বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে নিরবচ্ছিন্ন সরবরাহের প্রতিশ্রুতি দিয়ে দফায় দফায় গ্যাসের দাম বাড়ানোর কারণে অনেক শিল্পপ্রতিষ্ঠান অস্তিত্ব সংকটে রয়েছে; এ পরিস্থিতিতে এই জ্বালানির মূল্য আড়াইগুণ বাড়ানোর প্রস্তাবকে উৎপাদন খাতের জন্য হুমকি হিসাবে দেখছেন ব্যবসায়ীরা।
গত সোমবার (৬ জানুয়ারি) বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশনের (বিইআরসি) কাছে শিল্প ও ক্যাপটিভের গ্যাসের প্রতি ইউনিটের দাম যথাক্রমে ৩০ ও ৩১ টাকা ৫০ পয়সা থেকে বাড়িয়ে ৭৫ টাকা ৭২ পয়সা করার প্রস্তাব দেয় বাংলাদেশ তেল, গ্যাস ও খনিজ সম্পদ করপোরেশন (পেট্রোবাংলা)।
ব্যবসায়ীরা বলছেন, গ্যাসের দাম বাড়িয়ে দ্বিগুণের বেশি করার প্রস্তাব গৃহীত হলে উৎপাদন ব্যয় বাড়বে; তাতে পণ্যের দাম বেড়ে মূল্যস্ফীতির ওপর চাপ সৃষ্টি করবে। একইসঙ্গে বৈশ্বিক প্রতিযোগিতা সক্ষমতা হারাবে রপ্তানি খাত। স্থানীয় পণ্যের বাজার কমে আসবে, আমদানির প্রবণতা বাড়বে। আমদানি-রপ্তানির এই বিরূপ প্রভাব ডলারের বাজার অস্থির করে তুলবে, যা বিদেশি মুদ্রার রিজার্ভকে চাপে ফেলেবে। তাছাড়া উচ্চ ব্যয়ে উৎপাদন বজায় রাখতে গিয়ে নতুন ও উদীয়মান শিল্পপ্রতিষ্ঠান বড় ধরনের হুমকির মুখে পড়বে। সংকুচিত হয়ে আসবে শিল্প খাতে কর্মসংস্থানের সুযোগও।
এসব বিষয় বিবেচনায় নিয়ে সামগ্রিক অর্থনীতির অগ্রগতির জন্য সরকারের গ্যাসের মূল্যবৃদ্ধির প্রস্তাব পুনর্বিবেচনার প্রয়োজন রয়েছে বলে মনে করছেন ব্যবসায়ীরা।
ঢাকা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি (ডিসিসিআই) সভাপতি তাসকিন আহমেদ শুক্রবার সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “অতীতে কখনোই গ্যাসের দাম একবারে এতটা বাড়ানো হয়নি। এবার যখন গ্যাসের দাম একবারে দ্বিগুণেরও বেশি করার প্রস্তাব আসল, সে বিষয়ে আমাদের ব্যবসায়ী প্রতিনিধিদের সঙ্গে পেট্রোবাংলাসহ সরকারের কোনও পক্ষ আলোচনাও করল না।
“গ্যাসের মূল্যবৃদ্ধির প্রস্তাব অনেকগুলো শঙ্কার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এতে ব্যবসার খরচ কয়েক গুণ বাড়বে।”
জুলাই অভ্যুত্থান পরবর্তী ব্যবসা-বাণিজ্যের স্থবিরতার কথা উল্লেখ করে এই ব্যবসায়ী নেতা বলেন, “বর্তমান পরিস্থিতিতে গ্যাসের মূল্যবৃদ্ধি সামগ্রিক বিনিয়োগ পরিবেশ ক্ষতিগ্রস্ত করবে। নতুন শিল্প স্থাপনের সম্ভাবনা কমাবে এবং বিদ্যমান বিনিয়োগকারীদের ব্যবসা পরিচালনায় বাধা সৃষ্টি করবে।”
গত বৃহস্পতিবার এ নিয়ে আনুষ্ঠানিক এক প্রতিক্রিয়া জানায় ডিসিসিআই। তাতে বলা হয়, রপ্তানিমুখী শিল্পের উৎপাদন খরচ উল্লেখযোগ্যভাবে বেড়ে যাবে, যা আন্তর্জাতিক বাজারে বাংলাদেশের প্রতিযোগিতা সক্ষমতাকে দুর্বল করে তুলবে। স্থানীয় ও বিদেশি বিনিয়োগ কমাবে।
আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে ২০২২ সালে শিল্প খাতের জন্য গ্যাসের দাম ১৫০ থেকে ১৭৮ শতাংশ পর্যন্ত বাড়ানো হয়েছিল। গত বছরও গ্যাসের দাম কিছুটা বাড়ানো হয়।
নতুন করে গ্যাসের দাম বাড়ানোর প্রস্তাবে উদ্বিগ্ন ব্যবসায়ীরা; নিরবচ্ছিন্ন গ্যাস সরবরাহ নিশ্চিত না করেই দাম দ্বিগুণের বেশি বৃদ্ধির প্রস্তাব দেশের শিল্প খাতের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ বলে মনে করে ডিসিসিআই সভাপতি তাকসিন আহমেদ।
