পাহাড়ি গ্রামের মেঠো রাস্তার পাশে সাদা, গোলাপি ও বেগুনি রঙের ফুলের সমাহার।
শান রাজ্যের এই সৌন্দর্য মিয়ানমারের গৃহযুদ্ধ থেকে কিছুটা মুক্তির অনুভূতি দিতে পারে। মনে হতে পারে যুদ্ধের ডামাডোলেও কোথাও হয়তো কারডাইটের গন্ধ ছাপিয়ে ফুলের গন্ধ পাওয়া যাচ্ছে।
ভুল… এমন ভাবনাটা সত্যিই ভুল। কারণ এসব ফুল দেখে মোহিত না হয়ে একটু খেয়াল করলেই বোঝা যাবে এগুলো আসলে পপি গাছের ফুল। এই গাছই হলো আফিম ও হেরোইন তৈরির কাঁচামাল।
মিয়ানমার আবারও বিশ্বের সবচেয়ে বড় হেরোইন ও অন্যান্য আফিমজাত মাদক তৈরির কাঁচামালের রপ্তানিকারক দেশ হিসেবে শীর্ষে উঠেছে।
চার বছর আগে নির্বাচিত সরকারকে ক্ষমতাচ্যুত করার পর মিয়ানমারে পূর্ণ মাত্রায় গৃহযুদ্ধ শুরু হয়। ঠিক তখন থেকেই দেশটি আন্তর্জাতিক অপরাধের কেন্দ্র হয়ে উঠেছে। সেখানে যুদ্ধবাজ, অস্ত্র ব্যবসায়ী, মানবপাচারকারী, শিকারি, মাদকচক্র এবং আন্তর্জাতিক আদালত কর্তৃক অভিযুক্ত সেনা কর্মকর্তারা সক্রিয়।
গ্লোবাল অর্গানাইজড ক্রাইম ইনডেক্স অনুযায়ী, মিয়ানমার এখন পৃথিবীর সবচেয়ে বড় সংঘবদ্ধ অপরাধের কেন্দ্র।
মিয়ানমারের উর্বর মাটিতে অপরাধের মাত্রা বাড়ায় দেশটির ৫৫ মিলিয়ন মানুষ পড়েছে বিপদে। এছাড়া এই অপরাধের প্রভাব বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে পড়ছে। ২০২১ সালের ফেব্রুয়ারিতে সেনা অভ্যুত্থানের পর, দেশের অর্ধেকেরও বেশি অংশ এখন যুদ্ধবিধ্বস্ত।
মিয়ানমার এখন বিশ্বের সবচেয়ে বড় আফিম উৎপাদক এবং মেথামফেটামিন, কেটামিন ও ফেনটানিলসহ সিনথেটিক মাদক তৈরিতে অন্যতম শীর্ষ দেশ। প্রতিবেশী চীন ও ভারতের কাঁচামাল দিয়ে প্রস্তুত করা ট্যাবলেটগুলো অস্ট্রেলিয়াসহ দূরদূরান্তে ছড়িয়ে পড়ছে। মাদক কারখানাগুলো অত্যধিক উৎপাদন করছে এবং আন্তর্জাতিক আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলো মাদক নিয়ন্ত্রণে অস্থির।
মিয়ানমার শুধু একটি মাদক উৎপাদনকারী রাষ্ট্র নয়। এটি কিছু বিরল খনিজ পদার্থের সবচেয়ে বড় রপ্তানিকারকও। এসব পদার্থ পরিচ্ছন্ন জ্বালানিতে ব্যবহৃত হয়। যুদ্ধবিধ্বস্ত এলাকায় অবৈধ খনি থেকে কর্মীরা বিরল খনিজ উত্তোলন করে এবং সেগুলো চোরাচালান করে চীনে পাঠানো হয়।
দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার এই দেশে পৃথিবীর সেরা জেড পাথর ও রুবি পাওয়া যায়। এসব পাথর উত্তোলনে যুক্ত তরুণদের অধিকাংশই মাদকাসক্ত। শিকারিরা মিয়ানমারের বনাঞ্চলে বিপন্ন প্রজাতির বন্যপ্রাণী ও কাঠ পাচার করে। আর এসবের ঠিকানা হয় চীনে।
