ফুটবল ঐতিহ্যে ইউরোপের ফ্রান্স, ক্রোয়েশিয়া, নরওয়ে কিংবা লাতিনের চিলি বা এশিয়ার সৌদি আরবের চেয়ে যোজন যোজন পিছিয়ে বাংলাদেশ। অথচ ফিফার একটি র্যাঙ্কিংয়ে এই দেশগুলোর চেয়ে এগিয়ে বাংলাদেশের মেয়েরা! অবিশ্বাস্য হলেও সত্য যে দেশের মাটিতে কখনও ফুটসাল না খেলে র্যাঙ্কিংয়ে ওই পরাশক্তিদের পেছনে ফেলে দিয়েছে বাংলাদেশ!
গত বছর প্রথমবার মেয়েদের ফুটসালের র্যাঙ্কিং প্রকাশ করে ফিফা। সেই র্যাঙ্কিয়ে বাংলাদেশ ছিল ৪৪ নম্বরে। দক্ষিণ এশিয়ার একমাত্র দেশ হিসেবে ৬৯ দলের র্যাঙ্কিংয়ে জায়গা করে নেয় বাংলাদেশ। সুযোগ হয়নি ভারত, পাকিস্তানসহ সাফের অন্য দেশগুলোর।
শুধু তাই নয়, বাংলাদেশের পেছনে ছিল ফ্রান্স, পেরু, চিলি, স্লোভেনিয়ার মত দলও। ইউরোপের ফুটবল পরাশক্তি ফ্রান্স ৫৬ আর লাতিনের ঐতিহ্যবাহী দল চিলি ছিল ৫৭ নম্বরে।
অথচ বাংলাদেশ ফুটসাল দলই নেই
ফিফার র্যাঙ্কিংয়ে ফ্রান্স, ক্রোয়েশিয়ার চেয়ে এগিয়ে থাকার অর্থ এই নয় যে, বাংলাদেশ নারী দল ফুটসালের পরাশক্তি। বিস্ময়কর হলেও সত্যি, বাংলাদেশের কোন নারী ফুটসাল দল নেই। এদেশে মেয়েরা কখনও ফুটসাল খেলেছে, এমন দৃশ্য কেউ দেখেছে বলে বলতে পারবে না।
তাই প্রশ্ন, যে ফুটসালের চর্চা দেশেই নেই সেই খেলায় কীভাবে বাংলাদেশের নাম ওঠে ফিফা র্যাঙ্কিংয়ে? তা-ও আবার ফ্রান্সের মতো পরাশক্তিদের ওপরে! আর্থিক জালিয়াতি করে নিষিদ্ধ বাফুফের সাবেক সাধারণ সম্পাদক আবু নাঈম সোহাগের পাঠানো ভুয়া কাগজ-পত্র দিয়ে নাম ওঠানো হয়নি তো? না। সেটা হয়নি, ফুটসাল র্যাঙ্কিংয়ের হিসাবটা স্পষ্ট করেছে ফিফা।
ফুটসাল র্যাঙ্কিংয়ের হিসাবটা কীভাবে
আনুষ্ঠানিকভাবে প্রকাশ করা না হলেও বিশ্বজুড়ে ফুটসাল খেলা দলগুলোর রেটিং পয়েন্টের হিসাব করে রাখছিল ফিফা। ছেলে ও মেয়ে- দুই বিভাগেরই র্যাঙ্কিংয়ের হিসাব রাখা হচ্ছিল ২০১৫ সালের ১ আগস্ট থেকে।
কয়েক বছরের পরীক্ষা শেষে ২০২৪ সালে প্রথমবার র্যাঙ্কিং প্রকাশ করে ফিফা। প্রথম দুই বছর, অর্থাৎ ২০১৫ সালের আগস্ট থেকে ২০১৭ সালের জুলাই পর্যন্ত র্যাঙ্কিংয়ের হিসাবটা হতো এমন- যে দল প্রথমবার ফুটসাল খেলছে, ওই দল ১০০০ পয়েন্ট নিয়ে র্যাঙ্কিং শুরু করেছে।
২০১৭ সালের আগস্ট থেকে নতুন দলের র্যাঙ্কিংয়ের মোট পয়েন্টের হিসাব হতো এভাবে- সর্বশেষ র্যাঙ্কিংয়ে যে দলের অবস্থান ছিল তলানিতে, ওই দলের সমান মোট পয়েন্ট নিয়ে র্যাঙ্কিংয়ে পথচলা শুরু হতো নতুন দলের।
