ফিলিস্তিনের গাজায় নারী, শিশুসহ ৪৬ হাজারের বেশি মানুষকে নির্বিচারে হত্যা করে আপাতত থামতে রাজি হয়েছে ইসরায়েল।
কাতার ও মিসরের মধ্যস্থতায় এবং যুক্তরাষ্ট্রের চাপে গতকাল বুধবার যুদ্ধবিরতি চুক্তি হয়েছে দেশটির সঙ্গে হামাসের।
১৫ মাস আগে শুরু হওয়া যুদ্ধে কেবল হাজার হাজার নিরপরাধ মানুষই নিহত হয়নি, বাস্তুচ্যুত হয় ১৯ লাখ ফিলিস্তিনি। আর অনাহারে কতজন মরেছে, তার হিসাব নেই।
যুদ্ধবিরতি চুক্তির বিষয়ে কাতারের প্রধানমন্ত্রী শেখ মোহাম্মদ বিন আব্দুলরহমান বিন জসিম আল থানি বলেছেন, আগামী রবিবার থেকে এটি কার্যকর হতে যাচ্ছে। যুদ্ধবিরতি বাস্তবায়নের পদক্ষেপ নিয়ে কাজ করছে হামাস ও ইসরায়েল।
আল জাজিরা জানিয়েছে, যুদ্ধবিরতি চুক্তির শর্ততে গাজায় হামাসের হাতে বন্দি ইসরায়েলি এবং ইসরায়েলে বন্দি ফিলিস্তিনিদের ছেড়ে দেওয়ার কথা বলা হয়েছে। এছাড়া চুক্তিতে গাজার ঘরবাড়ি ছেড়ে অন্যত্র আশ্রয় নেওয়া ফিলিস্তিনিদের ঘরে ফেরার অনুমতি দেওয়া হয়েছে।
তবে ২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর থেকে একদিন আগপর্যন্ত ইসরায়েল গাজায় যেহারে বোমাবর্ষণ করেছে, তাতে ফিলিস্তিনিদের ঘর বলতে আর কিছু নেই। সবই ধ্বংস হয়ে গেছে। মৃতপুরীতে পরিণত হয়েছে এই উপত্যকা।
আল জাজিরার প্রতিবেদনে বলা হয়, যুদ্ধবিরতির শর্তগুলো একসঙ্গে নয়, পর্যায়ক্রমে বাস্তবায়ন করা হবে। বুধবার তিনটি পর্যায়ের কথা বলেছে সংশ্লিষ্ট দেশগুলো।
এই তিন পর্যায়ে কী কী শর্ত রাখা হয়েছে, তা জেনে নেওয়া যাক।
প্রথম পর্যায়ে কী আছে
এই ধাপের স্থায়িত্বকাল ছয় সপ্তাহ। এসময়ে খুব অল্প সংখ্যক বন্দিবিনিময় করবে হামাস ও ইসরায়েল। গাজা থেকে ইসরায়েল সেনা প্রত্যাহারও করে নেবে অল্প। পাশাপাশি যুদ্ধে সবহারা গাজাবাসীদের আরও বড় পরিসরে সহায়তা করার সুযোগ পাবে আন্তর্জাতিক ত্রাণ সংস্থাগুলো।
আল জাজিরার প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০২৩ সালে ইসরায়েলের দক্ষিণাঞ্চলে হামলা চালিয়ে হামাস যে আড়াইশর মতো ইসরায়েলিকে গাজায় এনে বন্দি করে রেখেছিল, তাদের মধ্যে ৩৩ জনকে যুদ্ধবিরতি চুক্তির প্রথম পর্যায়ে মুক্তি দেওয়া হবে। এসব বন্দিদের মধ্যে নারী, শিশুর পাশাপাশি পঞ্চাশোর্ধ্ব পুরুষ আছে।
বিনিময়ে যুদ্ধ শুরুর পর ইসরায়েলের হাতে বন্দি হওয়া প্রায় এক হাজার ফিলিস্তিনি প্রথম পর্যায়ে ছাড়া পাবে। এদের মধ্যে ইসরায়েলের আদালতে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড পাওয়া বন্দিও রয়েছে।
