করোনাভাইরাস তো মহামারি ঘটিয়ে আগের দাপট হারিয়েছে, এখন হিউম্যান মেটানিউমোভাইরাস (এইচএমপিভি) ছড়াচ্ছে উদ্বেগ। তার মধ্যে বাংলাদেশে রিওভাইরাস সংক্রমণের খবর দিল আইইডিসিআর।
এই ভাইরাসটিও যে বিশ্বে নতুন, তা নয়। এই আরএনএ ভাইরাস পরিবারের একটি রোটাভাইরাস, যা বাংলাদেশে অচেনা নয়। তীব্র ডায়রিয়ার কারণ এই রোটা ভাইরাস।
রিওভাইরাসেরও কয়েকটি ধরন রয়েছে। রিসপেরিটরি বা শ্বাসতন্ত্রে সংক্রমণ বেশি ঘটায় বলে এর নাম হয়েছে রিওভাইরাস।
রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান-আইইডিসিআরের পরিচালক অধ্যাপক ডা. তাহমিনা শিরীন সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, রিওভাইরাসে এখন পর্যন্ত নয়টি ধরন শনাক্ত হয়েছে বিশ্বে। এর মধ্যে মানুষসহ প্রাণী আক্রান্ত হতে পারে চারটি দিয়ে।
রিওভাইরাসে চারটি ধরন উদ্ভিদ ও কীট পতঙ্গকে আক্রান্ত করতে পারে। বাকি একটি ধরন আক্রান্ত করতে পারে মাছকে।
আবার এই রিওভাইরাসকে ক্যান্সারের চিকিৎসায় কাজে লাগাতে গবেষণা করছে বিজ্ঞানীরা।
নিপা ভাইরাস যেভাবে ছড়ায়, তার সঙ্গে এই রিওভাইরাস সংক্রমণের মিল থাকার কথা জানান ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব ল্যাবরেটরি মেডিসিন অ্যান্ড রেফারেল সেন্টারের ভাইরোলজি বিভাগের প্রধান সহকারী অধ্যাপক ডা. আরিফা আকরাম।
তিনি সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, নিপা ভাইরাসের মতো রিওভাইরাসও বাদুড়ের মাধ্যমে ছড়ায়।
লক্ষণ, প্রতিকার
ডা. আরিফা আকরাম সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, নিপা ভাইরাসে আক্রান্ত হলে যে লক্ষণ-উপসর্গও দেখা যায়, রিওভাইরাসের বেলায়ও তাই।
আ্রকান্ত ব্যক্তির জ্বর, মাথাব্যথা, মাথাঘোরা, খিঁচুনি, বমি, ডায়রিয়া হতে পারে। সেইসঙ্গে আক্রান্ত ব্যক্তি অনেক সময় অজ্ঞান হয়ে যেতে পারে।
“প্রলাপ বকার মতো সেই একই লক্ষণও রিওভাইরাসেও, তবে তখন সেটা আর সাধারণ থাকে না, সিভিয়ার হয়ে যায়,” বলেন ভাইরোলজিস্ট আরিফা।
করোনাভাইরাস ও নিপা ভাইরাসের মতো রিওভাইরাসও ছড়ায় হাঁচি-কাশির মাধ্যমে। আর আক্রান্ত হওয়ার সাত থেকে ১৪ দিনের ভেতরে এর লক্ষণ প্রকাশ পায়।
সাধারণত রিওভাইরাস সংক্রমণে মৃত্যুর আশঙ্কা কম থাকে। তবে নিউমোনিয়া থাকলে কিংবা অন্য কোনও রোগাক্রান্তদের জন্য পরিস্থিতি জটিল হয়ে উঠতে পারে।
অধ্যাপক তাহমিনা শিরীন এর প্রতিকার সম্পর্কে বলেন, “একমাত্র প্রতিকার খেজুরের কাঁচা রস না খাওয়া। আর কোনও প্রতিকার নেই।”
এই শীতে সোশাল মিডিয়ায় খেজুরের রসের উৎসব হচ্ছে। এই ধরনের ইভেন্টের বিষয়ে সতর্ক থাকার বিষয়ে হুঁশিয়ার করলেন ডা. শিরীণ।