মিয়ানমারের যুদ্ধ চীনের অপরাধী চক্রগুলোর প্রভাব বাড়াচ্ছে। চক্রগুলোর ওপর প্রায়ই বেইজিং অভিযান চালায়। কিন্তু তবুও তারা কাজ করে যাচ্ছে এবং একচেটিয়া নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করছে। চীনের অস্ত্র মিয়ানমারের শাসক সেনা ও প্রতিরোধ বাহিনীর কাছে পৌঁছাচ্ছে। আর সেসব অস্ত্র দিয়েই তারা একে অপরের বিরুদ্ধে লড়াই করছে।
মিয়ানমারের সীমান্তবর্তী অঞ্চলে চীনের অপরাধী গডফাদার এবং জাতিগত সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলোর সঙ্গে যুক্ত অপরাধী চক্রগুলো বিশ্বের নানা প্রান্ত থেকে মানুষকে অপহরণ করে অনলাইনে প্রতারণা করার কারখানায় কাজ করাচ্ছে। আন্তর্জাতিক পুলিশ সংস্থাগুলো জানাচ্ছে, এই অনলাইন প্রতারণা থেকে কোটি কোটি ডলার ঠকিয়ে নেওয়া হয়েছে, বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্র, চীন, ইউরোপ ও অন্যান্য দেশে।
জাতিসংঘের মাদক ও অপরাধ দপ্তরের (ইউএনওডিসি) দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া ও প্রশান্ত মহাসাগরের আঞ্চলিক প্রতিনিধি মাসুদ কারিমিপুর বলেন, “লড়াই যত দীর্ঘায়িত হয়, ততই সেখানে এমন সব লোকজনের প্রভাব বাড়ে, যারা পরিস্থিতি থেকে লাভবান হয়।”
মিয়ানমার সেনাবাহিনী এবং জাতিগত সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলো অবৈধ অর্থনীতির সবচেয়ে বড় চালক। অভ্যুত্থানের পর, মানবাধিকার লঙ্ঘনের কারণে আন্তর্জাতিক নিষেধাজ্ঞায় সেনাবাহিনীর লাভে প্রভাব ফেলেছে। তবে গণতন্ত্র ও আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসনের পক্ষে যারা লড়ছে, তারা জানে যে অবৈধ উপার্জন তাদের যুদ্ধযন্ত্র চালানোর সবচেয়ে সহজ উপায়।
নিউ ইয়র্ক টাইমসের মিয়ানমারে যুদ্ধের প্রতিবেদনগুলো উন্মোচন করেছে যে দেশটি ব্যর্থ রাষ্ট্রে পরিণত হওয়ার কারণে সেখানে সংঘর্ষ বাড়ছে এবং এটি দুঃখ, নির্ভরশীলতা ও দুর্নীতির বিস্তার ঘটাচ্ছে, যা মহাদেশের অন্যান্য অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়ছে।
আফিম
মিয়ানমারের শান রাজ্যের পাহাড়গুলোতে পপিকে বলা হয় ‘শান্তির ফুল’। রাজ্যটিতে কয়েক বছর ধরেই অস্থিরতা চলছে। সেখানে জাতিগত গেরিলা দলগুলো সেনাবাহিনী এবং একে অপরের বিরুদ্ধে লড়াই করছে। কারণ শুধু অঞ্চলের দখলের জন্য নয়, মাদক বাণিজ্যের দখল প্রতিষ্ঠাও তাদের লক্ষ্য।
চাষের এই মৌসুমে শান রাজ্যের পেকন টাউনশিপে আফিম চাষ উদ্বেগজনক মাত্রায় বেড়েছে। দীর্ঘদিন ধরে কৃষকেরা পাহাড় ও উপত্যকায় গোপনে আফিমের চাষ করতেন। তাদের ফসল কর্তৃপক্ষের নজরে আসলে কর নয়তো ফসলের একাংশ দিয়ে দিতে হতো। আবার কখনও কর্তৃপক্ষ ক্ষেত নষ্টও করে দিত।
বর্তমানে এসব চাষি তাদের গ্রামে প্রকাশ্যেই পপি চাষ করছেন। জটিল সেচব্যবস্থার সাহায্যে এসব ক্ষেত ফুলে-ফলে ভরে উঠেছে। চার্চ, মন্দির, থানা ও টাউন হলের পাশের ক্ষেতগুলোতে পপি দোল খাচ্ছে। কৃষকেরা কোনো ভয় ছাড়াই এই ফুল থেকে আফিমের নির্যাস সংগ্রহ করছেন।
