Beta
শুক্রবার, ১৭ জানুয়ারি, ২০২৫
Beta
শুক্রবার, ১৭ জানুয়ারি, ২০২৫

‘প্রিজন ভ্যানের আসামির সঙ্গে আমরাও আসামি’

prison van
[publishpress_authors_box]

প্রায় ১০ ফুট উঁচু প্রিজন ভ্যান। উপরে ইস্পাতের ছাদ। ছাদের একটু নিচে লম্বালম্বি লোহার জাল। প্রিজন ভ্যানে নেই জানালা বা ফ্যান। গরমে পানির পিপাসা পেলে নেই তা মেটানোর ব্যবস্থাও। আবার কারাগার থেকে আদালতে আনা-নেওয়ার পথে কোনও কোনও আসামি প্রস্রাব-পায়খানাও করে ফেলেন। কিন্তু গাড়ি থামানোর সুযোগ নেই নিরাপত্তাজনিত কারণে। প্রিজন ভ্যানের এমন পরিবেশ নিয়ে ক্ষুব্ধ চালক ও নিরাপত্তায় থাকা পুলিশ সদস্যরা।

তাদেরই একজন পুলিশ কনস্টেবল রাকিব হাসান (ছদ্মনাম)। গত ৩০ বছর ধরে প্রিজন ভ্যানে করে বিভিন্ন কারাগার থেকে আসামিদের ঢাকার জজ কোর্টে আনা-নেওয়া করছেন তিনি।

রাকিব হাসান বলছেন, প্রিজন ভ্যানে আসামিদের আনা-নেওয়াকে কেন্দ্র করে নানা প্রতিকূল পরিস্থিতির মুখে পড়তে হয়। রোদে পুড়ে, বৃষ্টিতে ভিজে বিভিন্ন আন্দোলনের মুখেও দায়িত্ব পালন করতে হয়।

সকাল সন্ধ্যাকে তিনি বলেন, “রাস্তার টোকাই থেকে শুরু করে ভিআইপি, এমপি, মন্ত্রী, নায়ক-নায়িকা, গায়ক-গায়িকা সবাই উঠেছে আমার প্রিজন ভ্যানে। যখন প্রিজন ভ্যানের স্টিয়ারিংয়ের উপর বসে থাকি, গাড়ির ভেতরে থাকা কয়েদিরা যে কষ্ট অনুভব করে একই অবস্থা আমাদেরও হয়।”

রাকিব হাসান বলেন, “কাশিমপুর কারাগার থেকে আসামিদের আদালতে আনার জন্য আমাদেরও ভোরবেলায় ঘুম থেকে উঠতে হয়। এরপর ফ্রেশ হয়ে গাড়ি রেডি করতে হয়। ভোর থাকতে থাকতে কয়েদিদের সেল থেকে গুনে গুনে উঠানো হয় প্রিজন ভ্যানে।

“সকাল সাড়ে ৬টা থেকে ৭টার মধ্যে রওনা দিতে হয়। সকাল-সকাল রওনা করতে না পারলে দুই থেকে তিন ঘণ্টার বেশি সময় লেগে যায় পৌঁছতে। কোর্টের কাজ শেষে ফেরার সময় তিন থেকে চার ঘণ্টাও লেগে যায়।”

তিনি জানান, দীর্ঘ এই পথে কোনও কোনও আসামি প্রিজন ভ্যানেই প্রস্রাব-পায়খানা করে ফেলেন। তাদেরও কষ্ট হয় প্রস্রাব-পায়খানা চেপে রাখতে। কারণ পথে গাড়ি থামানো যাবে না নিরাপত্তার জন্য।

