Beta
শুক্রবার, ১৭ জানুয়ারি, ২০২৫
Beta
শুক্রবার, ১৭ জানুয়ারি, ২০২৫

মেঘনায় ৭ খুন : আকাশকে যেভাবে খুঁজে পেল র‌্যাব

বাগেরহাটের চিতলমারী থেকে আকাশকে গ্রেপ্তার করে র‌্যাব। ছবি : র‌্যাব
বাগেরহাটের চিতলমারী থেকে আকাশকে গ্রেপ্তার করে র‌্যাব। ছবি : র‌্যাব
[publishpress_authors_box]

জাহাজের মাস্টারের প্রতি ক্ষোভ আর তা থেকে একে একে সাত সহকর্মীকে খুন; চাঁদপুরের হাইমচরের মেঘনা নদীর ইশানবালা খালের মুখে নোঙর করে রাখা নৌযান এমভি আল-বাখেরায় সাত খুনের ঘটনার এই বিবরণই দিয়েছে র‌্যাব।

বলা হচ্ছে, ওই জাহাজটিরই কর্মী আকাশ মণ্ডল ওরফে ইরফান তার সহকর্মীদের খুন করে পালিয়ে গিয়েছিলেন। তবে প্রশ্ন উঠছে, গত দুদিনে জাহাজের মালিক বা পুলিশের বক্তব্যে কোথাও কেন আকাশের প্রসঙ্গ আসেনি। হঠাৎ করেই দুদিন পর কেন জানা গেল, আকাশ নামে আরও একজন ছিল জাহাজে। যে কিনা সাত জনকে খুন করে বাগেরহাটে পালিয়ে গিয়েছিল।

এসব প্রশ্নের উত্তর দিয়েছে র‌্যাব।

বুধবার সন্ধ্যায় র‌্যাব সকাল সন্ধ্যাকে র‍্যাব-১১ এর উপ-অধিনায়ক মেজর মোহাম্মদ সাকিব হোসেন সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “লাশ উদ্ধারের পর থেকেই ঘটনার ছায়া তদন্ত শুরু করে র‌্যাব। এক পর্যায়ে আমরা জানতে পারি জাহাজ থেকে সাত জনের মৃতদেহ ও এক জনকে আহতাবস্থায় উদ্ধার করা হলেও সেই জাহাজে ছিলেন ৯ জন।

“পরে র‌্যাব তথ্য-প্রযুক্তির সাহায্যে আকাশ মণ্ডলের কথা জানতে পারে। পরে তার অবস্থান নিশ্চিত হয়ে অভিযান চালিয়ে তাকে গ্রেপ্তার করেছি।”

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এই ধরনের জাহাজে সাধারণত দেখাশোনার মূল দায়িত্বে থাকেন মাস্টার। মালিক মাস্টারের সঙ্গে যোগাযোগ করেন। কতজন কর্মী কাজ করছে বা কারা কারা কাজ করছে তা পুরোপুরি মাস্টারের নিয়ন্ত্রণে থাকে। সে কারণেই গত কয়েকদিনে জাহাজের মালিকের যে বক্তব্য এসেছে সেখানে আকাশ মণ্ডলের বা পলাতক আরেক কর্মীর কোনও প্রসঙ্গ ছিল না।

অন্যদিকে পুলিশ আগেই আকাশের কথা জানতে পেরেছিল, বললেন চাঁদপুরের নৌ পুলিশ সুপার সৈয়দ মুশফিকুর রহমান।

তিনি সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “আমরা আহত জুয়েল খালাশির কাছ থেকে আগেই জাহাজে আরেকজনের উপস্থিতির বিষয়ে খবর পেয়েছিলাম। এরপর থেকেই সে আমাদের টার্গেটে ছিল। কিন্তু ময়নাতদন্ত শেষে লাশগুলো স্বজনদের কাছে হস্তান্তরসহ অন্য আনুষাঙ্গিক কাজে ব্যস্ত থাকায় তাকে ধরতে যাওয়া সম্ভব হয়নি।”

গ্রেপ্তার আকাশ মণ্ডল ওরফে ইরফানকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে হাইমচর থানায় জাহাজের মালিক মাহবুব মোর্শেদের করা মামলায়।

র‌্যাবের দাবি, নানা কারণে জাহাজের মাস্টার কিবরিয়ার প্রতি ক্ষোভ জন্মেছিল আকাশের। তাকে উচিত শিক্ষা দিতেই খুনের পরিকল্পনা করেন। কেউ যেন জেনে না যায় সেজন্য সবার খাবারেই মেশান ঘুমের ওষুধ, যা তিনি কয়েকদিন আগেই জোগাড় করে রেখেছিলেন।

আকাশ মণ্ডলের বাড়ি বাগেরহাট জেলার ফকিরহাট উপজেলায়। ২৬ বছরের এই তরুণ গত আট মাস ধরে এমভি আল বাখেরা জাহাজে চাকরি করছিলেন।

