‘চোখের আলোয় দেখেছিলেম চোখের বাহিরে।
অন্তরে আজ দেখব, যখন আলোক নাহি রে।’
ইয়োনা সাব্রি এলন কখনও হয়তো রবীন্দ্র সঙ্গীত শোনেননি। তবে চোখে আলো না থাকলেও রবি ঠাকুরের এই গানের মতো মনের চোখ দিয়ে ঠিকই দেখতে পান।
দক্ষিণ সুদানের ডা. বিয়ার স্পোর্টস কমপ্লেক্সে ২২ বছর বয়সী এলন মাঠজুড়ে দাপিয়ে ফুটবল খেলছেন। চোখ বলের দিকে থাকলেও কান সজাগ। সতীর্থদের একজন তখন চিৎকার করে বললেন, “পাস দাও!”
এটি সাধারণ কোনও ফুটবল ম্যাচ নয়। মাঠে এমন একদল ফুটবলার দৌড়াচ্ছেন, যারা চোখে দেখতে পান না। কেউ আংশিক, কেউ পুরো দৃষ্টিহীন। তবু আত্মবিশ্বাসে কমতি নেই। দারুণ দক্ষতায় বল রিসিভ করছেন, প্রতিপক্ষকে হারানোর জন্য চালিয়ে যাচ্ছেন লড়াই। এরা সবাই দক্ষিণ সুদানের জুবার প্রিমিয়ার ব্লাইন্ড লিগের ফুটবলার।
ডা. বিয়ার স্পোর্টস কমপ্লেক্সে লিগের প্রস্তুতি চলছে। মাঠের কৃত্রিম ঘাস রোদের তাপে ঝলসে উঠেছে। প্রত্যেক ফুটবলার অনুশীলনে ব্যস্ত। কেউ করছেন জাম্পিং জ্যাক, কেউ পুশ-আপ। আবার কেউ লেগ লিফটে মনোযোগী। গরমে জার্সি ভিজে গেছে, তবু কারও মুখে ক্লান্তির ছাপ নেই।
২৭ বছর বয়সী সাইমন মাডল মাঠের এক পাশে দাঁড়িয়ে গভীর মনোযোগ দিয়ে ফুটবলারদের অনুশীলন দেখছেন। তিনি ব্লাইন্ড ফুটবল লিগের কোচ ও টেকনিক্যাল ডিরেক্টর। পাশপাশি ‘লাইট ফর দ্য ওয়ার্ল্ড নামের প্রতিষ্ঠানে প্রতিবন্ধীদের অধিকার ও সুযোগ নিশ্চিতে কাজ করেন।
‘লাইট ফর দ্য ওয়ার্ল্ড’ সংস্থার আরও দুই সহকর্মী সাইমন মাডলের সঙ্গে ফুটবলারদের অনুশীলনে সহায়তা করেন। দৃষ্টি না থাকায় ফুটবলারদের স্পর্শের ওপর বেশি নির্ভর করতে হয়। এতে তাদের মধ্যে সহমর্মিতা ও বন্ধুত্ব আরও গভীর হয়। তারা শুধু একই দলের সদস্য নয়, দৃষ্টিহীনতার চ্যালেঞ্জগুলোর সঙ্গেও কিভাবে লড়তে হয় সেটা শেখেন।
২০২৪ সালে তহবিল সমস্যায় ব্লাইন্ড লিগের অনুশীলন কয়েক মাস ধরে বন্ধ ছিল। নতুন করে তহবিল সংগ্রহের পর আবারও শুরু হয় অনুশীলন। অনুশীলনের এক পর্যায়ে সাইমন ফুটবলারদের বলেন, “আমি জানি কিছুদিন আমরা খেলিনি। তারপরেও আজ তোমরা সবাই খুব ভালো খেলছ। মনে হচ্ছে খুব বেশি সময় আমাদের খেলা বন্ধ থাকেনি।”
দৃষ্টিপ্রতিবন্ধীরা যেভাবে ফুটবল খেলেন
দৃষ্টিহীনদের ফুটবলের মধ্যে দেওয়া থাকে ঘুঙুরের মতো ছোট ছোট বল। পায়ের আঘাতে মাঠের মধ্যে ঝনঝনিয়ে বেজে ওঠে ফুটবল। সেই শব্দের পেছনে দৌড়াতে হয় ফুটবলারদের। কোচ আর খেলোয়াড়দের ভাই-বোনেরা গোলপোস্টে আঘাত করেন, যাতে খেলোয়াড়রা বল জালে জড়াতে পারেন। আর যখন কেউ বল নিয়ে ছুটে আসেন, তখন সুদানের ওই ফুটবলাররা চিৎকার করে বলেন “ভই” (স্প্যানিশে যার মানে আমি আসছি)। এমন জোরে চিৎকার করার অর্থ যেন কোনও দুর্ঘটনা না ঘটে।
ফুটবলারদের সমান দৃষ্টিশক্তি নিশ্চিত করতে সবার চোখে পট্টি বেঁধে দেওয়া হয়। সাইমন বলেন, এটি ফুটবলারদের শরীরের প্রতি আত্মবিশ্বাস ফিরে পেতে, ভয় ছাড়াই চলাফেরা শিখতে এবং একই পরিস্থিতিতে থাকা অন্যান্য খেলোয়াড়দের সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে তুলতে সাহায্য করে।