বাড়ির সামনের রাস্তার ওপারে পপি ক্ষেতে কাজ শেষে ফিরছিলেন হ্লা উইন। নিউ ইয়র্ক টাইমসের সাংবাদিককে তিনি যেতে যেতে বলেন, “এখন আর সরকার বা সেনাবাহিনী নেই, তাই লুকানোর প্রয়োজন নেই। আফিম চাষের জন্য এটাই সবচেয়ে ভালো সময়।“
অভ্যুত্থানের আগে স্থানীয় কর্তৃপক্ষ ও বিদেশি কর্মকর্তারা শান রাজ্যের আফিম চাষিদের ঐতিহ্যবাহী চাষ পদ্ধতি বাদ দিতে উৎসাহিত করেছিলেন। তারা আফিমের বিকল্প হিসেবে অ্যাভোকাডো, কফি ও ভুট্টার মতো ফসল চাষের পরামর্শ দেন। তবে এই বিচ্ছিন্ন পাহাড়ি এলাকার দরিদ্র চাষিরা জানান, এসব ফসলের বাজার খুব সীমিত।
নভেম্বর থেকে ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত চলা চাষের মৌসুমে আফিমের নির্যাসের দাম প্রতি পাউন্ড ৪৩০ ডলারে পৌঁছেছে। কয়েক বছর আগের তুলনায় এই দাম তিন গুণ বেশি।
আফিম চাষি কো হটেইন লিনের ভাষ্যে, “জীবন অনিশ্চিত। যখন আয় করার সুযোগ আসে, তখন সেটা নিতে হয়।“
ইউএনওডিসির অনুমান, ২০২৪ সালে মিয়ানমার থেকে প্রায় ১ দশমিক ২৬ বিলিয়ন ডলারের হেরোইন রপ্তানি হয়েছে। এর অধিকাংশই শান রাজ্যে উৎপাদিত। পেকনের অধিকাংশ আফিম চাষি হলেন ভাগচাষি। তারা সংঘাতের কারণে বাস্তুচ্যুত হয়েছেন এবং দৈনিক মাত্র ২ ডলার আয় করেন।
প্রতিরোধ বাহিনীর আক্রমণে অনেক জায়গা থেকেই পিছু হটেছে জান্তা বাহিনী। এখন সেসব জায়গায় হচ্ছে পপি চাষ। মজার বিষয় হলো, জান্তার সহযোগী মিলিশিয়া বাহিনীগুলোই এখন স্থানীয়দের থেকে আফিম কিনছে। তবে কিছু বিদ্রোহী গ্রুপও এই বাণিজ্যে জড়িত।
বাস্তবতা উঠে আসে পেকনের আফিম চাষি কো মিও লের ভাষায়, “যারা আমাদের টাকা দিতে পারে, আমরা তাদের কাছেই বিক্রি করি। আমি জানতে চাই না তারা কারা।“
জঙ্গলে মাদকের ল্যাবরেটরি
মিয়ানমারে এক বোতল বিয়ারের দাম প্রায় ১ ডলার। আর ইয়াবা নামে পরিচিত মেথঅ্যামফেটামিন ও ক্যাফেইনের শক্তিশালী মিশ্রণের একটি ছোট গোলাপি ট্যাবলেটের দাম ২৫ সেন্টেরও কম।
গত বছর পূর্ব ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার সরকারগুলো রেকর্ড ১৯০ টন মেথঅ্যামফেটামিন জব্দ করেছে বলে জানিয়েছে ইউএনওডিসি। তবে শান রাজ্যের জঙ্গলে থাকা ল্যাবগুলোর অতিরিক্ত উৎপাদনের ফলে এর দাম কমে গেছে।
মিয়ানমারে সিনথেটিক মাদক উৎপাদন সামরিক অভ্যুত্থান এবং পরবর্তী গৃহযুদ্ধের আগেও ছিল। শান রাজ্যের কিছু স্বশাসিত অঞ্চলের আঞ্চলিক নেতারা দীর্ঘদিন ধরে মাদক ব্যবসা পরিচালনা করতেন। সামরিক বাহিনী ও তাদের সহযোগী বাহিনী লাভের একটি অংশ নিত। সাবেক পাইলটদের মতে, বিমানবাহিনীর হেলিকপ্টারগুলো পিল ও ক্রিস্টাল মেথের প্যাকেট শহর ও বন্দরে পাঠাত।
