টিকটক আর ব্যবহার করা যাবে না যুক্তরাষ্ট্রে; দেশটিতে এই ভিডিও শেয়ারিং অ্যাপ ব্যবহারকারীর সংখ্যা ১৭ কোটি। এখন তারা কী করবেন?
দেখা যাচ্ছে, টিকটকে থাকা যুক্তরাষ্ট্রের মানুষ এখন ঝুঁকছে আরেকটি চাইনিজ অ্যাপে। এর নাম শিয়াওহংশু। টেক দুনিয়ায় একে চাইনিজ ইনস্টাগ্রামও বলা হয়ে থাকে।
টিকটকের মালিকানা প্রতিষ্ঠান হচ্ছে বাইটড্যান্স। চীনে তাদের অ্যাপের নাম দইয়িন। বৈশ্বিক বাজার ধরতে তারা আর আন্তর্জাতিক সংস্করণ হিসাবে টিকটক এনেছিল, তা দ্রুতই জনপ্রিয় হয়ে উঠে গোটা বিশ্বে।
যুক্তরাষ্ট্রে রবিবার থেকে টিকটক বন্ধের খবরে ‘টিকটক শরণার্থী’দের ভিড়ে এখন শিয়াওহংশুতে গ্রাহকের বন্যা বইছে বলে জানিয়েছে আল জাজিরা।
ছবি, ভিডিও ও টেক্সট পোস্ট করার অ্যাপ শিয়াওহংশু ব্যবহারকারীদের মধ্যে নারীদের সংখ্যা বেশি। মাসে গড়ে এই অ্যাপ ব্যবহারকারীর সংখ্যা ৩০ কোটি।
গত কয়েকদিনে এখন গুগল প্লে স্টোর থেকে শিয়াওহংসু ডাউনলোডের ধুম নেমেছে যুক্তরাষ্ট্রে। একে এখন ‘রেড নোট’ নামে ডাকা হচ্ছে দেশটিতে।
গত ৮ জানুয়ারি থেকে ১৪ জানুয়ারি পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্রে যতবার শিয়াওহংশু ডাউনলোড হয়েছে, তা আগের সপ্তাহের চেয়ে ২০ গুণ বেশি। আর গত বছরের এই সময়ের চেয়ে বেশি ৩০ গুণ।
এই মাসে যত বার শিয়াওহংশু ডাউনলোড হয়েছে, তার ২২ শতাংশই হয়েছে যুক্তরাষ্ট্র থেকে। আর এক মাসে এই অ্যাড ডাউনলোড যুক্তরাষ্ট্রে ১৩০ শতাংশ বেড়েছে।
টিকটকের সর্বশেষ
আদালতের আদেশের পর টিকটক কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, যুক্তরাষ্ট্র সরকার এখন কোনও পদক্ষেপ না নিলে রবিবার থেকে দেশটিতে এই অ্যাপের কার্যক্রম বন্ধ থাকবে।
প্রায় এক বছর ধরে টিকটক কর্তৃপক্ষের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্র সরকারের চলা দ্বন্দ্বের মধ্যে সুপ্রিম কোর্ট শুক্রবার চীনা অ্যাপটির সচল থাকার আবেদন খারিজ করে দেয়।
যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন ২০২৪ সালের ২৪ এপ্রিল ‘প্রটেকটিং আমেরিকানস ফ্রম ফরেন অ্যাডভারসারি কন্ট্রোলড অ্যাপলিকেশন অ্যাক্ট’ নামে একটি আইনে সই করলে দেশটিতে হুমকির মুখে পড়ে টিকটক।
ওই আইনে বলা হয়, চীনা মূল কোম্পানি বাইটড্যান্স টিকটকে তাদের অংশীদারত্ব ছয় মাসের মধ্যে কোনও আমেরিকান কোম্পানির কাছে বিক্রি করে দেবে, নয়ত যুক্তরাষ্ট্রে এই অ্যাপ নিষিদ্ধ করা হবে।
টিকটক ওই আইন আটকাতে গত বছরের মে মাসেই আদালতে গিয়েছিল। তারা দাবি করেছিল, এ ধরনের আইন বাক স্বাধীনতার অধিকারের ওপর হস্তক্ষেপ এবং যুক্তরাষ্ট্রের সংবিধানের প্রথম সংশোধনীর সঙ্গে সাংঘর্ষিক।
তবে শুক্রবার চীনা কোম্পানির করা আপিল খারিজ করে দেয় যুক্তরাষ্ট্রের সুপ্রিম কোর্ট। তার অর্থ, টিকটকের যুক্তরাষ্ট্র সংস্করণ অ্যাপ স্টোর ও ওয়েব হোস্টিং সার্ভিস থেকে সরিয়ে রাখা হবে।
টিকটকের বিরুদ্ধে বিরুদ্ধে চীন সরকারের কাছে তথ্য পাচারের অভিযোগ এনেছিল যুক্তরাষ্ট্র সরকার। যুক্তরাষ্ট্রের কংগ্রেসে গত বছরের এপ্রিলে পাস হওয়া আইনে বলা হয়, নিষেধাজ্ঞা এড়াতে হলে নিরপেক্ষ কারও কাছে টিকটকের যুক্তরাষ্ট্রের শেয়ার অবশ্যই বিক্রি করতে হবে।
অ্যাপটির মূল কোম্পানি বাইটড্যান্সকে ২০২৫ সালের ১৯ জানুয়ারির মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রের শেয়ার বিক্রি করতে বলা হয়েছিল। কিন্তু তারা তা না করে আইনি লড়াইয়ে যায়।