এলনের ফুটবলপ্রেম
তিন বছর বয়স থেকে তার চোখে সমস্যা শুরু। অনেকে তাকে বলতেন- কেউ জাদু করেছে, তাই চোখের দৃষ্টি কমে যাচ্ছিল। দক্ষিণ সুদানে স্বাস্থ্যসেবা বিশেষজ্ঞের অভাব এবং অর্থ সঙ্কটের কারণে এলন কখনও সঠিক চিকিৎসা পাননি। ফলে ১২ বছর বয়সে তিনি সম্পূর্ণ দৃষ্টিহীন হয়ে পড়েন।
শিশুকাল থেকেই তিনি ফুটবল ভালো খেলতেন। তবে দৃষ্টিহীন হওয়ার পর প্রথম দুই বছর তিনি বাড়িতে একরকম বন্দী হয়ে ছিলেন। তিনি বলেন, “আমি হতাশ ও নিরাশ হয়ে পড়েছিলাম। স্কুলে যেতে পারতাম না। পুরোপুরি আশা হারিয়ে ফেলেছিলাম। ফুটবল না খেলা ছিল সব থেকে খারাপ দিক।”
এলনের মা সরকারি নার্স। জুবা শহরে দৃষ্টিহীনদের জন্য প্রতিষ্ঠিত রাজাপ সেন্টারের কথা শুনেছিলেন তিনি। সেখানেই ছেলেকে ভর্তি করেন।
এলন প্রথমে এই প্রতিষ্ঠানের কথা শুনে বেশ অবাকই হয়েছিলেন, “আমি মায়ের কাছে প্রশ্ন করেছিলাম, এমন একটি স্কুল কীভাবে সম্ভব? বিশ্বাস করতাম না যে আমার মতো আরও মানুষ পাব সেখানে।” তখন দৃষ্টি ছাড়াই চলাফেরা করতে শেখা ছিল তার জন্য বড় চ্যালেঞ্জ। মায়ের সঙ্গে প্রতিদিন রাজাপে যেতেন। ধীরে ধীরে বাঁশের লাঠি দিয়ে নিজে নিজে হাঁটতে শিখে যান।
কিছুদিনের মধ্যেই ব্রেইল শিখে ফেলেন এলন। ২০১৯ সালে একটি সাধারণ স্কুলে ভর্তি হন। আল জাজিরাকে তিনি বলেন, “প্রতিবন্ধী হওয়া মানেই যে অক্ষম না, সেটা আমি সেখানকার শিক্ষক ও ছাত্রদের বোঝাতে পেরেছিলাম। ওদের মনের এমন ভাবনটা বদলে ফেলতে পেরেছিলাম।”
স্বপ্নপূরণ
দৃষ্টিপ্রতিবন্ধীদের নিয়ে ফুটবল আয়োজনের স্বপ্ন দেখতেন ব্লাইন্ড ফুটবল লিগের কোচ সাইমন। তার প্রথম ফুটবল ম্যাচ ছিল জুবার মহাদ শরণার্থী শিবিরে। সেখানে দক্ষিণ সুদানের অভ্যন্তরীণভাবে বাস্তুহারা প্রায় ২২ লাখ মানুষের বাস ছিল।
প্রথম ম্যাচ খেলে সাইমন বুঝতে পারেন, ফুটবল শুধু মানুষকে একত্রিত করার একটি উপায় নয়, এটি প্রতিবন্ধীদের বিরুদ্ধে বিদ্যমান সামাজিক কুসংস্কার ও বৈষম্যের বিরুদ্ধে লড়াইয়েরও একটি হাতিয়ার হতে পারে। লাইট ফর দ্য ওয়ার্ল্ডের পরিসংখ্যান বলছে, দক্ষিণ সুদানের মোট জনসংখ্যা ১ কোটি ২০ লাখ, এর মধ্যে প্রতিবন্ধীর সংখ্যা প্রায় ১২ লাখ।
সব কষ্টের মধ্যেও করোনার সময় ২০২০ সালে ব্লাইন্ড ফুটবল আয়োজনের উদ্যোগ নিয়েছিলেন সাইমন। মাত্র দুজন ফুটবলার নিয়ে তারা একটি লিগ গঠনের স্বপ্ন দেখেছিল। সাইমন রাজাপ ব্লাইন্ড স্কুলে সম্ভাব্য ফুটবলার খুঁজছিলেন। এভাবেই এলনের মতো ফুটবলাররা যোগ দেন। বর্তমানে ওই লিগে প্রতিটি দলে চারজন ফুটবলার রয়েছেন।
ব্লাইন্ড ফুটবল প্রিমিয়ার লিগ সাইমন ও অন্যদের জন্য একটি স্বপ্নপূরণ। তারা ভবিষ্যতে প্যারা অলিম্পিকসে অংশগ্রহণের আশা করছেন। এলনের আশা, তিনি উগান্ডা বা মিশরের মতো দেশে খেলতে যেতে পারবেন।
দৃষ্টি হারিয়ে এলন একসময় হতাশায় ডুবে যেতে বসেছিলেন। অথচ সেই এলনই এখন ব্লাইন্ড ফুটবল লিগে খুঁজে পান জীবনের যত আনন্দ।