অভ্যুত্থানের আকাঙ্ক্ষা পূরণে কাজ চালিয়ে যেতে রাজনৈতিক দলগুলোর কাছে সাহস চাইলেন অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস।
তিনি বলেছেন, “আপনারা দোয়া করবেন আমি যতদিন আছি, এই একতা নিয়েই থাকব। কাজেই সেই পথেই আমাদের চলতে হবে। যখন আপনাদের সঙ্গে বসি, তখন সেই সাহসটা দেন।”
জুলাই অভ্যুত্থানের ঘোষণাপত্র নিয়ে বৃহস্পতিবার রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে বৈঠকে একথা বলেন ড. ইউনূস।
ফরেইন সার্ভিস একাডেমিতে এই বৈঠকে বিএনপিসহ অন্তত আটটি রাজনৈতিক দলের নেতারা অংশ নেন। নির্বাচন কমিশনে নিবন্ধিত ৪৯টি দলের মধ্যে আমন্ত্রণ পেয়েও সর্বদলীয় এই বৈঠকে যায়নি বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি-সিপিবি।
বৈঠকে অংশ নেওয়া রাজনৈতিক দলগুলোর নেতাদের উদ্দেশে ড. ইউনূস বলেন, “আপনাদের সঙ্গে দেখা হলে, বসতে পারলে খুব ভালো লাগে। মনে সাহস পাই।
“কারণটা পরিষ্কার। এ সরকারের জন্ম হয়েছে ঐক্যের মাঝখানে, ঐক্যের দ্বারা এটা সৃষ্টি। যখন আমরা নিজেরা নিজেরা কাজ করি, তখন দেখি একা পড়ে গেছি, আশেপাশে কেউ নেই আপনারা। তখন একটু দুর্বল মনে করি। যখন আবার সবাই একসঙ্গে কাজ করি, তখন মনের মধ্যে সাহস বাড়ে, একতাবদ্ধভাবে আছি। একতাতেই আমাদের জন্ম। একতাতেই আমাদের শক্তি।”
অভ্যুত্থানের আকাঙ্ক্ষা পূরণে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠনের দিকটি দেখিয়ে প্রধান উপদেষ্টা বলেন, রাজনৈতিক দলগুলোর সমর্থন পেলে সরকার উদ্যম পায়।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতৃত্বে অভ্যুত্থানে গত আগস্টে পতন ঘটে আওয়ামী লীগের দেড় দশকের শাসনের। তখন অভ্যুত্থানের কোনও ঘোষণাপত্র দেওয়া হয়নি।
পাঁচ মাস পর বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন গত ২৯ ডিসেম্বর সংবাদ সম্মেলন ডেকে ‘জুলাই বিপ্লবের ঘোষণাপত্র’ উপস্থাপনে ৩১ ডিসেম্বর শহীদ মিনারে সমাবেশ ডেকেছিল।
তবে না নিয়ে রাজনৈতিক অঙ্গনে প্রতিক্রিয়ার পর অন্তর্বর্তী সরকারের পক্ষ থেকে জানানো হয়, তারাই জুলাই অভ্যুত্থানের ঘোষণাপত্র তৈরি করবে।
ড. ইউনূস বলেন, “মাঝখানে একদিন ছাত্ররা এসে বলল, তারা একটা ঘোষণপত্র দেবে। আমাকেও সেখানে থাকতে হবে। বুঝতে চাইলাম কী ঘোষণাপত্র দিচ্ছে, বলল। আমি বললাম, এটা হবে না৷ আমার চাওয়াটা হবে না, তোমাদের চাওয়াটাও হবে না।
“তোমরা যদি ৫ আগস্টে ফিরে যেতে চাও, সেদিনের পরিপ্রেক্ষিতে যা হয়েছিল, সেটাকে রিক্রিয়েট করতে হবে। একা এটা করা যাবে না। ওই দিনের পুরো অনুভূতিটাই ছিল একতার অনুভূতি। কেউ বলে নাই যে তুমি অমুক, তুমি অমুক। কাজেই তোমরা করতে চাইলে সবাইকে নিয়েই করতে হবে। যে একতা দিয়ে তোমরা ৫ আগস্ট সৃষ্টি করেছিলে, নইলে সেটার অবমাননা হবে।”
এরপর অভ্যুত্থানের ছাত্রনেতাদের মানিয়ে ঐকমত্যের ভিত্তিতে ঘোষণাপত্র প্রণয়নের উদ্যোগ নেওয়া হয় বলে জানান তিনি।
