ময়মনসিংহে গত বুধবার গভীররাতে প্রায় ২০০ বছরের পুরোনো হজরত শাহ সুফী সৈয়দ কালু শাহ (রহ)–এর মাজার ভাঙচুর করা হয়েছে। তার আগে রাত ১১টার দিকে মাজারের কাওয়ালি অনুষ্ঠানেও হামলার ঘটনা ঘটে।
মাজারে এই হামলার ভিডিও ও ছবি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়েছে।
মাজার কর্তৃপক্ষ বলছে, মাজারের পাশে অবস্থিত জামিয়া ফয়জুর রহমান বড় মসজিদ মাদ্রাসার শিক্ষার্থীরা এই হামলা চালিয়েছে। জামিয়া ফয়জুর রহমান বড় মসজিদের প্রধান মুয়াজ্জিন শহীদুল ইসলামও গণমাধ্যমে স্বীকার করেছেন, উচ্চস্বরে গান বাজানোয় ছাত্ররা ক্ষিপ্ত হয়ে মাজারে গিয়ে ভাঙচুর করে।
এরপরও মাজার ভাঙচুরের ঘটনায় গতকাল বৃহস্পতিবার যে মামলা হয়েছে তাতে আসামি করা হয়েছে অজ্ঞাতপরিচয়দের।
পুলিশ বলছে, মাজারটির অর্থ সম্পাদক মো. খলিলুর রহমান চিশতি বাদী হয়ে এই মামলা করেছেন। হামলার সময় ঘটনাস্থলে থাকলেও হামলাকারীদের কাউকে চিনতে না পারায় আসামি হিসেবে কারও নাম উল্লেখ করেননি খলিলুর রহমান।
তবে পুলিশের এই দাবিকে মিথ্যা দাবি করেছেন খলিলুর রহমান।
তিনি বলেছেন, “আমি মামলার বিষয়ে জানি না। পুলিশ আমাকে ডেকে নিয়ে মামলার কাগজে স্বাক্ষর নিয়েছে। একই সঙ্গে বলেছে ঘটনাটি আর না বাড়ানোর জন্য। বিষয়টি প্রশাসন দেখবে। থানা থেকে আজও আমাকে ফোন দিয়ে ডাকা হয়েছিল আরেকটি স্বাক্ষরের জন্য। কিন্তু আমি যাইনি।”
মাজারে সেদিন কী ঘটেছিল
মাজারে হামলার সময় ঘটনাস্থলেই উপস্থিত ছিলেন মাসুদ ভূইয়া চিশতি।
নিজেকে মাজারের অর্থ সম্পাদক মো. খলিলুর রহমান চিশতির মুরিদ দাবি করে সকাল সন্ধ্যাকে তিনি বলেন, “গত বুধবার মাজারের ১৭৯তম বাৎসরিক ওরস উপলক্ষে পাশেই মিলাদ ও গানের অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছিল। এই অনুষ্ঠানের জন্য আমরা জেলা প্রশাসকের অনুমতিও নিয়েছিলাম।
“কিন্তু অনুষ্ঠান শুরুর কিছুক্ষণ পরই রাত সাড়ে ১০টার দিকে হঠাৎ কোতোয়ালী থানার ওসি এসে অনুষ্ঠান বন্ধ করে লোকজনকে দ্রুত সরে যেতে বলেন। এরই মধ্যে বড় মসজিদ মাদ্রাসার শিক্ষার্থীরা এসে ওসির সামনেই হামলা চালায়। তারা অনুষ্ঠানের মঞ্চ, বাদ্যযন্ত্র, দর্শক সারিতে থাকা ২ শতাধিক চেয়ার- সবকিছু ভেঙে ফেলে।”
মাসুদ ভূইয়া চিশতি বলেন, “হামলার খবর পেয়ে কিছুক্ষণ পর ঘটনাস্থলে সেনাবাহিনী আসে। তারা এলে পরিস্থিতি শান্ত হয়। এরপর আমরা মাজার ত্যাগ করে যে যার বাসায় চলে যাই। কিন্তু রাত ৩টার দিকে সরাসরি মাজারে হামলা চালায় বড় মসজিদের শিক্ষার্থীরা।