ধারণা করা হয়েছিল, যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞা দেশটির টিকটক ব্যবহারকারীদের ওপর কোনও ধরনের প্রভাব ফেলবে না, যারা এরই মধ্যে তাদের মোবাইল ফোনে অ্যাপটি ডাউনলোড করেছেন।
কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে, নিষেধাজ্ঞা কার্যকর করা হলে ওই ব্যবহারকারীরা টিকটক অ্যাপের কোনও আপডেট পাবেন না। ফলত একপর্যায়ে এটি ব্যবহার করা অসম্ভব হয়ে পড়বে।
চীন সরকারের সঙ্গে সম্পৃক্ততার অভিযোগ তুলে গত বছর যুক্তরাষ্ট্রে টিকটক নিষিদ্ধের পক্ষে ভোট দিয়েছিলেন ডেমোক্রেটিক ও রিপাবলিকান পার্টির আইনপ্রণেতারা।
যদিও টিকটক এই অভিযোগ প্রত্যাখ্যান করে বলেছিল, চীন সরকারকে তারা টিকটক ব্যবহারকারীদের কোনও তথ্য দেয় না।
রবিবারের পর যুক্তরাষ্ট্রে টিকটক ব্যবহার করা যাবে কি না, তা এখন দেশটির প্রেসিডেন্টের সিদ্ধান্তের ওপর নির্ভর করছে।
প্রেসিডেন্ট হিসাবে বাইডেন আর ক্ষমতায় রয়েছেন দুদিন। সোমবার নতুন প্রেসিডেন্ট হিসাবে দায়িত্ব নেবেন ডোনাল্ড ট্রাম্প।
এই অবস্থায় টিকটক নিয়ে নতুন সিদ্ধান্ত নেওয়ার ভার বাইডেন পরবর্তী প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের ওপর ছেড়ে দিয়েছেন বলে জানিয়েছে যুক্তরাজ্যের সংবাদমাধ্যম স্কাই নিউজ।
ট্রাম্প তার প্রথম মেয়াদে নির্বাহী আদেশের মাধ্যমে দেশটিতে টিকটক বন্ধ করার কথা বলেছিলেন। অবশ্য গত ডিসেম্বরে তিনি তার সেই অবস্থান থেকে সরে এসে জানান, এবারের নির্বাচনে তরুণদের ভোট পেতে টিকটক তাকে সহযোগিতা করে।
একই সঙ্গে ট্রাম্প এ ইঙ্গিতও দেন, তিনি টিকটক নিষিদ্ধের বিপক্ষে। তিনি বলেন, টিকটক ঘিরে তার সিদ্ধান্ত শিগগিরই জানানো হবে এবং এনিয়ে তার সঙ্গে চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংয়ের কথাও হয়েছে।
যে পথে নিষিদ্ধ টিকটক
২৪ এপ্রিল, ২০২৪ : যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন এদিন টিকটক সংক্রান্ত আইনে সই করেন, যাতে বলা হয়, ছয় মাসের মধ্যে অ্যাপটির শেয়ার বিক্রি করতে হবে, নইলে যুক্তরাষ্ট্রে এটি নিষিদ্ধ করা হবে।
৭ মে, ২০২৪ : আইনটি আটকাতে মামলা করে টিকটক কর্তৃপক্ষ। মামলায় বলা হয়, এই আইনের মাধ্যমে মতপ্রকাশের স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ করা হচ্ছে।
২ আগস্ট, ২০২৪ : টিকটকের বিরুদ্ধে মামলা করে যুক্তরাষ্ট্র সরকার। অভিযোগ, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমটি বেআইনিভাবে শিশুদের তথ্য সংগ্রহ করছে এবং অভিভাবকরা তাদের সন্তানদের অ্যাকাউন্ট বন্ধ করার চেষ্টা করলে তাতে সাড়া দিচ্ছে না অ্যাপ কর্তৃপক্ষ।
৬ ডিসেম্বর, ২০২৪ : ২০২৫ সালের শুরুতে যুক্তরাষ্ট্রে টিকটক নিষিদ্ধ বা শেয়ার বিক্রি করার আইন বাতিলে টিকটকের আপিল খারিজ করে আদালত।
২৭ ডিসেম্বর, ২০২৪ : টিকটকের ওপর আসন্ন নিষেধাজ্ঞার সময় পেছাতে সুপ্রিম কোর্টকে আহ্বান জানান যুক্তরাষ্ট্রের নবনির্বাচিত প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প।
১০ জানুয়ারি, ২০২৫ : টিকটক ও কন্টেন্ট ক্রিয়েটরদের পক্ষের আইনজীবীরা সুপ্রিম কোর্টের নয়জন বিচারককে জানান, টিকটকের ওপর নিষেধাজ্ঞা যুক্তরাষ্ট্রের ১৭ কোটি ব্যবহারকারীর মতপ্রকাশের স্বাধীনতার লঙ্ঘন।
১৭ জানুয়ারি, ২০২৫ : জাতীয় নিরাপত্তা বিবেচনায় নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের সুপ্রিম কোর্ট টিকটক নিষিদ্ধের আইন বহাল রাখে।
১৯ জানুয়ারি, ২০২৫ : টিকটকের যুক্তরাষ্ট্রের শেয়ার বিক্রির শেষ দিন। শেয়ার বিক্রি না হলে এদিন থেকে দেশটিতে অ্যাপটি নিষিদ্ধ হয়ে যাবে।