরি মিসজিদ ও রাম মন্দিরের মতো বিতর্ক একেবারেই গ্রহণযোগ্য নয় বলে মন্তব্য করেছেন তিনি। কিছু হিন্দু নেতা দেশের বিভিন্ন প্রান্তে এসব বিতর্ক তুলে ধরার চেষ্টা করছেন বলেও তিনি জানান।
বৃহস্পতিবার পুণেতে ‘বিশ্বগুরু ভারত’ শীর্ষক এক অনুষ্ঠানে গিয়ে উঠতি হিন্দু নেতাদের ঘৃণা ছড়ানো বন্ধ করা নিয়ে একপ্রকার হুঁশিয়ারিই দিলেন আরএসএস প্রধান।
রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘ প্রধানের বক্তব্য, “অযোধ্যায় রাম মন্দির নির্মাণের পর অনেকেই ভাবতে শুরু করেছেন তারা এই ধরনের বিবাদ তৈরি করে নিজে হিন্দু নেতা হিসেবে প্রতিষ্ঠা পাবেন। কিন্তু এটা একেবারেই গ্রহণযোগ্য নয়।”
২০২৪ সালের জানুয়ারিতে অযোধ্যার ঐতিহাসিক বাবরি মসজিদের জায়গায় রাম মন্দির উদ্বোধনের পর থেকেই ভারতজুড়ে এক নতুন ট্রেন্ড শুরু হয়। দেশটির নানা প্রান্তে বিভিন্ন মসজিদের ভৌতি জরিপের দাবি তুলে আদালতের দ্বারস্থ হতে থাকে ছোট-বড় নানা হিন্দুত্ববাদী সংগঠন, কিংবা কোনও হিন্দু নেতা বা ব্যক্তি।
উদ্দেশ্য একটাই— সেই মসজিদের স্থানে কোনও যুগে কোনও মন্দির ছিল কিনা, সেটা যাচাই করে দেখা! এর জেরে সম্প্রতি দেশটির নানা প্রান্তে অশান্তি, সাম্প্রদায়িক সহিংসতা পর্যন্ত ছড়িয়েছে।
সর্বশেষ উদাহরণ, উত্তর প্রদেশের সাম্ভাল জেলার চান্দৌসি শহরের শাহী জামে মসজিদ নিয়ে সংঘর্ষ। এরপর রাজস্থানের আজমীর শরিফ তথা খাজা মঈনুদ্দিন চিশতীর দরগাহ নিয়েও শিব মন্দির বিতর্ক তুলেছে হিন্দু সেনা নামের একটি সংগঠন।
তাই বিষয়টি নিয়ে এবার মুখ খুললেন আরএসএস প্রধান মোহন ভাগবত। এমন আচরণের প্রতি তীব্র ধিক্কার জানিয়ে বৃহস্পতিবার তিনি বলেন, এই ধরনের ঘটনা একেবারেই ‘গ্রহণযোগ্য নয়’।
উল্লেখ্য, ১৯৯২ সালে বাবরি মসজিদ ধ্বংস এবং এরপর সেখানে রাম মন্দির নির্মাণের পুরো ‘আন্দোলনে’ সবচেয়ে বড় ভূমিকা রেখেছিল সংঘ পরিবার। সেই পরিবারের প্রধান মোহন ভাগবতই এবার বলছেন, রাম মন্দির-বাবরি মসজিদের মতো ইস্যু আর চাই না।
তার ভাষ্যে, “রাম মন্দির সব হিন্দু সমাজের বিশ্বাস ও আস্থার বিষয় ছিল। সব হিন্দুরাই চেয়েছিলেন সেখানে মন্দির নির্মাণ হোক। রাম মন্দির নির্মাণটা তাই জরুরি ছিল। কিন্তু শুধু ঘৃণা আর শত্রুতার বশবর্তী হয়ে অন্য কোনও মসজিদ বা ধর্মীয় জায়গা নিয়ে এই ধরনের ইস্যু তৈরির চেষ্টা করলে সেটাকে সমর্থন করা যাবে না।”
ভারত একটি ধর্মনিরপেক্ষ দেশ মনে করিয়ে মোহন ভাগবত বলেন, “ভারতকে উদাহরণ স্থাপন করতে হবে যে, কীভাবে ভিন্ন বিশ্বাস ও মতাদর্শ একত্রে শান্তিপূর্ণভাবে বসবাস করতে পারে।”
তিনি বলেন, “গোটা বিশ্বকে এই মুহূর্তে বোঝানোর প্রয়োজন রয়েছে, ভারতে সব ধর্মের মধ্যে সদ্ভাব রয়েছে। সম্প্রীতির পরিবেশ রয়েছে। ভারতে সম্প্রীতি বজায় রয়েছে এ কথা দুনিয়াকে বোঝাতে গেলে আমাদের একটি মডেল তৈরি করতে হবে।
“ভারতীয়দের উচিৎ অতীতের ভুলগুলো থেকে শিক্ষা নিয়ে তাদের দেশকে বিশ্বের জন্য একটি আদর্শ হিসাবে গড়ে তোলা। এর মাধ্যমে তারা দেখাতে পারে, বিতর্কিত বিষয়গুলো এড়িয়ে কীভাবে অন্তর্ভুক্তিমূলক সমাজ প্রতিষ্ঠা করা যায়। সমাজে সংঘাত কমানোর সমাধান হলো প্রাচীন সংস্কৃতির দিকে ফিরে যাওয়া।”
ভাগবত ঘোষণা করেন, “উগ্রতা, আক্রমণাত্মক মনোভাব, জোর-জবরদস্তি এবং অন্যের দেবতাকে অপমান করা আমাদের সংস্কৃতি নয়। এখানে কোনও সংখ্যাগরিষ্ঠ বা সংখ্যালঘু নেই। আমরা সবাই এক। প্রত্যেকেরই এই দেশে তাদের উপাসনার পদ্ধতি পালন করার অধিকার থাকা উচিৎ।”
আধিপত্য ও আইন নিয়ে আরএসএস প্রধান বলেন, “প্রত্যেকে যদি নিজেদের ভারতীয় বলে মনে করে তবে কেন ‘আধিপত্য’ প্রয়োগের প্রতিযোগিতা চলছে? দেশের ঐতিহ্য হল প্রত্যেকে স্বাধীনভাবে নিজ নিজ ধর্মাচরণ করতে পারেন। সরল বিশ্বাসে জীবনযাপন করা এবং নিয়ম ও আইন মেনে চলা এই দুটি সমাজের বিশেষ প্রয়োজন।”
বহুত্ববাদে জোর দিয়ে তিনি বলেন, “ভারতই একমাত্র দেশ যেখানে রামকৃষ্ণ মিশনে ক্রিসমাস উৎসব পালন করা হয়। কারণ আমরা হিন্দু।”
তথ্যসূত্র: টাইমস অব ইন্ডিয়া, হিন্দুস্তান টাইমস, এএনআই