Beta
সোমবার, ১৩ জানুয়ারি, ২০২৫
Beta
সোমবার, ১৩ জানুয়ারি, ২০২৫

কী এই ‘ইম্পস্টার সিনড্রোম’ যা উসকে দিচ্ছে সোশ্যাল মিডিয়া

imposter- syndrome-01
[publishpress_authors_box]

নিজের যোগ্যতা নিয়ে সন্দেহ একটি জটিল ব্যাপার। এমন কি যারা অত্যন্ত সফল তাদের মধ্যেও মানসিক প্রবণতা দেখা দিতে পারে।

টম হ্যাঙ্কস, বেলা হাদিদ এবং এমা ওয়াটসনের মতো হলিউডের সেলিব্রিটিরা প্রকাশ্যে ‘ইম্পস্টার সিনড্রোম’ নামক একটি সমস্যার সঙ্গে তাদের সংগ্রামের কথা জানিয়েছেন— এটি তাদের সাফল্যের চূড়ান্ত পর্যায়েও নিজেদের কৃতিত্বের বা যোগ্যতার ব্যাপারে সন্দিহান হওয়ার এক নিরন্তর অনুভূতি।

বলিউডের অভিনেত্রী শেফালি শাহও গত বছর এনডিটিভিকে দেওয়া একটি সাক্ষাৎকারে স্বীকার করে নেন যে তিনি আত্মবিশ্বাসের অভাবে ভুগছেন।

অভিনেত্রী বলেন, “আমি মনে করি আমার ইম্পস্টার সিনড্রোম আছে এবং আমার সত্যিই খুব কম আত্মসম্মান আছে।”

যখন এই কথাগুলো বলিউডের এমন একজন সেলিব্রিটির মুখ থেকে শোনা যায়, যিনি আবার ভারতীয় অভিনয় জগতের মতো এমন একটি প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ পরিবেশে জাতীয় পুরস্কার জেতার পাশাপাশি এমি অ্যাওয়ার্ডের জন্যও মনোনীত হয়েছেন, তখন এটি সত্যিই ভাবনার ব্যাপার।

সফল হওয়া সত্ত্বেও যোগ্য না হওয়ার অনুভূতি কারও মধ্যে প্রবেশ করার অনেক কারণ থাকতে পারে। তবে এটি বড় ধরনের সংকট তৈরি করে তখনই যখন সোশ্যাল মিডিয়া ক্রমবর্ধমানভাবে এই অনুভূতিকে উসকে দেয়।

ইম্পস্টার সিনড্রোম কী?

ইম্পস্টার সিনড্রোম হল একটি মনস্তাত্ত্বিক প্যাটার্ন যেখানে ব্যক্তিরা তাদের কৃতিত্ব নিয়ে সন্দেহ করে এবং জালিয়াত হিসাবে প্রকাশ হওয়ার ভয় পায়। এটি অনেকটা পরীক্ষার খাতায় এ+ পেয়েও মনে হয় যেন কোনোভাবে চিটিং করে পাশ করেছি।

এর সঙ্গে মোকাবিলা করা মানুষেরা প্রায়ই তাদের সাফল্যকে মনে করেন, ‘কেবল ভাগ্যের জোরে’ কিংবা সবাইকে কোনওভাবে বিশ্বাস করাতে পেরেছেন যে- তারা যোগ্য। আদতে তারা সক্ষম নন।

তবে মজার বিষয় হলো, ইম্পস্টার সিনড্রোমে জর্জরিত একজন ব্যক্তি সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে আরও সফলও হতে পারেন। তবে তাদের ‘নিজের অক্ষমতা নিয়ে’ হতাশাবাদী চিন্তাভাবনা যথেষ্ট কৃতিত্বের পরও মানসিকভাবে নিজের কাছে মেনে নেওয়ার ব্যাপারে চ্যালেঞ্জ তৈরি করতে পারে।

