Beta
বৃহস্পতিবার, ৯ জানুয়ারি, ২০২৫
Beta
বৃহস্পতিবার, ৯ জানুয়ারি, ২০২৫

সবজির দাম কমায় শহরবাসী খুশি, গ্রামের কৃষক টিকবে কীভাবে

কৃষকের ক্ষেতে ফুলকপি আছে, সেই সঙ্গে আছে দাম না পাওয়ার হতাশা।
কৃষকের ক্ষেতে ফুলকপি আছে, সেই সঙ্গে আছে দাম না পাওয়ার হতাশা।
[publishpress_authors_box]

ঢাকায় কয়েক সপ্তাহ আগেও প্রতিটি ফুলকপির দাম ছিল ৫০-৬০ টাকা। ভরা শীতে শীতকালীন সবজির এই দাম! মূল্যস্ফীতির এই বাজারে অসন্তোষ ছিল নগরবাসী সবার। দাম পড়েছে, ২০-৩০ টাকাতেই মিলছে এখন বড়সড় ফুলকপি। তাতে সবজির বাজার থেকে খুশি মনে ফিরছে নগরবাসী।

কিন্তু যেখান থেকে এই ফুলকপি আসছে, সেখানে খবর কী? ফেইসবুকে ‘কৃষকের প্রাণ কৃষি পরিবার’ নামে একটি গ্রুপে তার খানিকটা আঁচ পাওয়া যায়। সাড়ে ৩ লাখের বেশি সদস্য যুক্ত রয়েছে এই গ্রুপে। নিজেদের ফসল চাষ, বাজার নিয়ে নানা তথ্য তারা বিনিময় করেন সেখানে।

এই গ্রুপটি ডিসেম্বরের শেষ দিকে ভারী হয়ে উঠেছিল ফুলকপিচাষিদের হাহাকারে। ২ টাকায় চারা কিনে সার, পানি, কীটনাশক দিয়ে কয়েক মাসের পরিচর্যার পর যখন সেই ফুলকপিই ২টা দরে বিক্রি করতে হয়, তখন হাহাকার ছাড়া কৃষকের আর কীইবা করার থাকে।

নওগাঁ থেকে একজন ৩০ ডিসেম্বর সেই গ্রুপে লিখেছিলেন- “১২৩ পিস ফুলকপি গরুকে খাওয়াতে কিনে আনলাম হাট থেকে, ১৪০ টাকা দিয়ে।”

সেই হাহাকার এখনও থামেনি। ৮ জানুয়ারিও একজন নেত্রকোণার একজন মাঠে থাকা ফুলকপি নিয়ে বিপদে পড়ার কথা জানিয়েছেন এই গ্রুপে। তিনি লিখেছেন- “২ হাজার ফুলকপি নিয়ে আটকে আছি, কী করব, বুঝতে পারছি না। বিক্রি করে দেব? অনেক টাকা লস হয়ে যাবে। কী করা যায়?”

তার সমস্যার চটজলদি সমাধান কেউ দিতে পারেনি। তারমধ্যে আরেকজন ধনিয়া পাতা নিয়ে সমস্যার কথা জানিয়ে লিখেছেন- “আমি শেষ পর্যন্ত ৩ টাকা কেজি দরে বিক্রি করতে পারছি, আলহামদুলিল্লাহ। ভাবতেছি আর হাটে নিব না। পাড়া-প্রতিবেশী যা খাওয়ার খাইলো, বাকিটা গরু-ছাগলকে দিয়ে দিব।”

সবজির এমন দাম দেখে সেই গ্রুপে একজন হিসাব দিয়ে লিখেছেন- “শিমের কেজি এখন ১০/১২ টাকা। মানে ৪০০-৪৮০ টাকা মণ। এখন তাদের মন ভরছে? যখন ১০০ টাকা কেজি বা ৪০০০ টাকায় মণ বিক্রি করেছি, তখন তাদের মাথায় যেন গাছ ভেঙে পড়ছিল!