রাকিব হাসান বলেন, “এরমধ্যে কোনও আসামি বা পুলিশের প্রস্রাব-পায়খানার বেগ পেলে কিছুই করার থাকে না। গাড়িতে থাকা অবস্থায় অনেক আসামি প্রস্রাব-পায়খানা করে ফেলেন। আমাদেরও অনেক কষ্ট হয়। তবে বাধ্য হয়ে চেপে ধরে রাখি। নিরাপত্তার স্বার্থে পথিমধ্যে কখনও গাড়ি থামানো হয় না।

“তবে কোর্টে পৌঁছানো মাত্র দৌড় দিয়ে প্রাকৃতিক কাজ সেরে নেই। আসামিদের ভ্যান থেকে নামানোর পর তারা তখন ফ্রেশ হতে পারেন।”

প্রিজন ভ্যানে মোবাইল টয়লেট থাকলে সবারই কষ্ট কম হতো বলে মনে করেন এই চালক। তিনি জানান, শীতকালে আসামিদের তেমন কষ্ট হয় না; বেশি কষ্ট হয় গরমের সময়।

রাকিব হাসান বলেন, “বড় একটা গাড়িতে ৫০ থেকে ৬০ জন পর্যন্ত আসামি নেওয়া হয়। ধাতব বডি থাকায় বাইরের তুলনায় গাড়ির তাপমাত্রা বেশ বেড়ে যায়। এক জায়গায় বেশি মানুষ থাকলে তাপমাত্রার সঙ্গে আর্দ্রতাও বাড়ে।

“পর্যাপ্ত ভেন্টিলেশন ও ফ্যান না থাকায় পরিবেশ অসহ্যকর হয়ে যায়। সারাদিন গাড়ির স্টিয়ারিং ধরে গরমের মধ্যে বসে থাকতে হয়। বাইরের গরম আর ইঞ্জিনের গরমে এক নারকীয় পরিবেশ সৃষ্টি হয়। তখন মনে হয়, প্রিজন ভ্যানের আসামির সঙ্গে আমরাও আসামি।”

প্রিজন ভ্যানের আরেক চালক পুলিশ কনস্টেবল ইলিয়াস চামকা জানান, তিনি যখন গাজীপুরের কাশিমপুর কারাগার থেকে আসামি আনা-নেওয়া করতেন তখন অনেক কষ্ট হতো। এখন কেরানীগঞ্জ কারাগার থেকে আসামিদের আনা নেওয়া করায় খুব বেশি কষ্ট হয় না তার।

প্রিজন ভ্যানে পুরুষ আসামিদের চেয়ে নারী আসামিরা বেশি কষ্ট পায় জানিয়ে তিনি বলেন, “শীতের ৩ মাস খুব একটা কষ্ট না হলেও বেশি কষ্ট হয় গরমে। গরমের মধ্যে অনেক নারী কয়েদির অবস্থা খুব খারাপ হয়ে যায়। ছোট ছোট পিকআপ ভ্যান করে আনা-নেওয়া করলে তাদের কিছুটা কষ্ট লাঘব হতে পারে। ভ্যানের মধ্যে ফিল্টার পানি, ফ্যান ও মোবাইল টয়লেট থাকাটা খুবই জরুরি।”

ইলিয়াস চামকা বলেন, “আইন-আদালতে সবাই আসামি হয়ে আসেন না। নিরপরাধ ব্যক্তিও থাকেন। তুলনামূলক তাদের শাস্তিটা আরও বেশি হয়ে যায়। অনেক সময় গাড়ি যানজট পড়লে গরমে তাদের সঙ্গে আমরাও সিদ্ধ হয়ে যাই। আসামিদের নিরাপত্তা ও চাকরির কথা চিন্তা করে সব মুখ বুঝে সহ্য করি। আমার মতো অন্য চালকদের একই অবস্থা।”

প্রিজন ভ্যানের এই চালক মনে করেন, যাদের প্রতিদিনই আদালতে আসামিদের হাজির করার কাজ তাদের আদালতের আশেপাশে রাখা উচিৎ। তাহলে খরচ ও সময় দুটোই অপচয় কম হবে।