চীন মাদক উৎপাদনের উপর কঠোর হওয়ার পর মিয়ানমারে উৎপাদন তীব্র হয়। রাসায়নিক উপাদানগুলো মিয়ানমারে চলে আসে এবং চীনা ল্যাব টেকনিশিয়ানরা জঙ্গলে স্থানীয়দের ক্রিস্টাল মেথ (আইস নামেও পরিচিত) তৈরির পদ্ধতি শিখিয়ে দেয়। চীনা অপরাধীরা ইয়াবা তৈরির জন্য পিল প্রেসও সরবরাহ করেছে।
২০১৯ সালে শান রাজ্যের উত্তরাঞ্চলের কনেমন গ্রামের নিয়ন্ত্রণ ছিল একটি জাতিগত সশস্ত্র গোষ্ঠীর হাতে। দ্য টাইমসের সাংবাদিকরা ওই গ্রামে গিয়ে দেখতে পায়, মেথঅ্যামফেটামিন উৎপাদন স্থানীয় অর্থনীতিতে কীভাবে প্রভাব ফেলছে। স্থানীয়দের মতে, তিনটি বাড়ি ছাড়া সব বাড়িই ইয়াবা তৈরির কাজে জড়িত ছিল। রাতে জেনারেটরের গর্জন শান পাহাড়ের নীরবতা ভেঙে ফেলত। মাদক উৎপাদনের জন্য ব্যবহৃত অ্যাসিডের তীব্র গন্ধে বাতাস ভারি হয়ে উঠত।
মিয়ানমারে অভ্যুত্থানের পর সিনথেটিক মাদক উৎপাদনের তীব্রতা নতুন উচ্চতায় পৌঁছেছে। শান রাজ্যে জাতিগত সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলো নতুন ক্লাব ড্রাগ উৎপাদন শুরু করেছে, যেমন ‘হ্যাপি ওয়াটার‘ এবং কেটামিন, এমডিএমএ ও মেথঅ্যামফেটামিনের মিশ্রণে তৈরি ললিপপ।
শান রাজ্য থেকে সিনথেটিক মাদক লাওস ও থাইল্যান্ডে পাচার হচ্ছে। এতে আবারও সক্রিয় হচ্ছে গোল্ডেন ট্রায়াঙ্গেল। মাদকটি বাংলাদেশ ও ভারতে পাচার করা হচ্ছে জাতিগত বিদ্রোহীদের মাধ্যমে, যারা সামরিক জান্তার বিরুদ্ধে লড়াই করছে এবং একই সঙ্গে তাদের সঙ্গে ব্যবসা করছে।
মিয়ানমারের দ্বিতীয় বৃহত্তম শহর মান্দালয়। সেখানে একদল সশস্ত্র ব্যক্তি আছেন যারা বিদ্রোহী নিয়ন্ত্রিত এলাকা থেকে সিনথেটিক মাদক সংগ্রহ করে জান্তা নিয়ন্ত্রিত অঞ্চলে নিয়ে যাওয়ার কাজ করে। এরপর সেগুলো সাগর ও স্থলপথে বিদেশে পাচার হয়।
ওই সশস্ত্র দলের এক সদস্য কো ইয়ে বলেন, “আমাদের পিপলস মিলিশিয়া বলা হয়। তবে আমরা খুব কমই লড়াইয়ে অংশ নেই। আমরা মাদক ব্যবসায় জড়িত।“
বিশ্বব্যাপী প্রতারণার কারখানা
মিয়ানমারের থাইল্যান্ড সীমান্তের ঘন জঙ্গলের ভেতর এক বাড়িতে ছিলেন কো কিয়াও হাটে। ভবনের তৃতীয় তলায় ১২ ঘণ্টার শিফটে কাজ করতেন তিনি। তার সঙ্গে আরও জনা চল্লিশ ব্যক্তি একটি প্লাস্টিকের টেবিল ঘিরে কাজ করতেন। প্রত্যেককে ফোনে বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তের মানুষের সঙ্গে কথা বলতে হতো।
কিয়াওয়ের টার্গেট ছিল ফ্রান্সের মানুষ। গুগল ট্রান্সলেটর ব্যবহার করে তিনি ফরাসি নারীদের সঙ্গে কথা বলতেন। বিশেষ করে ফরাসি বিধবা নারীদের তিনি টার্গেট করতেন। লক্ষ্য ছিল ওই নারীদের সঙ্গে প্রেমের সম্পর্ক গড়ে তুলে অর্থ আত্মসাৎ করা। কখনও কখনও মাসে ৮০ হাজার ইউরোর বেশি হাতিয়ে নিত কিয়াও। আর এজন্য তিনি মাসে পেতেন ৪৪৫ ডলার। তার সঙ্গে থাকা চার আফ্রিকান, সাত ভারতীয় ও পাঁচ চীনাও একই কাজ করত।