মাহবুব মোর্শেদ নামে এক ব্যক্তির মালিকানাধীন জাহাজটি চট্টগ্রাম বন্দর থেকে ৭২০ টন ইউরিয়া সার নিয়ে গত রবিবার সিরাজগঞ্জের বাঘাবাড়ি রওনা হয়েছিল। হঠাৎ জাহাজের কর্মীদের সঙ্গে মালিকের যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে গেলে তিনি অন্য জাহাজের কর্মীদের সেটিতে খোঁজ নিতে বলেন।

সোমবার রাতে চাঁদপুরে মেঘনা নদীতে নোঙর করে রাখা অবস্থায় জাহাজটি পায় অন্য একটি জাহাজের কর্মীরা। সেখানে রক্ত মাখা লাশ দেখে তারা পুলিশে খবর দেয়। পুলিশ গিয়ে পাঁচজনের লাশ উদ্ধার করে। গুরুতর আহত তিনজনকে হাসপাতালে নেওয়ার পথে আরও দুজনের মৃত্যু ঘটে। আকাশকে জাহাজে পাওয়া যায়নি।

নিহতরা হলেন-জাহাজের মাস্টার কিবরিয়া (৫৬), ইঞ্জিনচালক সালাউদ্দিন মিয়া (৪১), সুকানি আমিনুর মুন্সি (৪২), গ্রিজার সজিবুল ইসলাম (২৯), মাজেদুল ইসলাম মজিব (১৬) ও শেখ সবুজ (২৭) এবং বাবুর্চি রানা।

আহতের নাম জুয়েল, তিনি ছিলেন জাহাজের সুকানি।

চাঁদপুরের নৌ পুলিশ সুপার সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “আমরা আহত জুয়েলের কাছ থেকে আগেই জাহাজে আরেকজনের উপস্থিতির বিষয়ে খবর পেয়েছিলাম। কিন্তু পুলিশ শুরুতেই তার পেছনে ছোটাছুটি না করে মানবিক কাজগুলো আগে সেরেছে।

“এই ঘটনায় দায়ের করা মামলাটি তদন্ত আমরাই করছি। আকাশ মণ্ডলকে গ্রেপ্তারে পর পুলিশের কাছে হস্তান্তর করেছে র‌্যাব। পরে তাকে আদালতে হাজির করা হলে আদলত তার ৭ দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেছে।”

বাগেরহাটের চিতলমারী থেকে আকাশকে গ্রেপ্তার করে আনার পর বুধবার ঢাকায় সংবাদ সম্মেলন করে ঘটনার বিস্তারিত তুলে ধরে র‌্যাব। সেখানেই জানা যায়, আকাশ কীভাবে পরিকল্পনা করে খুনগুলো করেছে। আকাশের কাছ থেকে নিহতদের ব্যবহৃত পাঁচটি মোবাইল ফোন এবং রক্তমাখা একটি জিন্সের প্যান্ট উদ্ধার করেছে র‌্যাব।

আকাশকে প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে পাওয়া তথ্যের ভিত্তিতে এই হত্যাকাণ্ডের কারণ এবং কীভাবে খুন করা হলো, তার বিবরণ দিয়েছে র‌্যাব।

অপরাধ বিশেষজ্ঞরা কী বলছেন

আকাশের মতো একজন সাধারণ মানুষের পক্ষে সাত সহকর্মীকে খুনের পর স্বাভাবিক জীবনযাপন সম্ভব কিনা, সে প্রশ্ন উঠছে এখন অনেকের মনে।

এই প্রশ্নের উত্তর জানতে সকাল সন্ধ্যা কথা বলেছে মাওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্রিমিনোলজি অ্যান্ড পুলিশ সায়েন্সেস বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ উমর ফারুকের সঙ্গে।

তিনি বলেন, প্রচণ্ড ক্ষোভ ও প্রতিহিংসা থেকে একজন মানুষ এমন নৃশংস হত্যাকাণ্ড ঘটাতে পারে। তবে যে ঘটনায় সে কখনোই মানসিকভাবে সুস্থ নয়।

উমর ফারুক বলেন, “যখন একজন মানুষ দীর্ঘদিন ধরে নির্যাতন নিপীড়নের শিকার হয় তখন তার মধ্যে একধরনের ক্ষোভ তৈরি হয়। তবে ক্ষোভ থাকলেই আকাশের মতো এমন কাণ্ড সবাই ঘটায় না। যাদের মনে প্রতিহিংসা অনেক বেশি থাকে তারা এমন নৃশংস হয়ে উঠতে পারে। এটা এক ধরনের মানসিক ব্যাধি।”

প্রতিহিংসা থেকে একজন নির্যাতিত মানুষ নির্যাতকের ওপর চরম প্রতিশোধ নিতে চায় জানিয়ে তিনি বলেন, “এর মাধ্যমে তিনি নিজেকে যন্ত্রণা থেকে মুক্তি দিতে চান। প্রতিশোধকে নিজের সাফল্য বলে মনে করেন প্রতিহিংসাপরায়ন মানুষেরা।”

আরও পড়ুন

সর্বশেষ

সর্বাধিক পঠিত