তিনি বলেন, “যারা দীর্ঘদিন গাড়ি চালান তাদের কোমরে ব্যথা হয়েছে। প্রতিদিন ৬/৭ ঘণ্টা প্রিজন ভ্যানের স্টিয়ারিংয়ে বসে থেকে আমারও কোমরের অবস্থা খুব খারাপ হয়ে গেছে।”

এসময় সাপ্তাহিক ছুটিসহ অন্যান্য সুযোগ-সুবিধার দাবি জানান এই পুলিশ সদস্য।

ঢাকার বনানী থানার মাদকদ্রব্য আইনের মামলায় কাশিমপুর কারাগারে রয়েছেন ইদ্রিস আলী। সম্প্রতি প্রিজন ভ্যানে করে আদালতে আনা হয় তাকে।

ভ্যান থেকে নামার সময় সকাল সন্ধ্যার এক প্রশ্নে তিনি বলেন, “প্রথম অবস্থায় কেরানীগঞ্জ কারাগারে থাকলেও এখন কাশিমপুরে আমাকে রাখা হচ্ছে। কেরানীগঞ্জ কারাগার থেকে ঢাকার আদালতে আসতে তেমন কষ্ট হয়নি। তবে এখন অনেক অনেক কষ্ট হয়।

“প্রিজন ভ্যানে সারা পথ দাঁড়িয়ে থাকি। বসার মতো কোনও পরিবেশ নেই। আর গরমের মধ্যে কতটা কষ্ট হয় কাউকে বলে বোঝানো যাবে না। আসামি হলেও আমরা তো মানুষ।”

প্রিজন ভ্যানের এমন পরিবেশের বিষয়ে সকাল সন্ধ্যা কথা বলেছে ঢাকার জ্যেষ্ঠ আইনজীবী মোখলেসুর রহমানের সঙ্গে। তিনি মনে করেন, বর্তমানে যেভাবে আসামিদের আনা-নেওয়া হচ্ছে তা আরও উন্নত করতে হবে।

মোখলেসুর রহমান বলেন, “অভিযুক্ত যে-ই হোক না কেন তার ন্যূনতম সুযোগ-সুবিধার নিশ্চিত করতে হয়। বাংলাদেশের সংবিধানে সুস্পষ্টই বলা রয়েছে, দেশের সকল নাগরিক আইনের দৃষ্টিতে সমান। সেই দিক থেকে ন্যূনতম হলেও সুযোগ-সুবিধা দেওয়া উচিৎ।”

তিনি বলেন, “মাতৃগর্ভে থেকে কেউ অপরাধী হয়ে জন্ম নেন না। পারিপার্শ্বিক কারণে অপরাধী বনে যান। তাদের সংশোধনের জায়গা হচ্ছে কারাগার।

“বর্তমানে যেভাবে আসামিদের আনা-নেওয়া হচ্ছে তা আরও উন্নত করতে হবে। অন্তত গরমের সময় আসামিদের প্রিজন ভ্যানে বহনের জন্য ন্যূনতম সুবিধা থাকা প্রয়োজন। রাষ্ট্রকে আরও সচেতন হতে হবে।”

এ বিষয়ে জানতে চাইলে ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) উপ-কমিশনার (মিডিয়া) তালেবুর রহমান সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “আমার কাছে কোনও তথ্য নেই। আমি এই সম্পর্কে কোনও মন্তব্য করতে পারব না।”

এসময় ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের সাথে যোগাযোগ করার অনুরোধ জানান তিনি।

এ বিষয়ে জানতে ডিএমপির উপ-পুলিশ কমিশনার (প্রসিকিউশন বিভাগ) তারেক জুবানের মোবাইল ফোনে একাধিকবার চেষ্টা করেও তার সাড়া পাওয়া যায়নি।

আরও পড়ুন

সর্বশেষ

সর্বাধিক পঠিত