জাতিসংঘের হিসাব অনুসারে, ২০২৪ সালে মিয়ানমারে অন্তত ১ লাখ ২০ হাজার বিদেশিকে সাইবার অপরাধ ও অনলাইন জুয়ার কাজে বাধ্য করা হয়েছে। তাদের অনেককে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশটিতে আকর্ষণীয় চাকরির প্রলোভন দিয়ে প্রতারণা করা হয়েছিল।
ইন্টারপোলের এক অভিযান গত বছর ২২টি দেশের লোকজনকে চিহ্নিত করে, যাদের সাইবার অপরাধ কেন্দ্রগুলোতে কাজ করতে বাধ্য করা হয়েছিল। বেঁচে ফেরা ব্যক্তিরা জানান, চীনের রাস্তায় তাদের অপহরণ করা হয় এবং অস্ত্রের মুখে জাতিগত বিদ্রোহী ও চীনা অপরাধচক্রের নিয়ন্ত্রিত এলাকায় নিয়ে যাওয়া হয়।
শান ও কারেন রাজ্যে সামরিক বাহিনীর মিত্র জাতিগত মিলিশিয়া কমান্ডাররা দীর্ঘদিন ধরে নির্দ্বিধায় তাদের প্রভাব বিস্তার করে আসছে। তবে সাম্প্রতিক অভ্যুত্থানের পর পূর্বাঞ্চল নতুন করে প্রতারণার কেন্দ্রে পরিণত হয়েছে। এসব সাইবার অপরাধ ও ক্যাসিনো কেন্দ্রে সাধারণত মান্দারিন ভাষা ছাড়া অন্য কোনও ভাষায় কথা বলা হয় না।
গত বছর মিয়ানমারে প্রতারণার অভিযোগে ৪০ হাজারের বেশি চীনা নাগরিক আটক হন এবং তাদের চীনে ফেরত পাঠানো হয়। কয়েকজন চীনা অপরাধ চক্রের নেতাও গ্রেপ্তার হয়েছেন। মিয়ানমার সীমান্তে গোলাগুলিতে এক চীনা নাগরিক নিহত হন বলে চীন ও মিয়ানমারের সরকারি গণমাধ্যম জানিয়েছে।
মিয়ানমারের প্রতারণা কেন্দ্রগুলোতে কাজ করা নাগরিকরা জানান, চীনের সরকারের কঠোর পদক্ষেপের ফলে ব্যবসার কৌশল পরিবর্তিত হচ্ছে। এখন তারা চীনা ভুক্তভোগীদের পরিবর্তে আমেরিকা ও ইউরোপের মানুষকে লক্ষ্যবস্তু করছে। কর্মীরা আরও জানান, প্রতারণা চক্রের নেতারা ক্রমশ ডিপফেইক ছবি ও র্যানসমওয়্যার ব্যবহার করে ভুক্তভোগীদের কাছ থেকে অর্থ আদায় করছেন।
থাই ও চীন সরকার এসব প্রতারণা কেন্দ্র ও অনলাইন জুয়ার আসর বন্ধে অনেক পদক্ষেপ নিয়েছে। কিন্তু একটি অপরাধকেন্দ্র বন্ধ হলেও শীঘ্রই আরেকটি স্থানে নতুন কেন্দ্র গড়ে উঠছে।
নতুন নতুন খনি খনন
অভ্যুত্থানের তিন মাস আগে মিয়ানমারের উত্তরের কাচিন রাজ্যের পাংওয়ার নামের পাইনের বনে ১৫টি বিরল খনিজের খনি ছিল। কিন্তু অভ্যুত্থানের তিন মাস পর সেই সংখ্যা পাঁচ গুণ বেড়ে যায়।
গত বছর মিয়ানমার বিশ্বে নির্দিষ্ট কিছু ভারী বিরল খনিজের, যেমন ডাইসপ্রোসিয়াম এবং টার্বিয়াম, সবচেয়ে বড় রপ্তানিকারক হিসেবে বিবেচিত হয়। এসব খনিজ বিদ্যুৎচালিত যানবাহন ও উইন্ড টারবাইনের মতো পণ্যে ব্যবহৃত হয়।
