ভারতের আদানি গ্রুপের শেয়ার জালিয়াতির অভিযোগ তোলা নিউ ইয়র্কভিত্তিক আর্থিক প্রতিষ্ঠান সংক্রান্ত পরামর্শক সংস্থা হিনডেনবার্গ রিসার্চ বন্ধ হয়ে যাচ্ছে।
যুক্তরাষ্ট্রের নবনির্বাচিত প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের শপথের ঠিক আগে বুধবার লক্ষ্য পূরণ হওয়ার দাবি জানিয়ে কোম্পানিটি বন্ধ করে দেওয়ার এই ঘোষণা দিয়েছেন প্রতিষ্ঠাতা নাথান অ্যান্ডারসন। এ খবরে বৃহস্পতিবার ভারতের শেয়ারবাজারে আদানি গ্রুপের শেয়ার দর ৯ শতাংশ বেড়েছে।
২০২৩ সালের জানুয়ারি মাসে হিনডেনবার্গ রিসার্চ শেয়ার জালিয়াতির অভিযোগ তোলার পর বড় ধরনের চাপে পড়েছিল আদানি গ্রুপ। বিষয়টি নিয়ে ভারতে তখন রাজনৈতিক বিতর্কও উঠেছিল।
আদানি গ্রুপ শেয়ার জালিয়াতির ওই অভিযোগ অস্বীকার করলেও তাদের একাধিক কোম্পানির শেয়ার দর তলানিতে চলে গিয়েছিল। সর্বশেষ গত নভেম্বর মাসে ঘুষ ও প্রতারণার অভিযোগে যুক্তরাষ্ট্রে মামলা ও প্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি হয় আদানির বিরুদ্ধে। এ ঘটনার পরও আদানি গ্রুপের বিভিন্ন কোম্পানির শেয়ার দর কমতে শুরু করেছিল।
আদানি গ্রুপের চেয়ারম্যান গৌতম আদানি ও তার কয়েকজন সহযোগীর বিরুদ্ধে তখন নিউ ইয়র্কের ফেডারেল আদালতের কৌঁসুলিরা বিদ্যুৎ প্রকল্পের কাজ পেতে ভারতের সরকারি কর্মকর্তাদের ঘুষ দেওয়া এবং এ বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রে বিনিয়োগকারীদের কাছে তথ্য গোপনের অভিযোগ আনেন।
সে সময় কেনিয়া আদানির সঙ্গে করা চুক্তিও বাতিল করেছে। অস্ট্রেলিয়া আদানির বিরুদ্ধে মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ আনে। এসব ঘটনায় বেশ চাপেই পড়েন ভারতের আদানি শিল্পগোষ্ঠীর কর্ণধার ও বিশ্বের অন্যতম ধনী ব্যক্তি গৌতম আদানি।
যুক্তরাষ্ট্রের আদালতের এই পদক্ষেপ ৬২ বছর বয়সী ধনকুবের আদানির জন্য নতুন এক ধাক্কা হিসেবে মনে করা হয়, যার ব্যবসার সাম্রাজ্য ছড়িয়ে আছে বন্দর ব্যবস্থাপনা থেকে নবায়নযোগ্য জ্বালানি পর্যন্ত। বিশ্বজুড়ে তার ১৬৯ বিলিয়ন ডলারের সাম্রাজ্য মুখ থুবড়ে পড়তে শুরু করে।
যেখানে মাত্র কয়েক সপ্তাহ আগে যুক্তরাষ্ট্রের নবনির্বাচিত প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের বিজয় উদযাপন করে দেশটির জ্বালানি ও অবকাঠামো প্রকল্পে ১০ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগের পরিকল্পনা ঘোষণা করেছিলেন আদানি।
বিবিসি জানিয়েছে, যাত্রা শুরুর আট বছরের মাথায় বুধবার হিনডেনবার্গ রিসার্চ বন্ধের ঘোষণা দিয়েছেন কোম্পানিটির প্রতিষ্ঠাতা নাথান অ্যান্ডারসন। এ সিদ্ধান্ত নেওয়ার বিষয়ে সুনির্দিষ্ট কোনও কারণ জানাননি তিনি।
ব্যক্তিগত নোটে অভিষ্যতে বন্ধু-বান্ধব ও পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে আরও বেশি সময় কাটানোর আকাঙ্ক্ষা প্রকাশ করেছেন নাথান অ্যান্ডারসন।
অ্যান্ডারসন মনে করেন, কোম্পানি নিজের লক্ষ্য পূরণ করতে পেরেছে, এখন আরও এগিয়ে যাওয়ার সময়। বেশ কয়েক মাস ধরেই হিনডেনবার্গ বন্ধের কাজ চলছে দাবি করে তিনি বলেছেন, বেশ কিছু তদন্ত বাকি ছিল, সেগুলো শেষ করেই কোম্পানি বন্ধ করে দেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়েছে।
হিনডেনবার্গ রিসার্চ বন্ধের সিদ্ধান্তের পেছনে কোনও হুমকি বা স্বাস্থ্য সংক্রান্ত সমস্যা নেই বলেও স্পষ্ট করেছেন অ্যান্ডারসন। তিনি দাবি করেছেন, হিনডেনবার্গ রিসার্চের কাজ করতে গিয়ে জীবনে অনেক কিছু থেকে বঞ্চিত থেকেছেন। কাছের মানুষদের সঙ্গে সময় কাটাতে পারেননি। সবসময়ই তিনি কাজে মন দিয়েছেন। এবার তিনি হিনডেনবার্গকে জীবনের মধ্যমণি করে রাখবেন না। এটা তার জীবনের এক অধ্যায় মাত্র।