বন্দি বিনিময়ের পাশাপাশি গাজার জনবহুল এলাকা (যেখানে কমপক্ষে এক হাজার মানুষের বাস) থেকে গাজা-ইসরায়েল সীমান্তের ভেতরকার ৭০০ মিটার এলাকায় থাকা নিজেদের সেনা সরিয়ে নেবে জায়নবাদী রাষ্ট্রটি।
এছাড়া চুক্তির প্রথম পর্যায় মেনে গাজার দক্ষিণে অবস্থান করা বাস্তুচ্যুত বেসামরিক ফিলিস্তিনিদের উপত্যকার অবরুদ্ধ উত্তরাঞ্চলে ফিরতে দেবে ইসরায়েল। দুর্ভিক্ষপীড়িত ওই অঞ্চলে দিনে সর্বোচ্চ ৬০০টি ত্রাণবাহী ট্রাক এসময় প্রবেশ করতে দেওয়া হবে।
যুদ্ধে আহত ফিলিস্তিনিদের চিকিৎসার জন্য গাজা থেকে অন্যত্র যাওয়ারও অনুমতি দেবে ইসরায়েল। চুক্তির প্রথম পর্যায়ের বাস্তবায়ন শুরু হওয়ার পর মিসরের সঙ্গে যুক্ত রাফাহ ক্রসিং সাত দিনের জন্য খোলা রাখা হবে।
এছাড়া গাজা ও মিসরের সীমান্ত এলাকা ফিলাদেলফি করিডর থেকে সেনা উপস্থিতি কমিয়ে নেবে ইসরায়েল। চুক্তি কার্যকরের ৫০ দিনের মধ্যে ওই এলাকায় আর কোনও সেনা না রাখার বিষয়েও রাজি হয় দেশটি।
প্রথম পর্যায়ের পর কী হবে
আল জাজিরা জানিয়েছে, চুক্তির দ্বিতীয় ও তৃতীয় ধাপ সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা প্রথম পর্যায়ের সময়ই করবে সংশ্লিষ্টরা।
যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন জানান, চুক্তির প্রথম পর্যায়ের ছয় সপ্তাহ অতিক্রান্ত হওয়ার পর দ্বিতীয় ও তৃতীয় পর্যায় নিয়ে আলোচনা যদি শেষ না হয়, তাহলেও যুদ্ধবিরতি অব্যাহত থাকবে।
ইসরায়েল চাইছে না, চুক্তির প্রথম পর্যায় শেষ হওয়ার পর গাজায় কোনও ধরনের হামলা তারা ফের শুরু করবে না-লিখিতভাবে এমন আশ্বাস দিতে।
তবে মিসরের এক সূত্রের বরাতে বার্তাসংস্থা এপি জানিয়েছে, যুদ্ধবিরতি চুক্তি নিয়ে যে তিনটি দেশ মধ্যস্থতাকারীর ভূমিকা পালন করছে, সেই কাতার, মিসর ও যুক্তরাষ্ট্র হামাসকে এ বিষয়ে মৌখিকভাবে আশ্বস্ত করেছে।
দেশ তিনটি বলেছে, প্রথম পর্যায়ের ছয় সপ্তাহ অতিবাহিত হওয়ার পর দ্বিতীয় ও তৃতীয় পর্যায় যাতে বাস্তবায়ন করা হয়, সে বিষয়ে তারা ইসরায়েলকে চুক্তি করতে চাপ দেবে।
দ্বিতীয় পর্যায়ে কী পরিকল্পনা করা হচ্ছে
সব ঠিকঠাক থাকলে এই পর্যায়ে বাকি সব ইসরায়েলি বন্দিকে ছেড়ে দেবে হামাস, যাদের বেশিরভাগই পুরুষ সেনা। বিনিময়ে ইসরায়েলের কারাগার থেকে আরও ফিলিস্তিনিকে মুক্ত করবে দেশটি।
এ পর্যায়ে গাজা থেকে সব সেনা সরিয়ে নেওয়ার কাজও শুরু করবে ইসরায়েল।
তবে দ্বিতীয় পর্যায়ের এসব শর্ত মানতে এখন পর্যন্ত রাজি নন ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর মন্ত্রিসভার কট্টর ডানপন্থি সদস্যরা।
স্পষ্ট নয় তৃতীয় পর্যায়