“আরে ভাই, আমার ৩ একর জায়গায় শিম চাষ। যখন দাম ছিল তখন ৮/১০ দিন পর পর ১০/১৫ মণ তুলতে পারতাম। আর এখন ১০ টাকা কেজি, এখন উঠে ১০০/১৪০ মণ। অথচ ১ মণ শিম তুলতে খরচ ৩০০ টাকা ভাবা যায়! সার, বিষ (কীটনাশক) এসব খরচ ধরলে অনেক লস। আর সার, বিষের কথা কী বলব? সার পাওয়াটা এখন অনেক কষ্টসাধ্য। যদিও পাওয়া যায়, তাহলে ১৪০০ টাকা সারের বস্তা ১৮০০/২০০০ টাকা।”

ফেইসবুকে তো অনেকেই লিখছেন, মাঠের কৃষতের সঙ্গে সরাসরি কথা বলেও চিত্রের কোনও ভিন্নতা পাওয়া যায়নি।

গাইবান্ধার কৃষক সুরত মিয়া। এবার নিজের মাঠের ফুলকপি নিজের মাঠেই নষ্ট করেছেন। কারণ, ফুলকপির দাম নেই। মাঠ থেকে ফুলকপি ২ টাকা কেজি দরেও বিক্রি করতে পারেননি বলে জানান তিনি।

সুরত আলী সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “অনেক ট্যাকা খরচ হইছে। কিন্তু বিক্রি করা যায় নাই। এখন এটা রাইখ্যা কী করুম। এর লাইগ্যা মাঠ খালি করলাম। অন্য কিছু আবাদ করুম। কীটনাশক, সার, বীজ সব কিছুর অনেক দাম। বিক্রি করার সময় দাম পাই না।”

এক বিঘা জমিতে ফুলকপি চাষ করেছিলেন সুরত মিয়া। খরচ হয়েছিল ১৭-১৮ হাজার টাকা। কিন্তু এখন সব বিক্রি করে ৫ হাজার টাকাও পাননি।

সুরত মিয়া ফুলকপি ২ টাকা কেজি দরে বিক্রি করলেও ঢাকায় এসে তার দাম এখনও ২০ টাকার বেশি। অর্থাৎ হাত বদলে মাঝে দাম বেড়েছে ১৮ টাকা।

একই অবস্থা অন্য সব সবজিরও। নীলফামারীতে ১৫-২০ টাকা দরে প্রতি কেজি বেগুন কৃষকের কাছে থেকে কিনছেন পাইকারি ব্যবসায়ীরা। সেই বেগুনই ঢাকায় বিক্রি হচ্ছে ৫০-৬০ টাকায়।

নগরবাসী সবজি বেশি দামে কিনলেও সেই টাকা যে উৎপাদনকারী কৃষকের হাতে যায় না, তা নিয়ে ফেইসবুকে একজন লিখেছেন- “৩০ টাকা দিয়ে দুটি সুন্দর ফুলকপি নিয়ে খুশি মনে বাসায় আসলাম। খুশিটা বেশিক্ষণ স্থায়ী হলো না, যখন নিউজ দেখলাম উত্তরবঙ্গে কৃষকের ফুলকপি বিক্রি হচ্ছে ১ টাকা পিস। মার্কসীয় তত্ত্বানুসারে একে বলে উৎপাদন নৈরাজ্য।”

হাতবদলে পণ্যের দাম বাড়ে, তা অর্থনীতিতে স্বীকৃত। কিন্তু কতটা? আর উৎপাদনকারী কৃষক কি এতটাই কম পাবে যে তাকে গুণতে হবে লোকসান?

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) তথ্য অনুযায়ী, দেশে কৃষক পরিবারের সংখ্যা ১ কোটি ৬৫ লাখ। এর প্রায় ৮৪ শতাংশ প্রান্তিক, ক্ষুদ্র ও মাঝারি কৃষক। এই অসংগঠিত কৃষক তার উৎপাদিত পণ্যের নায্য দাম কীভাবে পাবে? তা আলোচনা অনেক দিনের, কিন্তু সমাধানের কোনও পথ দেখা যাচ্ছে না।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, পৃথিবীর কৃষিপ্রধান দেশগুলোর কৃষকদের বিভিন্ন অর্থনৈতিক নিরাপত্তা স্কিম আছে। কিন্তু বাংলাদেশে কৃষকদের জন্য এখন পর্যন্ত তেমন কোনও স্কিম নেই।

আর বর্তমান বাজার ব্যবস্থায় মধ্যস্বত্বভোগীরা লাভ হাতিয়ে নেয়, কৃষকের মাথায় হাত পড়ে। অন্যদিকে ভোক্তাকেও গুণতে হয় বাড়তি অর্থ।