“তারা রাত ৩টা থেকে ৫টা পর্যন্ত মাজারে ভাঙচুর চালালেও পুলিশ বাধা দেয়নি। অথচ মাজারের উল্টো পাশেই থানার অবস্থান। পুলিশ চাইলেই হামলাকারীদের বাধা দিতে পারত। অথচ পুলিশ বলছে, এত কাছে থেকেও তারা নাকি মাজার হামলার ঘটনা টের পায়নি।”
মাজার কর্তৃপক্ষের যে অভিযোগ
মাজারটির অর্থ সম্পাদক খলিলুর রহমান চিশতি সকাল সন্ধ্যাকে জানান, প্রতিবছর বাৎসরিক ওরস উপলক্ষে মাজারে মিলাদ ও গানের অনুষ্ঠান আয়োজন করা হয়। মাজারের পাশেই বড় মসজিদ মাদ্রাসা। এটাও অনেক প্রাচীন। কিন্তু এর আগে কখনোই এমন হামলার ঘটনা ঘটেনি।
এবার হামলার কারণ জানতে চাইলে তিনি অভিযোগ করে বলেন, বড় মসজিদের ইমাম ও খতিব আবদুল হকের উস্কানিতেই এই হামলার ঘটনা ঘটেছে। দেশের বর্তমান পরিস্থিতির সুযোগ নিয়েছেন আবদুল হক। দেশের বিভিন্ন স্থানে যখন মাজারে হামলা ভাঙচুর হচ্ছে তখন সেই অস্থিরতার সুযোগ নিয়েছেন তিনি।
থানায় মামলার বিষয়ে জানতে চাইলে খলিলুর রহমান চিশতি বলেন, “আমাকে গতকাল (৯ জানুয়ারি) বিকাল ৩টার দিতে থানায় ডাকায়া নিছে ওসি সাহেব। এরপর কী জানি একটা লিখল। সেটাতে আমার সই রাখছে। আমার কাছ থেকে একটা সই রাখছে। সেটা যে কেস (মামলা) আমারে তো কয়নাই। কেস করলে করবে সভাপতি-সেক্রেটারি। আমি করমু কেন?”
তিনি বলেন, “ওসি সাহেব আমার সই রাখছে। আমি তো শুধু দেখছি কি কি ভাংচুর হইছে। তা লেইখ্যা ৫ লক্ষ টাকা বসাইলো। আমারে কইল সাইন দেন। আমি দিছি। আমারে আরেকটা সাইন দেওয়ার জন্য আজকেও ডাকছিল। কিন্তু আমি যাই নাই।
“ওসি সাহেব কারে আসামি করছে, না করছে- আমরা জানি না। তয় আমরা জানি আবদুল হকের উস্কানি ছাড়া এই হামলা হয় নাই।”
মাদ্রাসা কর্তৃপক্ষের বক্তব্য
শাহ সুফী সৈয়দ কালু শাহ (রহ)–এর মাজারে জামিয়া ফয়জুর রহমান বড় মসজিদ মাদ্রাসার শিক্ষার্থীরা হামলা চালিয়েছে বলে গণমাধ্যমের কাছে স্বীকার করেছেন মসজিদের প্রধান মুয়াজ্জিন শহীদুল ইসলাম।
তিনি বলেছেন, “রাতে মাইক বাজিয়ে গানবাজনা করছিলেন মাজারের লোকজন। উচ্চস্বরে গান বাজানোর কারণে ছাত্রদের পড়ায় সমস্যা হয়। এমন অবস্থায় ছাত্ররা গিয়ে গানের সাউন্ড কমাতে বলেন। কিন্তু তা না করে গানের আসর থেকে উস্কানিমূলক কথা বলায় ছাত্ররা ক্ষিপ্ত হয়ে সেখানে গিয়ে ভাঙচুর করে।”
মাদ্রসারা শিক্ষক আবুল হাসান সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “কয়েকদিনের মধ্যেই মাদ্রাসার ছাত্রদের বোর্ড পরীক্ষা শুরু হবে। সেজন্য অনেক ছাত্র পড়াশুনায় ব্যস্ত। এছাড়া রাত গভীর হওয়ায় অনেক ছাত্র ঘুমের প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন। এসময় মাজারের অনুষ্ঠানে উচ্চশব্দে গান বাজানোয় ছাত্রদের পড়াশুনা ও ঘুমের ডিস্টার্ব হচ্ছিল।
