টানা এক যুগের বেশি সময় ধরে কারাবন্দি সাবেক স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবরের মুক্তির পথ খুলেছে।
১০ ট্রাক অস্ত্র আটকের ঘটনায় অস্ত্র আইনের মামলাটিতে মঙ্গলবার তিনি হাই কোর্ট থেকে খালাস পাওয়ার পর তার আইনজীবী বলেছেন, এখন তার মুক্তিতে আর বাধা নেই।
এই ঘটনায় বিশেষ ক্ষমতা আইনের মামলাটিতে উচ্চ আদালত তাকে খালাস দিয়েছিল। রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের পর ২১ আগস্ট মামলা থেকেও খালাস পান তিনি।
নেত্রকোনা-৪ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য বাবর ২০০১ থেকে ২০০৬ পর্যন্ত খালেদা জিয়ার সরকারে স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী ছিলেন।
২০০৭ সালে জরুরি অবস্থার সময় গ্রেপ্তার হলেও জামিনে ছাড়া পেয়ে ২০০৮ সালের নির্বাচনে স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়ে অংশ নিয়েছিলেন তিনি।
পরে তিনি গ্রেপ্তার হয়ে আওয়ামী লীগ শাসনামলের পুরোটা সময়ই বন্দি ছিলেন। এই সময়কালে ১০ ট্রাক অস্ত্র ও গ্রেনেড হামলার মামলায় তার সাজার রায় হয়েছিল বিচারিক আদালতে।
ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে গত ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলার মামলায় হাই কোর্ট খালাস দেয় বাবরকে।
১০ ট্রাক অস্ত্র চোরাচালানের ঘটনায় বিশেষ ক্ষমতা আইনের মামলায় গত ১৮ ডিসেম্বর তাকে খালাস দিয়ে রায় আসে উচ্চ আদালত থেকে। ওই মামলায় তাকে মৃত্যুদণ্ড দিয়েছিল বিচারিক আদালত।
অস্ত্র আইনের মামলাটিতে মঙ্গলবার রায় দেয় বিচারপতি মোস্তফা জামান ইসলাম ও বিচারপতি নাসরিন আক্তারের হাই কোর্ট বেঞ্চ।
২০১৪ সালে চট্টগ্রামের আদালত অস্ত্র আইনের ১৯ (ক) ধারায় ১৪ আসামিকে যাবজ্জীবন এবং ১৯ (চ) ধারায় সাত বছর সশ্রম কারাদণ্ড দিয়েছিল।
আপিলের রায়ে হাই কোর্ট বাবরসহ পাঁচজনকে খালাস দিয়েছে। মারা যাওয়ায় চার আসামির ক্ষেত্রে মামলা বাতিল করেছে উচ্চ আদালত।
হাই কোর্ট ভারতের বিদ্রোহী সংগঠন উলফার সামরিক কমান্ডার পরেশ বড়ুয়াকে ১৪ বছর এবং চার আসামিকে ১০ বছর করে কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে।
বাবর ছাড়া অন্য যে চারজন খালাস পেয়েছেন, তারা হলেন- রাষ্ট্রায়ত্ত সার কারখানা চিটাগং ইউরিয়া ফার্টিলাইজার লিমিটেডের (সিইউএফএল) সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক মহসিন তালুকদার, ইউএফএলের সাবেক মহাব্যবস্থাপক (প্রশাসন) এ কে এম এনামুল হক, এনএসআইয়ের সাবেক মহাপরিচালক অবসরপ্রাপ্ত মেজর জেনারেল রেজ্জাকুল হায়দার চৌধুরী ও সাবেক ভারপ্রাপ্ত শিল্পসচিব নুরুল আমীন।
এনএসআইয়ের সাবেক পরিচালক অবসরপ্রাপ্ত উইং কমান্ডার সাহাব উদ্দিন আহাম্মদ, এনএসআইয়ের সাবেক উপপরিচালক অবসরপ্রাপ্ত মেজর লিয়াকত হোসেন, এনএসআইয়ের সাবেক মাঠ কর্মকর্তা আকবর হোসেন খান ও চোরাকারবার হাফিজুর রহমানকে ১০ বছর করে কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে।
আপিল বিচারাধীন থাকা অবস্থায় মৃত্যু হওয়ায় এনএসআইয়ের সাবেক মহাপরিচালক আব্দুর রহিম, জামায়াতের সাবেক আমির, সাবেক শিল্পমন্ত্রী মতিউর রহমান নিজামী, চোরাকারবারি দীন মোহাম্মদ ও চোরাকারবারিদের সহযোগী হাজি আবদুস সোবহানকে খালাসপ্রাপ্ত ঘোষণা করে তাদের আপিল বাতিল করেছে উচ্চ আদালত।