কৃষি প্রশাসনের কর্মকর্তারাও কৃষকদের বেকায়দার বিষয়টি স্বীকার করে নিচ্ছেন। সবজির জন্য হিমাগার, প্রক্রিয়াজাতকরণ ইউনিট গড়ে তোলার কথা বলছেন তারা।

সরকারের বিভিন্ন সংস্থা রয়েছে মাঠ পর্যায়ে এসব কাজ করার জন্য। কিন্তু তাদের কার্যক্রম নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করছেন কৃষক এবং কৃষি বিশেষজ্ঞরা।

বাজার নিয়ে নেই কোনও পরিকল্পনা

হাতবদলে যে কোনও পণ্যের দাম বাড়াটা স্বাভাবিক। কিন্তু হাতবদলের বিভিন্ন পর্যায়ে দামের ওপর নিয়ন্ত্রণের কোনও সরকারি উদ্যোগ না থাকার বিষয়টি দেখালেন কৃষি অর্থনীতিবিদ ড. মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর আলম।

তিনি সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “উৎপাদন মৌসুমে দাম কমে যাওয়া একটা স্বাভাবিক ঘটনা। উৎপাদন মৌসুম যখন না, তখন দামটা বেশি থাকে। এই সমস্যাটা খুব আদিকাল থেকেই কৃষি পণ্যের জন্য প্রযোজ্য।

“কিন্তু দাম প্রত্যেক পর্যায়ে কী রকম হবে, তা নির্ধারণের জন্য প্রতিষ্ঠান আছে। কিন্তু তাদের থেকে কখনও কোনও দৃশ্যমান উদ্যোগ দেখা যায়নি।”

প্রতিযোগিতামূলক মূল্যে সাধারণ মানুষের পণ্য ও সেবা প্রাপ্তি নিশ্চিত করতে বাংলাদেশে রয়েছে প্রতিযোগিতা কমিশন। কিন্তু সেই প্রতিযোগিতা কমিশনের কোনও পরিকল্পনা নেই এই বিষয়ে। বাজার পরিদর্শন পর্যন্তই থেমে আছে কমিশনের কাজ।

গত ৫ আগস্ট সরকার পতনের পর প্রতিযোগিতা কমিশনের সব পরিচালক একযোগে পদত্যাগ করেন। তারপর থেকে এই কমিশনের কাজ থমকে আছে। গত সোমবার অবশ্য কমিশনে নতুন চেয়ারপারসন হিসাবে নিয়োগ দেওয়া হয় এ এইচ এম আহসানকে। তার সঙ্গে কথা বলার চেষ্টা চালিয়েও সফল হয়নি সকাল সন্ধ্যা।

তবে কৃষি বিপণন অধিদপ্তরের মহাপরিচালক মাসুদ করিম সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “হাতবদলে দাম বাড়ার প্রবণতা কীভাবে কমিয়ে আনা যায়, তা নিয়ে আমরা কাজ করছি। বেশ কিছু পদক্ষেপ আমরা নিয়েছি। ভবিষ্যতে এসব পদক্ষেপ চলমান থাকলে আপনারা এর রেজাল্ট দেখতে পারবেন।”

কাজটি চ্যালেঞ্জের মন্তব্য করে তিনি বলেন, “হাতবদলে কিছু প্রফিট হবে। কিন্তু সেই প্রফিট যেন আননেচারাল প্রফিট না হয়। তা যেন নেচারাল হয়, সেদিকে ইন্টারভেনশনের চেষ্টা আমরা করছি।”

এজন্য দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনার ওপর জোর দিয়ে মাসুদ বলেন, “এখানে শর্ট টাইমে কিছু হবে না। দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা ছাড়া এই সমস্যা মেটানো যাবে না। শর্ট টাইমে কিছু কাজ সাময়িক আরাম দেবে, কিন্তু তা পরিস্থিতি খুব একটা স্বাভাবিক করবে না।”

চাই বিনিয়োগ

বাংলাদেশে আলুর জন্য রয়েছে ৩৬৬টি সরকারি-বেসরকারি হিমাগার। কিন্তু সবজির জন্য কোনও বিশেষায়িত হিমাগার নেই। তাই পচনশীল কৃষিপণ্য বিক্রি করে দিতে বাধ্য হন কৃষকরা। এই সমস্যা সমাধানে জোর দিচ্ছেন ড. জাহাঙ্গীর আলম খান।