“পরে বিষয়টি মাজার কর্তৃপক্ষকে জানানো হয়। কিন্তু উচ্চশব্দে গানবাজনা না থামানোয় ছাত্ররা ক্ষিপ্ত হয়ে অনুষ্ঠানস্থলে হামলা চালায়। পরে আমরা শিক্ষকরা গিয়ে ছাত্রদের শান্ত করে ফিরিয়ে আনি।”
গানের অনুষ্ঠান স্থলের পর মাজারে হামলার কারণ জানতে চাইলে মাদ্রাসার এই শিক্ষক বলেন, “ছাত্রদের আমরা শান্ত করে মাদ্রাসায় ফিরিয়ে আনার পরও মাজারের লোকজন উস্কানিমূলক কথাবার্তা বলছিল। তারা ছাত্রদের দেখে নেবে বলেও হুমকি-ধমকি দেয়।
“এসব কথা ছাত্রদের কানে গেলে ছাত্ররা আবারও ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে। পরে ছাত্রদের সঙ্গে এলাকাবাসীও যোগ দেয়। এরপর সবাই উত্তেজিত হয়ে মাজার ভাঙচুর করে।”
এসব বিষয়ে জানতে বড় মসজিদ মাদ্রাসার সহকারী প্রিন্সিপাল সারওয়ার হোসেনকে কয়েকবার ফোন করা হলেও তিনি সাড়া দেননি।
পুলিশ কী বলছে
মাজার ভাঙচুরের ঘটনায় কোতোয়ালী থানায় একটি মামলা করা হয়েছে বলে জানিয়েছেন ময়মনসিংহের পুলিশ সুপার কাজী আখতার।
সকাল সন্ধ্যাকে তিনি বলেন, মাজারের অর্থ বিষয়ক সম্পাদক খলিলুর রহমান চিশতি বাদী হয়ে এই মামলা দায়ের করেছেন। মামলায় অজ্ঞাতদের আসামি করেছেন তিনি। মামলার বাদী হামলাকারীদের কাউকে চিনতে পারেননি বলে আসামি হিসেবে কারো নাম উল্লেখ করেনি।
খলিলুর রহমান চিশতিকে না জানিয়ে মামলার কাগজে স্বাক্ষর নেওয়ার বিষয়ে জানতে চাইলে পুলিশ সুপার বলেন, “এমনটা তো হওয়ার কথা নয়। মামলা রুজু হয়েছে থানায়। তাই বিষয়টি আমি জানি না। আমি খোঁজ নিয়ে দেখছি।”
মাজারে জামিয়া ফয়জুর রহমান বড় মসজিদের শিক্ষার্থীদের হামলা চালানোর অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, “হামলার ভিডিওতে টুপি পরা মানুষদের আমরা দেখেছি। কিন্তু তারা কোন তরিকার কিংবা প্রতিষ্ঠানের সেটা তো তদন্ত ছাড়া বলতে পারব না। আমরা ঘটনার ছবি-ভিডিও সবকিছু বিশ্লেষণ করছি। জড়িতদের দ্রুতই আইনের আওতায় আনা হবে।”
খলিলুর রহমান চিশতির অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে ময়মনসিংহ কোতোয়ালি মডেল থানার ওসি মো. শফিকুল ইসলাম খান বলেন, “কাউকে জোর করে সই নেওয়া আমাদের কাজ নয়। উনি নিজেই বাদী হয়ে মামলা করেছেন। এখন না চাইলে আইন অনুযায়ী তিনি মামলা প্রত্যাহারও করতে পারেন।”
হামলাকারীদের ছাড় নয়, বলছে সরকার