যুদ্ধবিরতি চুক্তির তৃতীয় পর্যায় সম্পর্কে বিস্তারিত জানা যায়নি। আল জাজিরা কেবল জানতে পেরেছে, দ্বিতীয় পর্যায়ের শর্ত মানা হলে পরের পর্যায়ে মৃত বন্দিদের মরদেহ হস্তান্তরের বিনিময়ে আন্তর্জাতিক তত্ত্বাবধানে তিন থেকে পাঁচ বছরের গাজা পুনর্গঠন পরিকল্পনায় হাত দেওয়া হবে।
গাজা চালাবে কে
ইসরায়েল-হামাসের যুদ্ধবিরতির পর গাজা কার অধীনে পরিচালিত হবে, এ নিয়ে এখন পর্যন্ত কোনও চুক্তি হয়নি।
ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষকে (পিএ) সংস্কার করে তাদের হাতে গাজা তুলে দিতে চাপ দিচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র।
যুদ্ধ শুরুর আগে গাজা পরিচালনার দায়িত্বে ছিল হামাস। তাদের নেতা ইসমাইল হানিয়ে ২০০৭-২০১৭ সাল পর্যন্ত হামাস প্রশাসনের প্রধান ছিলেন। ২০১৭ সালের ফেব্রুয়ারিতে গাজায় হানিয়ের স্থলাভিষিক্ত হন ইয়াহিয়া সিনওয়ার।
১৫ মাস ধরে চলা যুদ্ধে শীর্ষস্থানীয় এই দুই নেতাকেই হারায় হামাস।
গত জুলাইয়ে তেহরানে ইসমাইল হানিয়েকে হত্যা করে ইসরায়েল। তার মৃত্যুর পর হামাসের রাজনৈতিক শাখার প্রধান হিসেবে নিয়োগ পাওয়া ইয়াহিয়া সিনওয়ারকেও গত অক্টোবরে হত্যা করে দেশটি।
সিনওয়ারকে ২০২৩ সালে ইসরায়েলের দক্ষিণাঞ্চলে হামাসের হামলার মাস্টারমাইন্ড হিসেবে দেখা হয়।
শীর্ষ এই দুই নেতা হারিয়ে ভেতরে ভেতরে দুর্বল হয়ে পড়ে হামাস। এ কারণে কাতারে যুদ্ধবিরতি চুক্তি সংক্রান্ত আলোচনার শুরুর দিকে গাজা থেকে সব ইসরায়েলি সেনা একযোগে প্রত্যাহারের শর্ত দিলেও এবার সেই শর্ত থেকে সরে আসে তারা।
গাজার আগামী শাসনব্যবস্থা নিয়ে গত মঙ্গলবার ওয়াশিংটনভিত্তিক গবেষণা সংস্থা আটলান্টিক কাউন্সিলে যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিঙ্কেন বলেন, “যুদ্ধোত্তর পুনর্গঠন ও সুশাসনের লক্ষ্যে ‘আন্তর্জাতিক অংশীদারদের’ সঙ্গে নিয়ে গাজা শাসনের দায়িত্ব ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষ (পিএ) নেবে।
“আন্তর্জাতিক অংশীদারদের মধ্যে আরব দেশগুলো গাজায় সেনা পাঠিয়ে সেখানকার নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পারে।”
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, গাজা ঘিরে যুক্তরাষ্ট্রের পরিকল্পনা সফল করতে হলে আরব দেশ বিশেষত সৌদি আরবের সহযোগিতা লাগবে তাদের।
কিন্তু রিয়াদের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, ফিলিস্তিনি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পথ সুগম করা হলেই কেবল যুক্তরাষ্ট্রের পরিকল্পনাকে তারা সমর্থন করবে।