আর্ন্তজাতিক জার্নাল অব বিহেভিয়ারাল সায়েন্সে প্রকাশিত একটি পর্যালোচনা নিবন্ধে বলা হয়েছে,  প্রায় ৭০ শতাংশ মানুষ তাদের জীবনে কোনো না কোনো সময় ইম্পস্টার সিনড্রোমের শিকার হন। এটি বিশেষ করে প্রতিযোগিতামূলক পরিবেশে বেশি দেখা যায়, যেমন শিক্ষা, কর্পোরেট কর্মক্ষেত্র, অথবা সৃজনশীল শিল্প, যেখানে বাহ্যিক স্বীকৃতি প্রায়ই ব্যক্তিগত অর্জনকে ছাপিয়ে যায়।

সোশ্যাল মিডিয়া কীভাবে ট্রিগার হিসেবে কাজ করে

আর্টেমিস হসপিটাল গুরুগ্রামের মানসিক স্বাস্থ্য ও আচরণ বিজ্ঞান বিভাগের প্রধান পরামর্শক ড. রাহুল চন্দক উল্লেখ করেছেন যে কীভাবে সোশ্যাল মিডিয়া জীবনের আদর্শ সংস্করণ উপস্থাপন করে ইম্পস্টার সিনড্রোমকে আরও বাড়িয়ে তোলে।

ড. চন্দক ব্যাখ্যা করেন, “সোশ্যাল মিডিয়া আপনাকে সবসময় অন্যদের জীবনের এবং কৃতিত্বের আদর্শ সংস্করণ দেখিয়ে ইম্পস্টার সিনড্রোমের প্রভাব বাড়িয়ে তোলে। এই প্যাকেজ করা হাইলাইটগুলোর অবিরাম প্রদর্শনী যেকোনও ব্যক্তিকে তাদের প্রকৃত কৃতিত্ব সত্ত্বেও অনুপযুক্ত সাধারণ মানের বোধ তৈরি করে।”

“ইনফ্লুয়েন্সার এবং সমবয়সীদের দ্বারা নির্ধারিত অবাস্তব মান পূরণের চাপ আত্ম-সন্দেহ এবং এই বিশ্বাসে তৈরি করে যে সাফল্য অন্যায্য। পোস্টগুলোর পেছনের প্রেক্ষাপটের অভাবে একটি বিকৃত বাস্তবতাও তৈরি হয়, যা ব্যর্থতার অনুভূতিকে আরও বাড়িয়ে তোলে। ডিজিটাল পরিবেশ পরিবেশনকারীদের ‘পরিপূর্ণতা’কে উৎসাহিত করে কারণ ব্যক্তিরা বিচার বা প্রত্যাখ্যানের ভয় পায়, যা ইম্পস্টার সিনড্রোমকে আরও বাড়িয়ে তোলে। সোশ্যাল মিডিয়ার যুগে আত্মসম্মান বজায় রাখার জন্য সচেতন ব্যবহার এবং তুলনা সীমিত করা অত্যন্ত জরুরি,” তিনি যোগ করেন।

কোন জনগোষ্ঠী সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত

কিছু গোষ্ঠীর অন্যদের তুলনায় সোশ্যাল মিডিয়া-প্ররোচিত ইম্পস্টার সিনড্রোমের শিকার হওয়ার ঝুঁকিতে বেশি। গ্লেনেগলস বিজিএস হসপিটালের মনোবিজ্ঞানী সুমালতা বাসুদেবা ব্যাখ্যা করেন, “কিশোর-কিশোরী এবং তরুণ প্রাপ্তবয়স্করা বিশেষভাবে সংবেদনশীল- কারণ তারা এখনও তাদের পরিচয় তৈরি করছে এবং তারা ব্যাপকভাবে সমকক্ষদের স্বীকৃতির উপর নির্ভর করে।”

ইন্ডিয়া টুডেকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে শিশু মনোবিজ্ঞানী ঋদ্ধি দোশী প্যাটেলও একই কথা বলেন, “কিশোর-কিশোরীরা প্রতিনিয়ত সোশ্যাল মিডিয়ায় ফিল্টার করা বাস্তবতার সাথে নিজেদের তুলনা করে, যার ফলে অপর্যাপ্ততা এবং আত্ম-সন্দেহের অনুভূতি হয়।”