বাংলাদেশ স্টিল ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিএসএমএ) পক্ষ থেকেও উদ্বেগ জানানো হয়েছে। সংগঠনটির নেতারা বলছেন, গত সরকারের সময় দফায় দফায় গ্যাসের দাম বাড়ানোর কারণে দেশের ইস্পাত খাতের প্রতিষ্ঠানগুলো এখন অস্তিত্বসংকটের মুখে। এ পরিস্থিতিতে গ্যাসের দাম আড়াইগুণ বাড়ানোর প্রস্তাব কার্যকর হলে ইস্পাতসহ স্থানীয় সব উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান ক্ষতিগ্রস্ত হবে।
বৃহস্পতিবার এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বিএসএমএর সভাপতি মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর আলম বলেন, ইস্পাত খাতের প্রতিষ্ঠানগুলোর উৎপাদন গ্যাসনির্ভর। গ্যাসের দাম বাড়লে রডসহ এমএস পণ্যের মূল্য অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে যাবে। দেশের উদীয়মান ইস্পাত খাতের প্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে যাবে এবং স্থানীয় বাজার আমদানিনির্ভর হয়ে পড়বে। বিদেশি মুদ্রার রিজার্ভের ওপর চাপ বাড়বে।
শিল্পকারখানায় দুই ধরনের গ্যাস-সংযোগ দেয় সরকার। একটির মাধ্যমে কারখানায় বয়লার চালানো হয়। অন্যটি বড় কারখানায় নিজস্ব বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য ক্যাপটিভ সংযোগ।
পেট্রোবাংলার প্রস্তাবে বলা হয়েছে, পুরনো গ্রাহকের ক্ষেত্রে অনুমোদিত লোডের বাড়তি ব্যবহৃত গ্যাসের বিল হবে নতুন দামে। যেসব শিল্পকারখানা নতুন সংযোগের প্রতিশ্রুতি পেয়েছে, তাদের ক্ষেত্রে অনুমোদিত লোডের ৫০ শতাংশ পর্যন্ত আগের দাম দিতে হবে। এর বাইরে বাকিটুকুর জন্য নতুন দাম প্রস্তাব করা হয়েছে।
দেশে দৈনিক চাহিদার ৭৫ শতাংশ মেটানো হয় স্থানীয় গ্যাস দিয়ে এবং বাকি ২৫ শতাংশ মেটে আমদানি করা তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাসে (এলএনজি)।
দিনে ঘাটতি থাকা ১০০ থেকে ১২০ কোটি ঘনফুট সরবরাহ বাড়াতে গ্যাসের উৎপাদন ও এলএনজি আমদানি বাড়াতে বিভিন্ন কর্মপরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে বলে প্রস্তাবে দাবি করেছে পেট্রোবাংলা।
পেট্রোবাংলা দুটি উৎস থেকে গ্যাস সংগ্রহ করে। দেশি গ্যাস কিনে নেয় বিভিন্ন কোম্পানি থেকে। এতে প্রতি ইউনিটে তাদের গড়ে খরচ হয় ৬ টাকা ৭ পয়সা। কিন্তু এলএনজি আমদানিতে খরচ হচ্ছে ৭৫ টাকার বেশি।
এ অবস্থায় সংস্থাটি বলছে, তারা লোকসানে আছে; তবে সরকার আর তাদের ভর্তুকি দিতে রাজি নয়।
এ কারণে পেট্রোবাংলা এলএনজি আমদানির খরচ সবটাই শিল্পের ওপর চাপাতে চাইছে বলে মনে করছেন ব্যবসায়ীরা।
মেট্রোপলিটন চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির (এমসিসিআই) সভাপতি কামরান তানভিরুর রহমান সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “গ্যাসের সংকট চলছে অনেক দিন ধরেই। এখন গ্যাস আমদানিও করতে হচ্ছে। আমরা বুঝতে পারছি গ্যাসের দাম বাড়ানো দরকার। কিন্তু তাই বলে এক বারে দাম বাড়িয়ে দ্বিগুণ, ৩০-৩২ টাকা থেকে ৭০-৭২ টাকা করে ফেলবে প্রতি ইউনিট। এটা খুবই অযৌক্তিক হবে।
“অনেক শিল্পপ্রতিষ্ঠান আছে যেখানে সরাসরি গ্যাসের অনেক ব্যবহার রয়েছে, সেসব প্রতিষ্ঠান একেবারে বসে যাবে। যেসব প্রতিষ্ঠানে গ্যাসের ব্যবহার সরাসরি হয় না, তারাও গ্যাসের দাম বৃদ্ধির কারণে কোনো না কোনোভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে।”
শিল্প খাতে গ্যাসের দাম বৃদ্ধির কারণে কর্মসংস্থানে বড় ধরনের ধস নামবে বলে আশঙ্কা কামরান টি রহমানের।