২০২৩ সাল থেকে হিসাবটা এমন- আগের বছর সবার নিচে থাকা দলের যত পয়েন্ট থাকত, সেই পরিমাণ পয়েন্ট নিয়ে র্যাঙ্কিংয়ে নাম লেখাত নতুন দল। ২০২৪ সাল থেকে নতুন দলের পয়েন্টের হিসাব হয় সর্বশেষ র্যাঙ্কিংয়ের টেবিল অনুযায়ী।
ফিফার পয়েন্ট বন্টনের সূত্রটা হচ্ছে P = Pbefore + I X (W – We)।
পয়েন্টের হিসাব:
P = ম্যাচ শেষে মোট পয়েন্ট
Pbefore= ম্যাচের আগের মোট পয়েন্ট
I= ম্যাচের গুরুত্ব (প্রীতি ম্যাচ ১৫ পয়েন্ট, মহাদেশীয় ম্যাচ ৪০ পয়েন্ট, বিশ্বকাপ বাছাই ৪০ পয়েন্ট ও বিশ্বকাপ ম্যাচ ৬০ পয়েন্ট)
W= ম্যাচের ফল (জিতলে ১, ড্র করলে ০.৫, হারলে ০)
We= ম্যাচের সম্ভাব্য ফল—- We = 1/{10(-dr/400)+1} (এখানে dr অর্থ হলো, মুখোমুখি দুই দলের মোট পয়েন্টের পার্থক্য)
এই অঙ্কেই বাংলাদেশের পয়েন্ট ৯২০.৩৮
নিজেদের দেশে কস্মিনকালেও বাংলাদেশের মেয়েরা ফুটসাল খেলেনি। সুতরাং এখানে আন্তর্জাতিক ম্যাচ খেলার প্রশ্নই ওঠে না। তবে খেয়ালের বশে ২০১৮ সালে এএফসি ফুটসাল চ্যাম্পিয়নশিপে বাংলাদেশ অংশ নিয়েছিল কোনও পূর্ব প্রস্তুতি ছাড়া। থাইল্যান্ডে অনুষ্ঠিত এ টুর্নামেন্টে নিজেদের গ্রুপে বাংলাদেশ হারে তিনটি ম্যাচই। মালেশিয়ার সঙ্গে ৭-১ গোল, ভিয়েতনামের বিপক্ষে ৭-০ আর চাইনিজ তাইপের কাছে হারে ৬-১ গোলে। ওই টুর্নামেন্টে খেলেছিলেন বর্তমান জাতীয় ফুটবল দলের অধিনায়ক সাবিনা খাতুন, মারিয়া মান্ডা, মাসুরা পারভিন, মনিকা চাকমা, সানজিদা আকতাররা।
সেই প্রথম তাদের ফুটসাল খেলার অভিজ্ঞতা। এরপর ৬ বছর কেটে গেলেও এই খেলার আর কোনও চর্চা হয়নি। ম্যাচও খেলেনি কোথাও। তাই হয়তো ২০২৫ সালে হতে যাওয়া এএফসি এশিয়ান ফুটসালেও নেই বাংলাদেশ। ১৮ দল নিয়ে এর বাছাইপর্ব শুরু হচ্ছে আজ (১১ জানুয়ারি)।
কী খেয়ালে যে বাংলাদেশ ২০১৮ সালে ওই তিনটা ম্যাচ খেলেছিল! সেই তিন ম্যাচ হেরে বাংলাদেশের পয়েন্ট ৯২০.৩৮। বিস্ময়কর হচ্ছে, এরপর কোনও ম্যাচ না খেলেই তারা ৯২০.৩৮ পয়েন্ট নিয়ে ২ ধাপ এগিয়েছে। কারণ অন্যরা ম্যাচ খেলে হেরেছে আর বাংলাদেশ কোনো ম্যাচ না খেলে একই সংগ্রহ ধরে রেখেছে।
যা বলছেন ছোটন-সানজিদারা