“তারা আমার কথায় খুব খুশি হয়নি। কিন্তু ক্রমে তারা বুঝল, ৫ আগস্ট রিক্রিয়েট করতে হলে এইভাবে করতে হবে। সেই কথা থেকে এ আলাপ শুরু। আমরা ঐক্যবদ্ধভাবে করতে না পারলে উদ্দেশ্যে ব্যাহত হবে। ঐক্যের মাধ্যমে করলে সবার মনে সাহস আসবে। সবাই ভাববে আমরা তো জেগে আছি এখনও। আমরা ভোঁতা হয়ে যাইনি।”
ঘোষণাপত্রের গুরুত্ব তুলে ধরে ড. ইউনূস বলেন, “এটা নিয়ে সর্বসম্মতিক্রমে যদি দেশের সামনে আসতে পারি, তা দেশের জন্য ভালো। আন্তর্জাতিকভাবেও ভালো। সবাই দেখবে যে এ জাতির মধ্যে বহু ঠোকাঠুকি হয়েছে, কিন্তু নড়ে না। স্থির হয়ে আছে, শক্ত হয়ে আছে।”
বৈঠকে বিএনপির পক্ষ থেকে যোগ দেন দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমেদ। জামায়াতে ইসলামীর প্রতিনিধিত্ব করেন সেক্রেটারি জেনারেল মিয়া গোলাম পরওয়ার ও সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল হামিদুর রহমান আযাদ।
ইসলামী আন্দোলনের জ্যেষ্ঠ যুগ্ম মহাসচিব আতাউর রহমান, যুগ্ম মহাসচিব আশরাফুল আলম অংশ নেন বৈঠকে। খেলাফত মজলিসের প্রতিনিধিত্ব করেন দলটির মহাসচিব আহমেদ আব্দুল কাদের।
গণসংহতি আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়কারী জোনায়েদ সাকি, গণঅধিকার পরিষদের আহ্বায়ক নূরুল হক নূর বৈঠকে ছিলেন। বাসদের (মার্কসবাদী) সমন্বয়ক মাসুদ রানাও যোগ দেন বৈঠকে।
বৈঠকে আরও অংশ নেন এবি পার্টির সাধারণ সম্পাদক আসাদুজ্জামান ফুয়াদ, জেএসডির সাধারণ সম্পাদক শহীদ উদ্দিন মাহমুদ স্বপন, রাষ্ট্র সংস্কার আন্দোলনের হাসনাত কাইয়ুম।
জাতীয় নাগরিক কমিটির আহ্বায়ক নাসির উদ্দিন পাটোয়ারী, সদস্য সচিব আখতার হুসেইন, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সদস্য সচিব আরিফ সোহেল, মুখ্য সংগঠক আব্দুল হান্নান মাসউদ বৈঠকে ছিলেন।
ড. ইউনূসের সভাপতিত্বে এই বৈঠকে উপদেষ্টাদের মধ্যে ছিলেন আসিফ নজরুল, আদিলুর রহমান খান, মাহফুজ আলম, নাহিদ ইসলাম ও আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়া।
আমন্ত্রণ পেয়েও এই বৈঠকে না যাওয়ার বিষয়ে সিপিবির সাধারণ সম্পাদক রুহিন হোসেন প্রিন্স সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, দেরিতে জানানো হওয়ায় তারা বৈঠকে অংশ নিতে অপারগতা জানিয়েছেন।
“আজকে দেড়টার সময় আমরা খবর পেয়েছি। মাহফুজ আলম হোয়াটস অ্যাপে মেসেজে জানিয়েছে। ঘোষণাপত্রের ড্রাফটা পাঠিয়েছে। কিন্তু এত কমসময়ে কীভাবে পর্যালোচনা দেওয়া যায়। আমাদের দলের ভিতরে আলোচনা বাদে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে মতামত দেওয়া যায় না। তাই আমরা আজকে যাচ্ছি না।”
প্রিন্স আরও বলেন, “যদি আলোচনা করে মতামত দেওয়ার সুযোগ থাকে আমরা নিশ্চয়ই দেব। আমাদের দলের ভেতরে বাম জোটের মধ্যে আলোচনা করে তো মতামত জানাব। আজকের সভার ফলাফল দেখে আমরা সিদ্ধান্ত নেব।”
বামজোটের বর্তমান সমন্বয়ক বাসদ মার্ক্সবাদীর সমন্বয়ক মাসুদ রানার সভায় অংশগ্রহণ প্রসঙ্গে সিপিবি সভাপতি বলেন, “সবাইকে দল হিসেবে আমন্ত্রণ জানিয়েছে। ফলে, সে সেখানে তার দলের প্রতিনিধি হিসাবে গিয়েছেন। জোট হিসাবে না।”