আদালতে আসামিদের পক্ষে শুনানি করেন জ্যেষ্ঠ আইনজীবী এস এম শাহজাহান ও আইনজীবী মোহাম্মদ শিশির মনির। রাষ্ট্রপক্ষে ছিলেন ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল সুলতানা আক্তার রুবী ও সহকারী অ্যাটর্নি জেনারেল মো. আসিফ ইমরান জিসান।
রায়র পর শিশির মনির সাংবাদিকদের বলেন, “এ মামলায় লুৎফুজ্জামান বাবরকে ৭৮ রিমান্ডে নিয়ে চাপ দেওয়া হয়েছিল বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া ও ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান জড়িয়ে জবানবন্দি দিতে। এই জবানবন্দি দিলে তাকে (বাবরকে) আসামি না করে সাক্ষী করার আশ্বাস দেওয়া হয়েছিল।
“কিন্তু ৭৮ দিন রিমান্ডে থাকার পরও তিনি এই জবানবন্দি দিতে রাজি হননি। যে কারণে তাকে এ মামলায় আসামি করা হয়।”
শিশির মনির বলেন, “আদালত বলেছেন, আজকেই একটি লিখিত অ্যাডভান্স (অগ্রিম) আদেশ দেওয়া হবে। আশা করছি, অগ্রিম আদেশটি বাস্তবায়নের পর দ্রুত সময়ের মধ্যে তিনি জেল থেকে মুক্তি পাবেন। তিনি কেরানীগঞ্জে কেন্দ্রীয় কারাগারে আছেন। আদেশটি সেখানে পৌঁছার পর তাকে কারাগার থেকে মুক্তি দেওয়া হবে।”
যাবজ্জীবন থেকে কমিয়ে যে চারজনকে ১০ বছরের কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে, তারা ১০ বছরের বেশি সময় ধরে কারাগারে আছেন। ফলে ১০ বছরের সাজা তারা খেটে ফেলেছেন। যে কারণে এই চারজনের কারামুক্তিতেও কোনও বাধা থাকছে বলে জানান শিশির মনির।
রায়ের পর ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল সুলতানা আকতার রুবি সাংবাদিকদের বলেন, “এ রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করা হবে।”
মামলা বিত্তান্ত
বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার আমলে ২০০৪ সালের ১ এপ্রিল মধ্যরাতে চট্টগ্রামের আনোয়ারায় কর্ণফুলী নদী তীরে রাষ্ট্রায়ত্ত সার কারখানা চিটাগাং ইউরিয়া ফার্টিলাইজার লিমিটেডের (সিইউএফএল) সংরক্ষিত জেটিঘাটে দুটি মাছ ধরার ট্রলার থেকে বিপুল পরিমাণ অস্ত্র খালাস করে ট্রাকে তোলার সময় পুলিশ আটক করে।
দেশে অস্ত্র ও গোলাবারুদের সর্ববৃহৎ চালান ধরা পড়ার পর দেশব্যাপী ব্যাপক চাঞ্চল্যের সৃষ্টি হয়। পরে তদন্তে দেখা যায়, চীনের তৈরি এসব অস্ত্র ও গোলাবারুদ সমুদ্রপথে আনা হয় ভারতীয় বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগঠন ‘উলফা’র জন্য। বাংলাদেশের ভূখণ্ড ব্যবহার করে সীমান্ত পাড়ি দিয়ে ওই চালান ভারতে নিয়ে যাওয়ার কথা ছিল।
অস্ত্র উদ্ধারের পর ৩ এপ্রিল চট্টগ্রামের কর্ণফুলী থানায় ১৯৭৪ সালের বিশেষ ক্ষমতা আইনে চোরাচালানের অভিযোগে একটি এবং ১৮৭৮ সালের অস্ত্র আইনে অন্য মামলাটি দায়ের করা হয়।
২০১৪ সালের ৩০ জানুয়ারি চট্টগ্রাম মহানগর দায়রা জজ আদালত ও বিশেষ ট্রাইব্যুনাল-১ রায় দেন। বিচারিক আদালতের রায়ে তৎকালীন শিল্পমন্ত্রী নিজামী, তৎকালীন স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবরসহ ১৪ জনকে ফাঁসির আদেশ দেওয়া হয়। মৃত্যুদণ্ডের পাশাপাশি প্রত্যেক আসামিকে পাঁচ লাখ টাকা করে জরিমানা করেন বিচারিক আদালত। আর অস্ত্র আইনের ১৯(ক) ধারায় ওই ১৪ জনকে দেওয়া হয় যাবজ্জীবন কারাদণ্ড। এছাড়া ১৯(চ) ধারায় তাদের দেওয়া হয় সাত বছর সশ্রম কারাদণ্ড।