মিয়ানমারে ২০২১ সালের ১ ফেব্রুয়ারি সামরিক অভ্যুত্থানের পর শান্তিপূর্ণ প্রতিবাদ সশস্ত্র সংগ্রামে পরিণত হয়। সেই লড়াই-সংঘাত প্রবেশ করেছে চতুর্থ বছরে। এই সময়ের মধ্যে মিয়ানমারের অনেক কিছু পাল্টে গেছে। বিভিন্ন সশস্ত্র জাতিগোষ্ঠী ও প্রতিরোধ বাহিনীর কাছে ভূখণ্ডের নিয়ন্ত্রণ হারাচ্ছে সামরিক জান্তার স্টেট অ্যাডমিনিস্ট্রেশন কাউন্সিল (এসএসি)।
দেশটির বেসামরিক জাতীয় ঐক্যের সরকার (এনইউজি) সম্প্রতি একটি সামরিক অগ্রগতি প্রতিবেদনে জানিয়েছে, ২০২৪ সালের শেষে তাদের পিপলস ডিফেন্স ফোর্স (পিডিএফ) এবং মিত্র জাতিগত বিপ্লবী সংগঠনগুলোর জোট (ইআরও) মিয়ানমারের অর্ধেকেরও বেশি এলাকায় কার্যকর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করেছে।
এনইউজি দাবি করেছে, দেশের ৪৪ শতাংশ টাউনশিপ সম্পূর্ণ তাদের নিয়ন্ত্রণে এবং ২৪ শতাংশ এলাকা প্রতিরোধ বাহিনীর প্রভাবের আওতায় বা তীব্র লড়াইয়ের মধ্যে রয়েছে। অর্থাৎ সামরিক জান্তার নিয়ন্ত্রণে এখন দেশটির এক তৃতীয়াংশেরও কম এলাকা।
এনইউজি যেসব এলাকা নিয়ন্ত্রণের কথা বলছে, তার অধিকাংশই মূলত ইআরওর হাতে। জাতিগত গোষ্ঠীগুলো উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি অর্জন করলেও তারা এখনও নিজেদের জাতিগত স্বার্থ, বিশেষ করে স্বায়ত্তশাসন পাওয়ার দিকেই মনোযোগী।
তবে বড় প্রশ্ন হলো নতুন প্রতিরোধ গোষ্ঠীগুলোর ওপর তাদের বাড়তে থাকা প্রভাব এবং মিয়ানমারের বৃহৎ জনগোষ্ঠীর আস্থা অর্জন করে তারা কি কেন্দ্রীয় সরকার পরিবর্তনে ভূমিকা রাখতে পারবে? তারা কি তাদের ঐতিহ্যগত সংকীর্ণ জাতিগত দৃষ্টিভঙ্গি থেকে বেরিয়ে আসতে পারবে? জাতিগত সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলো ভবিষ্যৎ গণতান্ত্রিক মিয়ানমারে কী ভূমিকা পালন করতে চায়? সংক্ষেপে, ভবিষ্যৎ মিয়ানমারের জন্য কে বা কারা সাহস করবে ‘কিংমেকার’ হতে?
আরাকান আর্মি (এএ), তাআং ন্যাশনাল লিবারেশন আর্মি (টিএনএলএ) ও মিয়ানমার ন্যাশনাল ডেমোক্র্যাটিক অ্যালায়েন্স আর্মি (এমএনডিএএ) নিয়ে গঠিত জোটের নাম ব্রাদারহুড অ্যালায়েন্স। ২০২৩ সালের শেষ দিকে ‘অপারেশন ১০২৭’ নামের জান্তাবিরোধী এক বড় অভিযানের মাধ্যমে জোটটি প্রতিরোধ আন্দোলনকে চাঙ্গা করে।
এই জোট ২০২৩ থেকে ২০২৪ সালের জানুয়ারির মধ্যে উত্তর শান রাজ্যের ১৬টি টাউনশিপ দখল করে। ২০২৪ সালের জুন মাসে তারা নতুন করে লড়াই শুরু করে এবং লাশিও শহর ও মান্দালয় অঞ্চলের কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ টাউনশিপও দখল করে।
চীনের চাপের কারণে টিএনএলএ ও এমএনডিএএ আপাতত লড়াই বন্ধ রেখেছে। কিন্তু এএ রাখাইন রাজ্যে তাদের আক্রমণ চালিয়েই যাচ্ছে। গত বছরের শেষ দিকে এএ রাজ্যের প্রায় সব টাউনশিপ দখল করে নেয়। বর্তমানে এএ মিয়ানমারের জাতিগত সশস্ত্র সংগঠনগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বড় এলাকা নিয়ন্ত্রণ করছে। এর মধ্যে দক্ষিণ চিন রাজ্যের কিছু অংশও রয়েছে। তাদের এই সামরিক সফলতাকে মিয়ানমারের জনগণ বেশ সমর্থনও করছে।
উত্তরে কাচিন ইনডিপেনডেন্স আর্মি (কেআইএ) পিডিএফকে প্রশিক্ষণ দেওয়ার পাশাপাশি রাজনৈতিক নেতৃত্বে এনইউজিকে সহযোগিতা করছে। ২০২৪ সালের সেপ্টেম্বর থেকে কেআইএ চীন সীমান্ত এলাকা নিয়ন্ত্রণে রেখেছে এবং বর্তমানে তারা ভামো শহরের কৌশলগত এলাকা দখলের জন্য লড়ছে। মিয়ানমারের দক্ষিণাঞ্চলে চ্যালেঞ্জ থাকা সত্ত্বেও কারেন ন্যাশনাল ইউনিয়ন (কেএনইউ) ও ইআরও সক্রিয় লড়াই চালিয়ে যাচ্ছে এবং থাই-মিয়ানমার সীমান্তের অধিকাংশ অংশের নিয়ন্ত্রণ করছে।