মাজার, দরগাহ কিংবা গানের অনুষ্ঠানে হামলাকারীদের ছাড় দেওয়া হবে না বলে জানিয়েছেন অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টা মাহফুজ আলম। তিনি বলেছেন, এসব ঘটনায় জড়িত সবাইকে আইনের আওতায় নেবে সরকার। গতকাল বৃহস্পতিবার ঢাকার ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে এসব কথা বলেন তিনি।
এসময় ৫ আগস্টের পর থেকে দেশের বিভিন্ন স্থানে মাজার, গান বা বিভিন্ন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে হামলার কথা উল্লেখ করেন উপদেষ্টা মাহফুজ আলম। এসব হামলার বিষয়ে সুনির্দিষ্ট পদক্ষেপ না নেওয়ায় দুঃখও প্রকাশ করেন।
মাহফুজ বলেন, “এখন থেকে যদি কোনও গানের আসর, সুফী সাধকদের মাজার বা দরবারে হামলা হয় তাহলে সরকার চুপ থাকবে না। আমরা কাউকেই ছাড় দেব না। আমরা কঠোর পদক্ষেপ নেওয়ার ব্যাপারে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।”
বুধবার রাতে ময়মনসিংহের শাহ সুফী সৈয়দ কালু শাহ (রা.)-এর অনুষ্ঠানে হামলাকারীদের গ্রেপ্তারে পুলিশ কাজ করছে জানিয়ে উপদেষ্টা বলেন, “৫ আগস্টের পর থেকে এ ধরনের যত ঘটনা ঘটেছে সেগুলোর তথ্য নিচ্ছি আমরা। যারা ভুক্তভোগী তাদেরকে আমরা বলব আপনারা মামলা করুন। আমরা ব্যবস্থা নেব।”
গণআন্দোলনের মুখে গত ৫ আগস্ট পদত্যাগ করে দেশ ছাড়েন শেখ হাসিনা। তারপর ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে প্রধান উপদেষ্টা করে ৮ আগস্ট শপথ নেয় অন্তর্বতী সরকার। নতুন সরকার শপথ নেওয়ার পর গত কয়েকদিনে দেশের বিভিন্ন জায়গায় বিভিন্ন ধর্মীয় উপাসনালয় ভাঙচুর করা হয়।
৫ আগস্টের পর থেকেই দেশের বিভিন্ন স্থানে শুরু হয় মন্দিরে হামলা। গত ৬ সেপ্টেম্বর নারায়ণগঞ্জের বন্দর উপজেলার মদনপুর এলাকায় একটি মাজারে হামলা-অগ্নিসংযোগ করা হয়।
এরপর ৯ সেপ্টেম্বর সিলেটের হজরত শাহপরান (রহ.)-এর মাজারে হামলা করা হয়।
১২ সেপ্টেম্বর ঢাকার ধামরাইয়ে একটি মাজারে হামলা ও ভাঙচুরের ঘটনা ঘটে।
একইদিনে, সুনামগঞ্জের তাহিরপুর উপজেলার সীমান্তবর্তী লাউড়ের গড় এলাকার শাহ্ আরেফিনের (রহ.)–এর আস্তানায় হামলার আশঙ্কায় গানবাজনা নিষিদ্ধ করা হয়।
এরপর ১৩ সেপ্টেম্বর শরীয়তপুরের জাজিরা ও নড়িয়া উপজেলার দুটি মাজার ভাঙচুর করা হয়। এরমধ্যে একটি মাজারে ভাঙচুরের পর অগ্নিসংযোগ করা হয়।
এর আগে ২৯ আগস্ট সিরাজগঞ্জের কাজিপুর উপজেলায় একটি মাজারে ভাঙচুর করা হয়। তারও আগে গত ২৫ আগস্ট নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁয়ে ভেঙে ফেলা হয় একটি মাজার।