চীন থেকে ছড়ানো হিউম্যান মেটানিউমোভাইরাস বা এইচএমপিভি নিয়ে গত কয়েকদিন ধরেই আতঙ্কে রয়েছেন সাধারণ মানুষ। বিশেষ করে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সতর্ক করতে ছড়ানো হচ্ছে নানা ধরনের তথ্য, ফটোকার্ড। যা আদতে উদ্বেগ বাড়াচ্ছে।
অনেকেই আবার নতুন মহামারির আশঙ্কার কথা বলছেন, কোভিড মহামারির মতো পরিস্থিতি আসতে পারে এমন কথাও জানাচ্ছেন।
এ অবস্থায় প্রথমে ভারতে এবং সম্প্রতি বাংলাদেশে এক রোগীর শরীরে ভাইরাসটির সংক্রমণ ধরা পড়ে। ফলে আতঙ্কের মাত্রা আরও বেড়ে যায়।
যদিও হিউম্যান মেটানিউমোভাইরাস বা এইচএমপিভি নিয়ে আতঙ্কিত হওয়ার কিছু নেই বলে আশ্বস্ত করেছেন প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী অধ্যাপক ডা. সায়েদুর রহমান।
তিনি বলেন, “এইচএমপিভি নিয়ে মহামারির শঙ্কা নেই। এজন্য সীমান্তে সতর্কতার কিছু নেই। তবে এ নিয়ে সরকারের প্রস্তুতি আছে।”
সোমবার সচিবালয়ে আলোচিত রোগটি নিয়ে সাংবাদিকদের বিভিন্ন প্রশ্নের উত্তর দেন তিনি।
ডা. সায়েদুর রহমান বলেন, “বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা এই ভাইরাস নিয়ে অ্যালার্ট দেয়নি। এটা নিয়ে আতঙ্কিত হওয়ার কিছু নেই।”
এইচএমপিভি নিয়ে সরকারের প্রস্তুতি আছে জানিয়ে তিনি বলেন, “এক্ষেত্রে আলাদা চিকিৎসা গাইডলাইন করা হবে। যদিও এখন যে গাইডলাইন রয়েছে তার সঙ্গে এর বেশি পার্থক্য থাকবে না।
“এইচএমপিভি কোভিডের মতো ভয়ংকর না। শুধু শ্বাসযন্ত্রে সংক্রমণের ক্ষেত্রে মিল আছে। করোনার মতো স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলতে হবে না। তবে শিশু ও বয়স্কদের জন্য সতর্কতা হিসেবে মাস্ক পরতে হবে।”
এই রোগের চিকিৎসা সাধারণ ফ্লুর মতো বলেও জানান তিনি।
নতুন এই ভাইরাসজনিত রোগটি নিয়ে একই ধরনের কথা বলেছেন রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (আইইডিসিআর) সাবেক প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা এবং বর্তমান উপদেষ্টা ডা. মুশতাক হোসেন।
তিনি সকাল সন্ধ্যাকে বলেছেন, “আগেও এই ভাইরাস ছিল, এটা নতুন না, সব দেশেই আছে, বাংলাদেশেও রয়েছে। তাই উদ্বেগের কিছু নেই। অহেতুক আতঙ্কিত হওয়ার কিছু নেই।”
এইচএমপিভিকে সাধারণত প্রাণঘাতী বলা হয় না জানিয়ে তিনি বলেন, “তবে যারা বৃদ্ধ, যারা অন্যান্য দীর্ঘমেয়াদী জটিল রোগে আক্রান্ত, তাদের ক্ষেত্রে বিষয়টি অন্যরকম। যেহেতু তাদের শরীরে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কম, তাদের জন্য আরও বেশি সাবধানতা জরুরি। সঙ্গে সাবধান হতে হবে শিশুর বেলাতেও।”
একই কথা বলছেন অন্য ভাইরোলজিস্টরাও। ঢাকা মেডিকেল কলেজের ভাইরোলজি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ডা. নুসরাত সুলতানা এইচএমপিভিকে একটি মৌসুমী ভাইরাস জানিয়ে বলেন, “বাংলাদেশে করা এক গবেষণায় ২০১৪ সালের আগস্ট থেকে ২০১৫ সালের জুলাই পর্যন্ত পাঁচ বছরের কম বয়সী ২০০ জন নিউমোনিয়ার উপসর্গ নিয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়। সেসময় তাদের শ্লেষ্মা পরীক্ষা করে ২৬ জনের শরীরে এইচএমপিভি ধরা পড়েছিল।
“মানবদেহে এইচএমপিভি সংক্রমণ প্রথম শনাক্ত হয় ২০০১ সালে। তবে এর অস্তিত্ব বিশ্বে আগেও ছিল। এর সংক্রমণ মৃদু, প্রাণঘাতী নয়। তবে বৃদ্ধ, যাদের কোমরবিডিটি রয়েছে, যাদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কম এবং শিশুদের জন্য এটা জটিল হতে পারে।”
ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব ল্যাবরেটরি মেডিসিন অ্যান্ড রেফারেল সেন্টারের ভাইরোলজি বিভাগের প্রধান সহকারী অধ্যাপক ডা. আরিফা আকরাম সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “অনেক আগেই এইচএমপিভি শনাক্ত হয় বাংলাদেশে এবং প্রতি বছরই এক কিংবা একাধিক কেইস পাওয়া যায়, তবে সেটি খুব বেশি নয়। সিভিয়ার কেইস এখনও পাওয়া যায়নি।”
বাংলাদেশে এইপএমপিভিতে আক্রান্ত হওয়া নারী ক্লেবসিয়েলা নিউমোনিয়া নামের একটি ব্যাকটেরিয়ায় সংক্রমিত ছিলেন বলে জানিয়েছেন স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের রোগ নিয়ন্ত্রণ শাখার পরিচালক ডা. শেখ ফরহাদ হোসেন। আর এজন্যই তাকে হাসপাতালে নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে নেওয়া হয়েছিল। যদিও তার অবস্থার উন্নতি হয়েছে।
এইচএমপিভি ভাইরাস প্রতিরোধে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর সাত দফা নির্দেশনা দিয়েছে।
অধিদপ্তরের রোগ নিয়ন্ত্রণ শাখার লাইন ডিরেক্টর অধ্যাপক ডা. মো. হালিমুর রশিদের সই করা নোটিশে বলা হয়,
শীতকালীন শ্বাসতন্ত্রের রোগগুলো থেকে নিজেকে রক্ষার জন্য মাস্ক ব্যবহার করতে হবে, হাঁচি বা কাশির সময় বাহু বা টিস্যু দিয়ে নাক-মুখ ঢেকে রাখতে হবে, ব্যবহৃত টিস্যুটি ঢাকনাযুক্ত ময়লা ফেলার ঝুড়িতে ফেলার পর হ্যান্ড স্যানিটাইজার অথবা সাবান পানি দিয়ে হাত ধুতে হবে।
এছাড়া আক্রান্ত ব্যক্তির সংস্পর্শ এড়িয়ে চলা ও কমপক্ষে তিন ফুট দূরত্ব বজায় রাখতে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে, বলা হয়েছে ঘন ঘন সাবান ও পানি কিংবা হ্যান্ড স্যানিটাইজার দিয়ে হাত পরিস্কার করতে।
অপরিষ্কার হাতে চোখ, নাক, মুখ না ধরা এবং জ্বর, কাশি ও শ্বাসকষ্ট হলে সুস্থ না হওয়া পর্যন্ত বাড়িতে থাকতেও নির্দেশনায় বলা হয়েছে।
এছাড়াও ভাইরাসটি প্রতিরোধে সব মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, সিভিল সার্জন, জেলা স্বাস্থ্য তত্ত্বাবধায়ক, উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ কর্মকর্তা, দেশের সব বিমানবন্দরের স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ও সব বন্দর স্বাস্থ্য কর্মকর্তাকে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতেও বলা হয়েছে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের নোটিশে বলা হয়েছে, চীনসহ উপমহাদেশে বিভিন্ন দেশে এইচএমপিভি ভাইরাসের প্রাদুর্ভাব এবং ভাইরাসের তীব্রতা উদ্বেগজনকভাবে বেড়েছে। বিশেষ করে ১৪ বছরের কম বয়সি শিশু ও ৬৫ বছর বা তার বেশি বয়সি ব্যক্তিদের মধ্যে এ রোগের সংক্রমণ বেশি দেখা যায়। সেইসঙ্গে দীর্ঘমেয়াদি স্বাস্থ্য সমস্যা যেমন, হাঁপানি বা ক্রনিক অবস্ট্রাকটিভ পালমোনারি ডিজিজ, গর্ভবতী নারী ও দুর্বল রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাসম্পন্ন ব্যক্তিদের জন্য উচ্চ ঝুঁকি সৃষ্টি হতে পারে।
পৃথিবীর অন্যান্য বহু দেশের মতো বাংলাদেশেও এই রোগের সংক্রমণ দেখা দিয়েছৈ। সম্প্রতি চীন ও অন্যান্য দেশে এর প্রার্দুভাব দেখা দেয়ায় বাংলাদেশর সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে রাখা আবশ্যক। যার জন্য সকল স্বাস্থ্য সেবা কেন্দ্র এবং পয়েন্টস অব এন্ট্রিগুলোয় স্বাস্থ্যবিধি জোরদার করা প্রয়োজন।
প্রয়োজনে নিকটস্থ হাসপাতালে যোগাযোগের পরামর্শও দেওয়া হয়েছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের নোটিশে।
অধিদপ্তর আরও জানিয়েছে, হিউম্যান মেটানিউমো ভাইরাস অন্যান্য শ্বাসতন্ত্রের রোগের মত ফ্লু এর মত উপসর্গ সৃষ্টি করে। যা সাধারণত ২-৫ দিনের মধ্যে ভালো হয়ে যায়। তাই আতঙ্কিত হওয়ার দরকার নাই। সবাইকে স্বাস্থ্য বিধি মেনে চলতেও অনুরোধ করা হয়েছে।