তিনি বলেন, প্রান্তিক পর্যায়ে যেন দাম বেশি না পড়ে যায়, সেজন্য দুটি কাজ করার কথা বলা হয়। কিছুদিনের জন্য কিছু পণ্য কোল্ড স্টোরেজে রাখা। উৎপাদনের মৌসুমে সেইসব পণ্য ধরে রাখা। তাহলে দামের একটি ভারসাম্য রক্ষা হবে।

“বিভিন্ন পণ্যের জন্য বিভিন্ন মাত্রায় কোল্ড স্টোরেজ দরকার। আলুর জন্য যে কোল্ড স্টোরেজ, সেটাতে পেঁয়াজ রাখা যাবে না। এটা করা খুব দরকার।”

একই পরিকল্পনার কথা বলছেন কৃষি অধিদপ্তরের মহাপরিচালক মাসুদ করিমও।

তিনি বলেন, “আমরা বেশ কিছু দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনার কথা ভাবছি। আমরা কৃষিপণ্যকে প্রসেসিং করার কথা ভাবছি। এর জন্য কুল চেম্বার, কুলিং বা কোল্ড স্টোরেজের বানানোর চিন্তা আমরা করছি। এরজন্য আমাদের আরও অনেক ইনিশিয়েটিভ আছে। আমরা প্রসেসিং এ আরও উদ্যোক্তা তৈরির কাজও করছি।”

“কৃষি খাতে প্রচুর বিনিয়োগ দরকার। সেটা সরকারি হোক কিংবা বেসরকারি হোক। কোল্ড স্টোরেজ সিস্টেম উন্নতি করতে হবে। প্রসেসিং ইন্ড্রাস্টি গড়ে তোলা, এগুলো সবকিছুর জন্য টাকা দরকার। বিনিয়োগ ছাড়া এই পুরো ব্যবস্থা গড়ে তোলা সম্ভব না,” বলেন তিনি।

চাই কৃষকের সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগ

বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা পরিষদের সাবেক পরিচালক জাহাঙ্গীর আলম খানের মতে, শুধু বিনিয়োগ দিয়ে হিমাগার বা প্রসেসিং ইউনিট করলেই হবে না। তার সঙ্গে প্রয়োজন সরকারের কৃষকের সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগ স্থাপন।

তিনি বলেন, “সরাসরি কৃষকের কাছ থেকে পণ্য নিয়ে ভোক্তার কাছে নিয়ে আসা। এজন্য কৃষি বিপণন অধিদপ্তর বলেছিল, তারা সরাসরি ভোক্তাদের জন্য মার্কেট চালু করবে। কিন্তু কোনও উদ্যোগই কিন্তু আলোর মুখ দেখেনি।”

একুশে পদকজয়ী এই কৃষি অর্থনীতিবিদ প্রতিবেশী দেশ ভারতে কৃষকের জন্য বিভিন্ন নিরাপত্তা বলয় তৈরির বিষয়টি তুলে ধরেন।

ভারত ‘মিনিমাম সাপোর্ট প্রাইজ’ নামে একটি স্কিম চালু করেছে, যা কৃষকদের নিজের উৎপাদিত ফসলের নির্দিষ্ট দাম পাওয়ার নিশ্চয়তা দেয়। এছাড়া ‘ফসল বিমা কর্মসূচি’ও রয়েছে সেখানে।

ড. জাহাঙ্গীর বলেন, “ভারতে কিন্তু প্রায় ২৩টি পণ্য সরকার কিনে নেয়। তারা স্টক করে। পরে যখন মৌসুম চলে যায়, তখন তারা বাজারে সেই পণ্য ছাড়ে। তাতে বাজারে সেই পণ্যের দাম তারা নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারে। আমাদের দেশে কিন্তু এরকম কোনও উদ্যোগ নেই।”

কৃষি বিপণন অধিদপ্তরের কাজ নিয়ে প্রশ্ন তুলে বলেন, “ওদের কাজটা কী? শুধু তথ্য দেওয়া? তা তো না। বিপণনে কার্যকরি হস্তক্ষেপ করা। কিন্তু এখনও তাদের এসব করতে দেখা যায়নি। সেই দিকে উদ্যোগ নেওয়া ছাড়া কোনও উপায় নেই।”

আরও পড়ুন

সর্বশেষ

সর্বাধিক পঠিত