বিরল খনিজ প্রক্রিয়াকরণ শিল্পে চীন একচেটিয়া প্রভাব বিস্তার করেছে। অভ্যুত্থানের আগে মিয়ানমারের নির্বাচিত সরকার খনির পরিবেশগত ক্ষতির কারণে এসব খনিজ রপ্তানি নিয়ন্ত্রণ বা নিষিদ্ধ করার চেষ্টা করেছিল। তবে পশ্চিমা দেশগুলো মিয়ানমারের সামরিক বাহিনীর ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করার পর, বেইজিংয়ের সমর্থনপুষ্ট জেনারেলরা নতুন অর্থের উৎস খুঁজতে বাধ্য হয়।
মিয়ানমারের বিরল খনিজ খনন কার্যক্রম মূলত সামরিক জান্তার সঙ্গে যুক্ত কাচিন জাতিগোষ্ঠীর একটি মিলিশিয়ার নিয়ন্ত্রণে ছিল। পরিবেশ বা শ্রম সুরক্ষার কোনো ব্যবস্থা না থাকায়, চীনের সীমান্তবর্তী পাংওয়া অঞ্চলে উচ্চমাত্রার খনন কার্যক্রম চালানো হয় বলে জানান স্থানীয় বাসিন্দারা।
শত শত চীনা খনি পরিচালকদের সঙ্গে বিরল খনিজ মাটি থেকে আলাদা করার দক্ষ চীনা প্রযুক্তিবিদরাও সেখানে উপস্থিত হন। স্থানীয়রা জানান, কয়েক মাসের মধ্যেই পাংওয়ার প্রায় সব পাইনের বন কেটে ফেলা হয়। তবে একটি কবরস্থানের গাছের ঝোপ অক্ষত থাকে, যেখানে স্থানীয় মিলিশিয়া নেতার দাদা-দাদির কবর রয়েছে।
অন্য দুটি খনি শহরের মতো পাংওয়া ধ্বংস হয়ে গেছে। ইউ সান হ্লাইং খনিতে কাজ করতেন। অ্যাসিডের কারণে হাত পুড়ে যাওয়া ছাড়াও ফুসফুস দুর্বল হয়ে পড়ে তার। ইউ সানের মতো আরও অনেক শ্রমিকের একই অবস্থা। দীর্ঘ সময় খনন ও রাসায়নিক পদার্থ বহনের জন্য এসব খনি শ্রমিকরা নিয়মিত ইয়াবা সেবন করেন।
পরিবেশবিদদের মতে, বিষাক্ত রাসায়নিক পদার্থ মাটিতে মিশছে। স্থানীয়রা পানি পান করতে ভয় পাচ্ছে। কাচিন রাজ্যের খনি এলাকায় ভূমিধস একটি নিরবচ্ছিন্ন হুমকি। সেখানে অবৈধভাবে জেড পাথর খননের কারণে প্রতিবছর অনেক খনি শ্রমিক নিহত হন।
গত অক্টোবরে জান্তাবিরোধী কাচিন বিদ্রোহীরা পাংওয়া দখল করে। এখন তারা চীন-কাচিন সীমান্তের পুরো এলাকা নিয়ন্ত্রণ করছে। এই এলাকা দিয়েই বিরল খনিজ, কাঠ, জেড পাথর ও অন্যান্য মূল্যবান দ্রব্য চোরাচালান করা হয়।
বিদ্রোহীদের বিজয়ের পর কয়েক সপ্তাহ বিরল খনিজ খনন বন্ধ ছিল। চীনা শ্রমিকরা তাদের দেশে ফিরে গিয়েছিল। তবে কাচিন প্রতিরোধ বাহিনীর নিয়ন্ত্রণে থাকা অন্যান্য এলাকাতে বিরল খনিজ খনন করা হয়। স্যাটেলাইট চিত্রে ওই অঞ্চলের ক্ষতচিহ্ন চিত্র দেখা গেছে।
কাচিন বিদ্রোহীদের মুখপাত্র কর্নেল নাও বু বলেন, “আমরা এখন পরীক্ষা নিরীক্ষা করছি। ব্যবসায়িক উদ্দেশ্যে খনন চালাতে হলে, আমরা জনস্বাস্থ্যের সুরক্ষা আগে নিশ্চিত করব।“
তিনি জানান, খনিজ পদার্থ খনন নিয়ে চীনা ব্যবসায়ীদের সঙ্গে আলোচনা চলছে। এ নিয়ে আলোচনা করতে কাচিন বিদ্রোহীদের একটি প্রতিনিধিদল সম্প্রতি চীনে গেছে।
তথ্যসূত্র : নিউ ইয়র্ক টাইমস