২০১৮ সালে এএফসি ফুটসাল চ্যাম্পিয়নশিপে বাংলাদেশের মেয়েদের কোচ ছিলেন গোলাম রব্বানী ছোটন। সেই টুর্নামেন্ট আর বাংলাদেশে মেয়েদের ফুটসাল নিয়ে তিনি সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, ‘‘২০১৮ সালের আগে আমরা কোন ফুটসাল ম্যাচ খেলিনি। এরপরেও খেলিনি। সেবার বাফুফের উদ্যোগে মেয়েরা প্রথম ফুটসাল খেলেছিল থাইল্যান্ডে।”
ওই দলে ছিলেন সানজিদা আক্তার। তার কণ্ঠেও ছোটনের সুর, ‘‘আমরা ২০১৮ সালে ফুটসাল খেলতে যাওয়ার আগে কোনও প্র্যাকটিস ম্যাচ খেলিনি। বলতে গেলে বিনা প্রস্তুতিতে গিয়েছিলাম। তবে যাওয়ার আগে নিজেরা ভাগ হয়ে খেলে প্রস্তুতি নিয়েছিলাম।”
সেই দলের শিউলি আজিম বিয়ে করে এখন সংসারী। সেই খেলার স্মৃতি টেনে তিনি বলেছেন,‘‘আমরা খেলে ফিফার র্যাঙ্কিংয়ে নাম তুলে রেখেছি। এখন বাফুফের অন্তত ফুটসাল খেলা উচিত।’’
বাফুফের ভাবনা
আজ (১১ জানুয়ারি) থেকে শুরু হওয়া এএফসি ফুটসাল চ্যাম্পিয়নশিপের বাছাইপর্বে নাম দিয়েও আর্থিক সংকটে সরে দাঁড়িয়েছে পাকিস্তান। আর বাংলাদেশ সবশেষ আসরে খেললেও বাছাইপর্বে নাম দেয়নি। এর কারণ কী, পাকিস্তানের মতোই আর্থিক?
বাফুফের সাধারণ সম্পাদক ইমরান হোসেন তুষার সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, ‘‘এই টুর্নামেন্টে খেলা বা না খেলার সিদ্ধান্ত অনেক আগের। আমি এসেছি কিছুদিন আগে। এ নিয়ে কিছু জানি না।”
বাস্তবতা হচ্ছে অন্য সব টুর্নামেন্টের মতো এএফসি ফুটসাল চ্যাম্পিয়নশিপের জন্য আছে অংশগ্রহণ ফি, ম্যাচ ফি’সহ প্রাইজমানিও। এজন্যই অস্ট্রেলিয়া, ভারতের মতো দল অংশ নিচ্ছে এবারের বাছাইপর্বে। সেখানে নামই দেয়নি বাংলাদেশ।
বাংলাদেশে বসুন্ধরা আবাসিক এলাকা, ধানমন্ডি, উত্তরাসহ কেবল রাজধানীতে আছে একাধিক ফুটসাল মাঠ। ভাড়ার বিনিময়ে এসব মাঠে ফুটসাল খেলেন তরুণরা। বাফুফে চাইলে কাজে লাগাতে পারে এই মাঠগুলো।
অবশ্য বাফুফে চাইলেও ফুটসালকে আর অবজ্ঞা করতে পারবে না। কারণ ফিফার ওয়েবসাইট ঘেঁটে দেখা গেল ২০২৫ থেকে ২০২৮ পর্যন্ত নতুন ক্যালেন্ডারে সদস্য সব দেশের জন্য ফুটসাল রেখেছে ফিফা। তাহলে বাফুফে এখন কী করবে?
বাফুফের সাধারণ সম্পাদক ইমরান হোসেন তুষার বললেন, ‘‘আমরাও ফুটসালকে গুরুত্ব দিব। পাশাপাশি বিচ ফুটবল নিয়েও পরিকল্পনা আছে আমাদের। আগামীতে এই দুটো খেলায় দেখতে পাবেন বাংলাদেশকে।’’
সেটা হলে অন্তত বিব্রত হতে হবে না। ফিফা র্যাঙ্কিংয়ের মতো মাঠেও থাকবে বাংলাদেশের ফুটসাল।