২০২৩ সালের ওই প্রতিবেদনে হিনডেনবার্গ রিসার্চ দাবি করেছিল কারচুপি করে নিজের কোম্পানিগুলোর শেয়ার দর বাড়িয়েছেন শিল্পপতি গৌতম আদানি। বিদেশে বেনামি সংস্থা খুলে নিজেদের শেয়ার নিজেরাই কিনে নিত আদানি গ্রুপ। এভাবে বাজারে ভুয়া চাহিদা সৃষ্টি করে শেয়ারের দাম চড়ানো হতো।
এসব অভিযোগ প্রথম থেকেই অস্বীকার করে এসেছে আদানি গ্রুপ। তাদের পাল্টা অভিযোগ ছিল, যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক কোম্পানিটি ‘মিথ্যা’ প্রতিবেদনের মাধ্যমে আদানি গ্রুপকে অপদস্থ করার চেষ্টা করছে।
২০১৭ সালে প্রতিষ্ঠিত হিনডেনবার্গ রিসার্চ নিজেদের ‘ফরেনসিক আর্থিক গবেষণাপ্রতিষ্ঠান’ হিসেবে পরিচয় দেয়। ওয়েবসাইটে হিনডেনবার্গ ঘোষণা করেছে, তারা ‘মানবসৃষ্ট দুর্যোগ’ সম্পর্কে খোঁজখবর রাখে। তারা বিশ্লেষণ করে বিনিয়োগ, ঋণ ও শেয়ারের মতো বিষয়গুলো। প্রতিষ্ঠার পর একের পর এক কর্পোরেট প্রতিষ্ঠানের আর্থিক জালিয়াতির অভিযোগ সামনে এনেহইহই ফেলে দেয় হিনডেনবার্গ রিসার্চ।
ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির ঘনিষ্ট মিত্র আদানি এক সময় কিছু সময়ের জন্য বিশ্বের দ্বিতীয় ধনী ব্যক্তি ছিলেন। সমালোচকরা দীর্ঘ দিন ধরে মোদির কাছ থেকে অনুচিতভাবে লাভবান হওয়ার জন্য আদানিকে দোষারোপ করে আসছিলেন। যুক্তরাষ্ট্রে মামলা ও গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারির পর ভারতের বিরোধী দলীয় নেতা রাহুল গান্ধীও তাকে গ্রেপ্তারের দাবি জানিন।
ভারতের অর্থনীতি গভীরভাবে আদানি গ্রুপের সঙ্গে সম্পৃক্ত। আদানি দেশটির শীর্ষস্থানীয় অবকাঠামো ব্যবসায়ী। তিনি ১৩টি বন্দর (৩০ শতাংশ পণ্য চলাচল), ৭টি বিমানবন্দর (২৩ শতাংশ যাত্রী চলাচল) এবং ভারতের দ্বিতীয় বৃহত্তম সিমেন্ট ব্যবসা (মোট বাজারের ২০ শতাংশ) পরিচালনা করেন।
ছয়টি কয়লাচালিত বিদ্যুৎ প্লান্টসহ আদানি ভারতের সর্ববৃহৎ বেসরকারি বিদ্যুৎ উৎপাদক। একই সঙ্গে তিনি গ্রিন হাইড্রোজেনে ৫০ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগের প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। পাশাপাশি ৮ হাজার কিলোমিটার দীর্ঘ প্রাকৃতিক গ্যাস পাইপলাইন পরিচালনা করছেন।
আদানি ভারতের দীর্ঘতম এক্সপ্রেসওয়ে নির্মাণ করছেন এবং দেশের বৃহত্তম বস্তিরও পুনর্নির্মাণ করছেন। তিনি ৪৫ হাজারেরও বেশি মানুষকে কর্মসংস্থান দিয়েছেন। কোটি কোটি মানুষের জীবনে প্রভাব ফেলছে আদানি গ্রুপ।
ইন্দোনেশিয়া ও অস্ট্রেলিয়ায় তার কয়লা খনিসহ আফ্রিকায় বিশাল অবকাঠামো প্রকল্পও রয়েছে।
যুক্তরাষ্ট্র-ভারত প্রত্যর্পণ চুক্তি থাকলেও আদানিকে গ্রেপ্তার করে তাদের হাতে তুলে দেওয়া হতে পারে কিনা তা স্পষ্ট নয়। কারণ এটি নতুন প্রশাসনের ওপর নির্ভর করবে যে তারা এসব মামলা এগিয়ে নেবে কিনা।
আদানি পাওয়ারের সঙ্গে চুক্তি, অভিযোগ খতিয়ে দেখছে অন্তর্বর্তী সরকার
বিদ্যুৎ আমদানির জন্য গৌতম আদানির মালিকানাধীন কোম্পানি আদানি পাওয়ারের সঙ্গে চুক্তি আছে বাংলাদেশেরও। ভারতের ঝাড়খণ্ডের গড্ডায় নির্মিত আদানি গ্রুপের বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে ১ হাজার ৪৯৬ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ কেনার জন্য ২৫ বছরের চুক্তিটি করে বিগত আওয়ামী লীগ সরকার।
সর্বোচ্চ গোপনীয়তা অনুসরণ করে করা এই চুক্তির আওতায় আদানি গ্রুপের কোম্পানির কাছ থেকে বাজারদরের চেয়ে বেশি দামে বিদ্যুৎ কেনার অভিযোগ রয়েছে। গত ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার আন্দোলনে বাংলাদেশের রাষ্ট্রক্ষমতার পট পরিবর্তনের পর দায়িত্ব নেওয়া অন্তর্বর্তী সরকার এই অভিযোগ খতিয়ে দেখছে।