“নিরাপদ রস বলে কিছু নেই। আমাদেরকে রস খাওয়া থেকে বিরত থাকতে হবে। কোনোভাবেই এ ধরনের অনুষ্ঠান আমরা প্রোমোট করতে পারি না। বরং আমরা রস না খাওয়ার উৎসব করতে পারি।”
রিওভাইরাস প্রতিরোধে টিকা রয়েছে বলেও জানান ডা. আরিফ। তিনি বলেন, শিশুদের এটা দেওয়া হয়।
বাংলাদেশে রোগী শনাক্ত, তবে পরীক্ষার ব্যবস্থা নেই
আইইডিসিআর পরিচালক অধ্যাপক শিরীন জানান, নিপা ভাইরাসের মতো উপসর্গ রয়েছে, খেজুরের কাঁচা রস খেয়েছে, সঙ্গে এনকেফালাইটিস বা মস্তিষ্কের প্রদাহ রয়েছে এমন রোগীদের পরীক্ষা করে এ ভাইরাসের সংক্রমণ শনাক্ত করা হয়।
২০২৩ সালে এই পাঁচ রোগীকে যখন পরীক্ষা করা হয়েছিল, তখন তারা নিপা ভাইরাসে আক্রান্ত বলে সন্দেহ করা হয়েছিল, কিন্তু পরীক্ষা করে তা মেলেনি।
অধ্যাপক শিরীন বলেন, “নিপা (নিপা ভাইরাস) নেগেটিভ ছিল। তখন তারা অন্য কোনও ভাইরাসে আক্রান্ত কি না, পরীক্ষা করা হলে রিওভাইরাস শনাক্ত হয়। আর এটাই প্রথম বাংলাদেশে। এর আগে রিওভাইরাসে আক্রান্ত কোনও রোগী শনাক্ত হয়নি।”
তারপর গত দুই বছরে আর কোনও রোগী শনাক্ত হয়েছে কি না- জানতে চাইলে তিনি বলেন, “এটা (পরীক্ষা) আমাদের দেশেও হয়নি। যুক্তরাষ্ট্রের কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে আমাদের দুজন চিকিৎসক গিয়েছিলেন। তাদের প্রশিক্ষণের অংশ হিসেবে এটা করা হয়েছিল। আমাদের চিকিৎসকরা স্যাম্পল নিয়ে গিয়েছিলেন সেখানে।”
এই পরীক্ষাটি অনেক ব্যয়বহুল জানিয়ে অধ্যাপক শিরীন বলেন, “আমাদের দেশে এটা করা হয় না।”
আরও গবেষণায় জোর
রোগী শনাক্ত হওয়ার পর দেশে রিওভাইরাস নিয়ে আরও গবেষণার প্রয়োজন বলে মনে করেন আইইডিসিআর পরিচালক তাহমিনা শিরীন।
তিনি বলেন, “বাংলাদেশে অনেকেই মস্তিষ্কের প্রদাহ হয়, যার কারণ আমরা খুঁজে পাই না। কিন্তু এখন তো নিপার সঙ্গে রিওভাইরাসের কথাও জানা হলো। এখন দরকার এ নিয়ে গবেষণা।”
রিওভাইরাসের সংক্রমণ সাধারণত মারাত্মক না হলেও কারও কারও ক্ষেত্রে মারাত্মক হয়ে উঠতে পারে বলে গবেষণায় গুরুত্ব দিচ্ছেন তিনি।
“রিওভাইরাস এমনিতে মারাত্মক নয়। কিন্তু সংক্রমণ যে কোনও সময়ে মারাত্মক হতে পারে। আর সেটা হলে নিউমোনিয়া এমনকি মস্তিষ্কের প্রদাহ বাড়িতে দিতে পারে। তাতে বড় ঝুঁকি তৈরি হয়। আর যে কোনও রোগের মতোই এটা আরও বেশি মারাত্মক হতে পারে শিশু, বয়স্ক এবং দীর্ঘমেয়াদী অন্যান্য জটিল রোগে আক্রান্তদের বেলায়।”
“তাই রিওভাইরাসের কথা যেহেতু এখন জানা গেল, এ নিয়ে আরও কাজ করতে পারি এবং অন্যান্য ভাইরাল ইনফেকশন নিয়েও যদি কাজ করা যায়, জানা যায়, তাহলে এসব রোগীদের চিকিৎসার পথটাও প্রসারিত করবে,” বলেন তাহমিনা শিরীন।