অন্যদের কিউরেটেড জীবনের সঙ্গে এই অবিরাম তুলনা—সাফল্য, ছুটি এবং নিখুঁত মুহূর্তের ছবিতে ভরা রিল—তাদের বাস্তবতার অনুভূতিকে বিকৃত করে। নিজেদের অর্জনের উপর মনোযোগ দেওয়ার পরিবর্তে, অনেকেই মনে করে যেন তারা পিছিয়ে পড়ছে।

এর সাথে যোগ হয়েছে কিছু হারানোর ভয় বা ফিয়ার অব মিসিং আউট (ফোমো)। প্যাটেল উল্লেখ করেন, “সোশ্যাল মিডিয়ায় ক্রমাগত আপডেট ফোমো- এর অনুভূতি তৈরি করতে পারে, যা কিশোর-কিশোরীদের বিশ্বাস করায় যে তারা উত্তেজনাপূর্ণ অভিজ্ঞতা হারাচ্ছে।”

লাইক, কমেন্ট এবং ফলোয়ার সংখ্যার মোহ এই নিরাপত্তাহীনতাকে আরও গভীর করে।

কিন্তু শুধু কিশোর-কিশোরীরাই ঝুঁকিতে নেই। পেশাদার এবং অ্যাকাডেমিক ক্ষেত্রে নারীরা প্রায়ই সামাজিক চাপ এবং লিঙ্গ বৈষম্যের কারণে উচ্চ মাত্রার ইম্পস্টার সিনড্রোমের শিকার হন।

“সৃজনশীল এবং প্রতিযোগিতামূলক পেশাদাররাও প্রবণ, কারণ তাদের কাজের সাফল্য প্রায়ই জনসাধারণের স্বীকৃতির ওপর এখনও অনেকটা নির্ভরশীল”, বাসুদেবা উল্লেখ করেন। এছাড়াও, প্রান্তিক জনগোষ্ঠী মানুষেরা অনন্য চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হয়, কারণ পদ্ধতিগত পক্ষপাতিত্ব এবং স্টেরিওটাইপগুলো প্রায়ই অনলাইন স্পেসে আরও বেড়ে যায়, যা সংগ্রামের সঙ্গে আরও একটি স্তর যোগ করে।

প্রতিরোধের উপায়

বিশেষজ্ঞরা বলেন, সোশ্যাল মিডিয়া অপ্রতিরোধ্য হতে পারে, তবে এর নেতিবাচক প্রভাব কমানোর উপায় আছে:

• আপনার ফিড কিউরেট করুন: এমন অ্যাকাউন্টগুলি অনুসরণ করুন যা অথেনটিসিটি, বাস্তবতা এবং ইতিবাচকতাকে উৎসাহিত করে, তুলনা করে এমনগুলো এড়িয়ে চলুন।

• স্ক্রিন টাইম সীমিত করুন: কিউরেটেড কনটেন্টের অতিরিক্ত প্রকাশ কমাতে সীমা নির্ধারণ করুন।

• আত্ম-সহানুভূতি অনুশীলন করুন: নিজেকে মনে করিয়ে দিন যে সোশ্যাল মিডিয়া প্রায়ই সেরা মুহূর্তগুলিকে তুলে ধরে এবং সংগ্রামগুলো বাদ দেয়।

• ব্যক্তিগত লক্ষ্যের উপর মনোযোগ দিন: বাহ্যিক স্বীকৃতি থেকে অভ্যন্তরীণ বৃদ্ধি এবং অর্জনের দিকে আপনার মনোযোগ সরান।

• নিজের অনুভূতির নথি: নিজের অগ্রগতি বুঝতে এবং মাইলফলক উদযাপন করতে আপনার কৃতিত্বগুলো নথিভুক্ত করুন।

• খুলে বলুন: দৃষ্টিভঙ্গির জন্য বিশ্বস্ত বন্ধু বা থেরাপিস্টের সঙ্গে আত্ম-সন্দেহের অনুভূতি নিয়ে আলোচনা করুন।

• বিরতি নিন: পর্যায়ক্রমিক সোশ্যাল মিডিয়া ডিটক্স আপনার আত্ম-উপলব্ধি পুনরুদ্ধার করতে এবং বাস্তবতার সঙ্গে পুনরায় সংযোগ স্থাপন করতে সাহায্য করতে পারে।

আরও পড়ুন

সর্বশেষ

সর্বাধিক পঠিত