জাতিগত সম্পর্ক
সামরিক বিজয়ের পাশাপাশি ইআরওর জনসংযোগ প্রচেষ্টায় অভ্যুত্থানের পর বামার (মিয়ানমারে প্রধান জাতিগত গোষ্ঠী) এবং অ-বামার গোষ্ঠীগুলোর সম্পর্কেও উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন ঘটেছে। সাম্রাজ্যবাদী দৃষ্টিভঙ্গি থেকে সরে এসে বর্মিরা জাতিগত সংখ্যালঘুদের ক্ষোভ স্বীকার করতে শুরু করেছে এবং তাদের প্রতি বোঝাপড়া বাড়ছে। ফলে বামার এবং অ-বামারদের মধ্যে আস্থা বাড়ছে।
উদাহরণ হিসেবে জিংপাও কাচিন ভাষার শব্দ ‘দু কাবা’ ও ‘দু ছন’ দুটির কথা বলা যেতে পারে। এই শব্দ দুটি সামরিক পদমর্যাদাকে নির্দেশ করে। বার্মিজ এলাকাগুলোতে এসব শব্দ এখন সাধারণ শব্দ হয়ে উঠেছে, নিকট অতীতে ছিল না। কারণ অনেক কেআইএ সদস্য কেন্দ্রীয় সমতল অঞ্চলে পিডিএফকে পরিচালনা করছেন।
এসব অগ্রগতির পরও অনেক জাতিগোষ্ঠী এখনও বামারদের বিশ্বাস করে না। তারা নিজেদের জাতিগত স্বার্থকে বেশি গুরুত্ব দেয় এবং বলছে, বামাররা তাদের এলাকা নিজেরা তৈরি ও রক্ষা করুক।
তবে মনে রাখা জরুরি বামাররা সংখ্যায় বেশি হলেও তাদের কাছে এখন পর্যাপ্ত শক্তি নেই এবং নেতৃত্বের অভাব রয়েছে।
এর মানে, বামাররা বর্তমানে দুর্বল এবং তাদের সাহায্য প্রয়োজন। ইআরওভুক্ত গোষ্ঠীগুলো তাদের সাহায্য করছে, কিন্তু কতটুকু?
কিছু সম্ভবনাও আছে। বামার ও মিয়ানমার সেনাবাহিনীকে দুর্বল রাখা হতে পারে, যাতে তারা একে অপরের সঙ্গে লড়াই করতে থাকে।
অন্য একটি সম্ভাবনা হলো ইআরওভুক্ত গোষ্ঠীগুলো মিয়ানমার সেনাবাহিনীকে হারিয়ে সরকারি ক্ষমতা দখল করবে, অথবা বামারদের শক্তিশালী করে এমনভাবে তৈরি করবে যাতে তারা অন্যান্য জাতিগোষ্ঠীর সঙ্গে সত্যি সত্যি ক্ষমতা ভাগ করে নিতে পারে।
ইতিহাস থেকে শিক্ষা
মিয়ানমারের ইতিহাস মূলত বামারদের ঘিরে। তবে অনেক সময় সংখ্যালঘু গোষ্ঠীও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, পিন্য রাজবংশের তিন শান ভাই কেন্দ্রীয় মিয়ানমার শাসন করেছিলেন। অর্থাৎ বামার রাজপরিবারে সংখ্যালঘু নেতাদের প্রভাব ছিল। অন্যদিকে আরাকান রাজা মিন বিন, তাংগু রাজার সঙ্গে জোট বেঁধে হান্তারওয়াদি রাজ্য আক্রমণ করেছিলেন। ওই রাজ্যের নিয়ন্ত্রণ ছিল বাইন্তনাওং সম্রাটের ছেলের হাতে।
ওই ঘটনা ১৬শ শতকে মিয়ানমারের সবচেয়ে শক্তিশালী সাম্রাজ্যের পথ পরিবর্তন করেছিল। এই উদাহরণগুলো দেখায় যে, সংখ্যালঘু গোষ্ঠীগুলো মিয়ানমারের ইতিহাসে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে এবং এমন অনেক ঘটনা রয়েছে। স্বাধীনতার পর কেএনইউ ১৯৫০ সালে তাদের সেনাদের ইয়াংগুনের কাছে পৌঁছানোর মাধ্যমে রাষ্ট্রক্ষমতার কাছাকাছি চলে গিয়েছিল। এখন ইআরওভুক্ত গোষ্ঠীগুলো মিয়ানমারের অর্ধেকেরও বেশি এলাকা নিয়ন্ত্রণ করছে এবং এই নিয়ন্ত্রণ বাড়ছে। এটি মিয়ানমারের সাম্প্রতিক ইতিহাসে নতুন ঘটনা।
এমন পরিস্থিতিতে প্রশ্ন উঠেছে- ইআরওভুক্ত কোনও গোষ্ঠী কি আজকের মিয়ানমারে ‘কিংমেকার’ হতে পারেব? কে বা কারা মিয়ানমারের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্রীয় অঞ্চলে যুদ্ধ করতে যেতে চাইবে? তারা কি তাদের বন্ধু গোষ্ঠী ও এরইমধ্যে সক্রিয় পিডিএফের সাহায্যে এটি করবে?
এসব প্রশ্নের উত্তর নিয়ে গুরুত্বের সঙ্গে ভাবা উচিত ইআরওভুক্ত গোষ্ঠীগুলোর।
কারণ, মিয়ানমারের সাম্প্রতিক ইতিহাস ও চলমান গৃহযুদ্ধ থেকে অনেক কিছু শেখার আছে। বিদ্রোহী গোষ্ঠীগুলো এলাকা দখল করছে, যুদ্ধ চালিয়েও যাচ্ছে। তবু তারা কখনও পুরোপুরি শান্তিতে থাকতে পারবে না, যতক্ষণ না রাজনৈতিক নিরাপত্তা ও প্রকৃত ক্ষমতার পরিবর্তন ঘটে। যারা সামরিক সফলতা পায়, তাদের জন্য স্থায়ী শান্তি সম্ভব নয় যতক্ষণ রাষ্ট্রক্ষমতা নেপিদোতে থাকে। কেন্দ্রীয় ক্ষমতা সবসময় মিয়ানমার সেনাবাহিনীর হাতে ছিল। কারণ তারা শক্তি ও দমন বোঝে।
বেসামরিক এলাকা এবং প্রতিরোধ বাহিনীর দখলে থাকা শহরগুলোতে আক্রমণ বৃদ্ধির ঘটনা প্রমাণ করে যতদিন এসএসি বা এর মতো কোনও প্রতিষ্ঠান রাষ্ট্রক্ষমতায় থাকবে, ততদিন কেউ নিরাপদ না।
চিন প্রতিরোধ গোষ্ঠী সিডিএফ মিন্দাতের প্রধান সালাই ইয়াও মাং ম্রাত বলেন, “যদি আমরা তাদের (এসএসি) কৌশল দেখি, তারা জাতিগত এলাকা থেকে পিছিয়ে কেন্দ্রীয় সমতলভূমিতে একাট্টা হচ্ছে, যেখানে তাদের সামরিক শক্তি রয়েছে। ২০২৪ সালে তারা মিন্দাত হারিয়েছে। কিন্তু ২০৩০ বা ২০৩৫ সালে তারা আবার আসবে।”
জাতিগত গোষ্ঠী ও বামারদের মধ্যে ঐতিহাসিক ক্ষোভের কারণে গভীর অবিশ্বাস এখনও একটি বড় প্রতিবন্ধক। এছাড়া বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর মধ্যে কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের অভাব রয়েছে, যা বৃহত্তর আক্রমণের জন্য একত্রিত হওয়ার প্রচেষ্টাকে জটিল করে তোলে। রাজনৈতিক চুক্তির অভাবে অনেক রাজনৈতিক সমস্যার মীমাংসা হয়নি, যা চলমান উত্তেজনায় ভূমিকা রাখছে। পাশ্ববর্তী দেশগুলোর চাপও পরিস্থিতি আরও জটিল করে তুলেছে। কারণ আঞ্চলিক সম্পর্ক ও স্বার্থ মিয়ানমারের পরিস্থিতিকে প্রভাবিত করে।
মিয়ানমারের মানুষের জন্য এখনও আশার আলো আছে। কারণ শক্তিশালী ইআরওভুক্ত গোষ্ঠীগুলোর অনেক নেতা বলছেন, তাদের আক্রমণ ততদিন চলবে যতদিন পর্যন্ত সরকার উৎখাত না হয়। তবে আগে যেমন প্রশ্ন করা হয়েছে, তাদের মধ্যে কেউ কি সত্যিই মিয়ানমারের ‘কিংমেকার’ হতে সাহসী? এই প্রশ্নের উত্তর আমরা ২০২৫ সালের শেষে জানতে পারব।
তথ্যসূত্র : ইরাবতী